পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৪
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

 প্রশ্নোপনিষদে ব্রহ্মকে পিতা ও মাতা বলিয়া সম্বোধন রহিয়াছে। মুন্ডকোপনিষদে একই দেহবৃক্ষে ব্রহ্ম এবং জীবকে সখ্য সম্পর্কে যুক্ত দুইটি পক্ষী বলা হইয়াছে। ব্রহ্মকে পিতা, মাতা, সখা, প্রিয়তম ইত্যাদি উপদেশে ভক্তি এবং প্রেমতত্ত্বই বিবৃত হইয়াছে। ব্রহ্মকে বলা হইয়াছে, ‘রসস্বরূপ, এই রসস্বরূপকে পাইয়াই তবে জীব আনন্দিত হয়।’

 এই রস-স্বরূপ, এই প্রিয়তম ব্রহ্ম বা ভগবানের সঙ্গে জীবের যে প্রেমসম্পর্ক, তাহারই অত্যুজ্জল রসমূর্তি গীতাঞ্জলি, একথাও শুধু উল্লেখ করিয়া রাখা গেল।

 গীতাঞ্জলিকে রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন ভগবানের নিকট আত্মনিবেদন। এই আত্মনিবেদন যে উপনিষদেরই উপদিষ্ট ব্রহ্ম সম্পর্কে, তাহার প্রমাণ পূর্বোক্ত উদ্ধৃতিসমূহেই পাওয়া গিয়াছে। অর্থাৎ ভক্তি, প্রেম ইত্যাদি উপনিষদেরই উপদেশ, ইহা আমরা দেখিয়াছি এবং গীতাঞ্জলিকে এই ভক্তি, প্রেম ইত্যাদিরই উজ্জ্বল রসরূপ বলিয়া আমরা অভিহিত করিয়াছি। কাজেই গীতাঞ্জলিকে আলোচ্য ক্ষেত্রে সাক্ষ্যরূপে উপস্থিত করিবার আদেশ উপনিষদের উপদেশেই আমরা পাইতেছি।


 অপর একটি অসুবিধার কথা এখন উল্লেখ করা যাইতেছে—

 উপনিষদে ব্রহ্ম সম্বন্ধে উপদেশ পাওয়া যায়, ব্রহ্মপ্রাপ্তির ফলও জানা যায়, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের জীবনযাত্রার কোন চিত্র পাওয়া যায় না। ব্রহ্মকে জানার পর ব্রহ্মজ্ঞ পুরষের চরিত্রচিত্র কিরপ হইয়া থাকে, সে-বিবরণ মহাভারত, ভাগবত, পুরাণাদি শাস্ত্রেই বিশদভাবে পাওয়া যায়, উপনিষদে তাহার সন্ধান পাওয়া যায় না।

 অবশ্য, ব্রহ্মজ্ঞের জীবনের মূল সূত্রগুলি উপনিষদেই পাওয়া যায়। কিন্তু তাহা বড় জোর তাঁহাদের জীবনের স্বরলিপি মাত্র, তাহা তাঁহাদের জীবন-সঙ্গীত নহে। বাড়ির নক্সা হইতে একটা বাড়ি যে নির্মাণ না করা যাইতে পারে, এমন নহে। কিন্তু উপনিষদ হইতে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের জীবনসূত্র লইয়া রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষ গড়িতে পারে, এমন স্রষ্টা বিশ্বকর্মা সুদুর্লভ। এই বিষয়ে মহাভারত, ভাগবত, পুরাণাদিতে যে-চিত্র পাওয়া যায়, তাহাই আমাদের একমাত্র সম্বল ও আশ্রয়।

 গীতার উপদেশ হইতে যেমন ভগবানের জীবন-চরিত্র অঙ্কিত করা চলে না, উপনিষদের ব্রহ্ম উপদেশ বা ব্রহ্ম সূত্র হইতেও তেমনি ব্রহ্মজ্ঞ ঋষির জীবনকাহিনী অঙ্কিত করা সম্ভব নহে, ইহাই আমরা বলিতে চাহিয়াছি।

 প্রামাণ্য উপনিষদ কয়খানির মধ্যে একমাত্র তৈত্তিরীয় উপনিষদে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের একটি রেখাচিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের সেই চিত্রটি এই—