বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৬
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

 পঞ্চাশ বৎসরে আসিয়া রবীন্দ্রনাথ নিজের ‘জীবন বৃত্তান্তে’ একস্থানে এই কয়টি কথা লিখিয়াছেন—

 “আমার সুদীর্ঘ কালের কবিতা লেখার ধারাটাকে পশ্চাৎ ফিরিয়া যখন দেখি, তখন ইহা স্পষ্ট দেখিতে পাই—এ একটা ব্যাপার, যাহার উপরে আমার কোনই কর্তৃত্ব ছিল না। যখন লিখিতেছিলাম, তখন মনে করিয়াছি আমিই লিখিতেছি বটে, কিন্তু আজ জানি, কথাটা সত্য নহে।”

 এখানে স্পষ্ট ইঙ্গিত রহিয়াছে যে, কবিতা তিনিই লিখিয়াছেন, অথচ আসল লেখক তিনি নহেন, অপর একজন, ইহাই রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট দেখিতে পাইয়াছেন। কর্ম করিয়াও গীতার কর্মযোগী নিজে কর্মকর্তা নহে, সেই লক্ষণই কি এখানে অভিব্যক্ত নহে?

 কথাটা রবীন্দ্রনাথ আরও স্পষ্ট করিয়াছেন এইভাবে,—

 “অন্তত আমার নিজের মধ্যে তাহা উপলব্ধি করিয়াছি। যখন যেটা লিখিতে ছিলাম, আমিই যে তাহা লিখিতেছি এবং একটা কোনো বিশেষভাব অবলম্বন করিয়া লিখিতেছি, এ-সম্বন্ধেও সন্দেহ ঘটে নাই। কিন্তু আজ জানিয়াছি, সে সকল লেখা উপলক্ষ্য মাত্র...... তাহাদের রচয়িতার মধ্যে আর একজন যে রচনাকারী আছেন, ········ফুৎকার বাঁশির এক-একটা ছিদ্রের মধ্যে দিয়া এক-একটা সুর জাগাইয়া তুলিতেছে এবং নিজের কৃতিত্ব উচ্চস্বরে প্রচার করিতেছে, কিন্তু কে সেই বিচ্ছিন্ন সুরগুলিকে রাগিণীতে বাঁধিয়া তুলিতেছে? ফুঁ সুর জাগাইতেছে বটে, কিন্তু ফুঁ তো বাঁশি বাজাইতেছে না। সে বাঁশি যে বাজাইতেছে, তাহার কাছে সমস্ত রাগরাগিণী বর্তমান আছে, তাহার অগোচরে কিছুই নাই॥”

 কবি রবীন্দ্রনাথ বাঁশিমাত্র, আসল যিনি কবি তিনিই এই ‘কবি বাঁশিটিকে’ বাজাইয়াছেন এবং সেই বাঁশিতে যে রাগরাগিণীর সৃষ্টি হইয়াছে, তাহাই ‘রবীন্দ্ররচনাবলী’ বলিয়া খ্যাত। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য রচনা তাঁহার হইয়াও তাঁহার নহে, আসল রচনাকারী অপর একজন। কাজেই বাঁশীর মত সেই অচেনার হাতেই তিনি বাজিয়াছেন, কোন কর্তৃত্বই এই রাগ-রাগিণী তথা সাহিত্য সৃষ্টিতে তাঁহার নাই, রবীন্দ্রনাথ বলেন। গীতায় কর্মযোগীর প্রকৃষ্ট নিদর্শন বা লক্ষণই কি এখানে দেখা যায় না? আসল কর্মকর্তা স্বয়ং ঈশ্বর, আর তিনি নিমিত্তমাত্র, এই দৃষ্টিতেই তাঁহার সাহিত্যকর্মকে রবীন্দ্রনাথ জানিয়াছেন এবং তাহাই জানাইতে চাহিয়াছেন।

 ইহার পরেই এই কয়টি কথা রবীন্দ্রনাথের মুখ হইতে শুনিতে পাওয়া যায়—

 “শুধু কি কবিতা লেখার একজন কর্তা কবিকে অতিক্রম করিয়া তাঁহার