পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৪
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

অণু হতে অণীয়ান মহৎ হইতে মহীয়ান
ইন্দ্রিয়ের পারে তার পেয়েছি সন্ধান।

ক্ষণে ক্ষণে দেখিয়াছি দেহের ভেদিয়া যবনিকা
অনির্বাণ দীপ্তিময়ী শিখা॥

 রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধিতে দেখা যায় যে, তিনটি দর্শনের কথা রহিয়াছে—

 তিনি ভূমাকে দেখিয়াছেন, অণু হইতে অণীয়ান মহৎ হইতে মহীয়ানকে দেখিয়াছেন এবং দেহের যবনিকার আড়ালে দীপ্তিময়ী শিখাকে দেখিয়াছেন।

 এই তিনটি দর্শনে তিনি ব্রহ্মকেই দেখিয়াছেন কিনা, ইহাই হইবে আমাদের প্রধান বিচার্য। আর এই তিনটি দর্শনের আড়ালে কি এবং কোন্ সাধনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাহাই হইবে আমাদের দ্বিতীয় জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসাটির পৃথক কোন আলোচনার আবশ্যক করিবে না, মূল বিচার্যের বিশ্লেষণের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সাধনার পরিচয়ও স্বতই আসিয়া পড়িবে।

 তিনি ভূমাকে দেখিয়াছেন, তিনটি দর্শনের মধ্যে প্রথমে এই দেখা বা উপলব্ধিকেই গ্রহণ করা যাইতেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন হইবে, কে এই ভূমা, যাহাকে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়াছেন?

 ভূমা শব্দের আভিধানিক অর্থ হইল মহান (ভূমা—বহু+ইমন্ = মহান)। উপনিষদে ব্রহ্মেরই (ব্রহ্ম-শব্দেরও অভিধানিক অর্থ বৃহৎ) এক নাম বলা হইয়াছে ভূমা। প্রসিদ্ধ ছান্দোগ্য উপনিষদে নারদ-সনৎকুমার সংবাদে এই ভূমাতত্ত্ব উপদিষ্ট হইয়াছে। আত্মজিজ্ঞাসু নারদকে সনৎকুমার ব্রহ্মবিদ্যায় উপদেশ করিয়া বলিয়াছেন—

 “যো বৈ ভূমা তৎসুখং নাল্পে সুখং ভূমৈব সুখং”—যাহা ভূমা, তাহাই সুখ; যাহা অল্প, তাহাতে সুখ নাই। ভূমাই সুখ॥

 অতঃপর এই ভূমার পরিচয়ে ভগবান সনৎকুমার বলিয়াছেন, “যো বৈ ভূমা তদমৃতমথ যদল্প তন্মর্তং”— যাহা ভূমা তাহাই অমৃত, আর যাহা অল্প তাহাই মরণশীল॥

 উপদেশের উপসংহার করিয়া সনৎকুমার বলিয়াছেন, “স বা এষ এবং পশ্যন্ ..আত্মরতিরাত্মক্রীড় আত্মমিথুন আত্মানন্দং স্ব স্বরাড়্ ভবতি”—

 এই ভূমাকে যিনি এই প্রকারে দর্শন করেন, তিনি আত্মরতি, আত্মক্রীড়, আত্মমিথুন (আত্মাতে যাঁহার মিথুন ভাব) এবং আত্মানন্দ হন তিনি স্বরাট (স্ব+রাজ = আত্মেশ্বর, স্বাধীন, কিম্বা আপনাতে আপনি বিরাজমান) হন॥