পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮০
পদ্মানদীর মাঝি

কিবা?—দাড়িতে হাত বুলায় হােসেন, সকলকে অভয় দিয়া আবার বলে, ডরাইও না, দশ বাজলি কুয়াশা থাকবাে না। আইজ কাইল রােজ বিহানবেলা কুয়াশা হয়। এ্যারে কী কুয়াশা কয় মাঝি?

 বসিয়া বসিয়া হােসেন গল্প বলে, সকলে শােনে। এ যেন কেতুপুরেরই এক ভাঙা কুটিরে হােসেনের আড্ডা বসিয়াছে। এমনই কুয়াশার মধ্যে একবার সে সমুদ্রের বুকে হারাইয়া গিয়াছিল, তিন দিন নােঙর ফেলিয়া ছিল সমুদ্রে, জল ফুরাইয়া গিয়া শেষের দিন তৃষ্ণায় ছাতি তাহাদের ফাটিয়া গিয়াছিল। তারপর হােসেন কম্পাস কিনিয়াছে, তারা দেখিয়া নৌকার অবস্থান নির্ণয়ের যন্ত্র কিনিয়াছে—চাটগাঁয়ে হােসেন যখন জাহাজে কাজ করিত, খালাসির কাজ করিতে করিতে শেষ পর্যন্ত একটা মালবাহী স্টিমারের বাে'সান পর্যন্ত সে হইয়াছিল, সেই সময় এক সাহেব কাপ্তেনের কাছে সে এসব যন্ত্রের ব্যবহার শিখিয়াছে। বড়াে বড়াে জাহাজ চালাইয়া হােসেন এখন পৃথিবী ঘুরিয়া আসিতে পারে!

 পৃথিবী সে কি ঘুরিয়া আসে নাই? হ, সে কাহিনি বলিবার মতাে বটে! কুড়ি বছর বয়সে হােসেন বাড়ি ছাড়িয়া পালাইয়াছিল, তারপর অর্ধেক জীবন সে তাে দেশ-বিদেশে ঘুরিয়াই কাটাইয়াছে—নদীর বুকে ও সমুদ্রে।

 অনেক বেলায় আস্তে আস্তে কুয়াশা মিলাইয়া গেল। নােঙর তােলা হইল। দুঘণ্টা পরে দূরে দেখা গেল ধনমানিকদ্বীপ। কম্পাসটা সামনে রাখিয়া হােসেন হাল ধরিয়া বসিল, পরদিন ভােরবেলা তাহারা ময়নাদ্বীপে পৌছিয়া নােঙর ফেলিল।

 এই ময়নাদ্বীপ? পাঁচ ছয় বৎসর ধরিয়া যে রহস্য-নিকেতনের কথা সে শুনিয়া আসিয়াছে? কুবের যেন একটিমাত্র দৃষ্টিপাতে সমস্ত দ্বীপটিকে দেখিয়া ফেলিতে চায়। দ্বীপের খানিকটা ডিম্বাকৃতি, খানিকটা ত্রিকোণ। দ্বীপের দীর্ঘতম পরিসর প্রায় এগারাে মাইল—হােসেন নিজে মাপিয়া দেখিয়াছে। দ্বীপের যেখানে নৌকা ভিড়িয়াছিল, সেদিকে খানিকটা অংশ পরিষ্কার করিয়া বসতি স্থাপিত হইয়াছে, চাষ হইতেছে, বাকি অংশ জঙ্গলে ঢাকা। পশ্চিম দিকে অসংখ্য নারিকেল গাছ, সমস্ত দ্বীপে ছড়াইয়া না পড়িয়া গাছগুলি একস্থানে ঘন হইয়া মাথা তুলিয়াছে কেন বােঝা যায় না।

 জমি অত্যন্ত নিচু, এত নিচু যে আশঙ্কা হয় যেদিন খুশি হইবে, সেইদিনই সমস্ত দ্বীপটিকে সমুদ্র গ্রাস করিয়া ফেলিবে। দ্বীপের মাঝখানে এক মাইল পরিমিত একটা লােনা জলা আছে, সমুদ্রের চেয়েও ওখানটা বুঝি নিচু, খাল কাটিয়া যোগ করিয়া দিলে সমুদ্রের জল আসিয়া ভরিয়া ফেলিবে। জলার ধারে খানিকটা ধানের জমি করা হইয়াছে, বিস্ময়কর ফসল ফলে। জলায় ও চারিদিকের জঙ্গলে অসংখ্য সাপ আছে, কিন্তু জন্তু-জানােয়ার কিছু নাই, রাসু যে বাঘ সিংহের গল্প করিয়াছিল সেটা নিছক গল্পই।

 হােসেন মিয়ার উপনিবেশে লােকসংখ্যা একশোর কম নয়, কিন্তু তার তিনভাগই প্রায় ছােটো ছােটো ছেলেমেয়ে, যাদের অধিকাংশ এই দ্বীপে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। ম্যালেরিয়া ও সাপের সঙ্গে লড়াই করিয়া এখনও হােসেন জয়লাভ করিতে পারে নাই, জঙ্গলের