পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্ত্রীশিক্ষা ও জেনানা-ভাঙ্গার প্রবন্ধ সকল প্রায় দেবেন্দ্র বাবুর বৈঠকখানাতেই পড়া হইত। তৎসম্বন্ধে তর্কবিতর্ককালে মাষ্টার সর্বদাই দম্ভ করিয়া বলিতেন যে, "কখন যদি আমার সময় হয়, তবে এ বিষয়ে প্রথম রিফর্ম করার দৃষ্টান্ত দেখাইব । আমার বিবাহ হইলে আমার স্ত্রীকে সকলের সম্মুখে বাহির করিব।” এখন ত বিবাহ হইল—কুন্দনন্দিনীর সৌন্দর্য্যের খ্যাতি ইয়ারমহলে প্রচারিত হইল । সকলে প্রাচীন গীত কোটু করিয়া বলিল, “কোথা রহিল সে পণ ?” দেবেন্দ্র বলিলেন, “কৈ হে, তুমিও কি ওল্ড ফুলদের দলে ? স্ত্রীর সহিত আমাদের আলাপ করিয়া দাও না কেন ?” তারাচরণ বড় লজ্জিত হইলেন । দেবেন্দ্র বাবুর অগ্ন্যুরোধ ও বাক্যযন্ত্রণা এড়াইতে পারিলেন না । দেবেন্দ্রের সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর সাক্ষাৎ করাষ্টতে সম্মত হইলেন । কিন্তু ভয়, পাছে স্বৰ্য্যমুখী শুনিয়া রাগ করে । এই মত টাল-মাটাল করিয়া বৎসর বিধি গেল । তাহার পর আর টাল-মাটালে চলে না। দেখিয়। বাড়ী মেরামতের ওক্তর করিয়া কুন্দকে নগেন্দ্রের গৃহে পঠাইয়া দিলেন । বাড়া মেরামত হইল । আবার অানিতে হইল । ওখম দেবেন্দ্র এক দিন স্বয়ং দলবলে তারাচরণের অঞ্চয়ে উপস্থিত হইলেন এবং তারাচরণকে মিথ্যা দাস্তিকতার জন্য ব্যঙ্গ করিতে লাগিলেন। তখন অগত্যা তারাচরণ কুন্দনন্দিনীকে সাজাইয়৷ আনিয়া দেবেন্দ্রের সঙ্গে আলাপ করিয়া দিলেন । কুন্দনন্দিনী দেবেন্দ্রের সঙ্গে কি আলাপ করিল ? ক্ষণকাল ঘোমটা দিয়া দাড়াইয়। থাকিয় কঁাদিয়া পলাইয় গেল । কিন্তু দেবেন্দ্র তাহার নবযৌবনসঞ্চারের অপূৰ্ব্বশোভা দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন । সে শোভা আর ভুলিলেন না। ইঙ্গর কিছু দিন পরে দেবেন্দ্রের বাটতে কোন ক্রিয় উপস্থিত । তাহার বাট হইতে একটি বালিকা কুন্দকে নিমন্ত্ৰণ করিতে আসিল । কিন্তু স্বৰ্য্যমুখী তাহা শুনিতে পাইয়া নিমন্ত্রণে যাওয়া নিষেধ করিলেন ; সুতরাং যাওয়া হইল না । ইহার পর আর একবার দেবেন্দ্র, তারাচরণের গৃহে আসিয়া কুন্দের সঙ্গে পুনরালাপ করিয়া গেলেন । লোকমুখে স্বৰ্য্যমুখী তাহাও শুনিলেন । শুনিয়। তারাচরণকে এমন উৎসনা করিলেন যে, সেই পৰ্য্যস্ত কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে দেবেন্দ্রের আলাপ বন্ধ হইল । বিবাহের পর এইরূপে তিন বৎসরকাল কাটিল। তাহার পর—কুন্দনন্দিনী বিধবা হইলেন। জরবিকারে তারাচরণের মৃত্যু হইল। স্বৰ্য্যমুখী কুন্দকে আপন বাড়ীতে আনিয়া রাখিলেন। তারাচরণকে ষে বাড়ী ht రి করিয়া দিয়াছিলেন, তাহ বেচিয়া কুন্দকে কাগজ করিয়া দিলেন । পাঠক মহাশয় বড় বিরক্ত হইলেন সত্য, কিন্তু এত দুরে আখ্যায়িকা আরম্ভ হইল। এত দূরে বিষবৃক্ষের বীজবপন হইল । - নবম পরিচ্ছেদ হরিদাসী বৈষ্ণবী বিধবা কুন্দনন্দিনী নগেন্দ্রের গৃহে কিছুদিন কালাতিপাত করিল। এক দিন মধ্যাহ্নের পর পৌরস্ত্রীরা সকলে মিলিত হইয়া পুরাতন অস্তঃপুরে বসিয়াছিল। ঈশ্বরকৃপায় তাহারা অনেকগুলি ; সকলে স্ব স্ব মনোমত গ্রাম্যন্ত্রীসুলভ কার্য্যে ব্যাপুত ছিল । তাহাদের মধ্যে অনতীতবাল্যা কুমারী হইতে পলিতকেশ৷ বর্ষীয়সী পর্য্যন্ত সকলেষ্ট ছিল। কেহ চুল বাধাইতে ছিল, কেহ চুল বাধিয়া দিতেছিল, কেহ মাথা দেখাইতেছিল, কেহ মাথা দেখিতেছিল এবং উ উ” করিয়৷ উকুন মারিতেছিল ; কেহ পাক চুল তুলাইতেছিল, কেহ ধান্তহস্তে তাহা তুলিতেছিল । কোন সুন্দরী স্বীয় বালকের জন্য বিচিত্র র্কাথা সিয়াইতেছিলেন, কেহ বালককে স্তন্যপান করাইতেছিলেন, কোন সুন্দরী চুলের দড়ি বিনাইতেছিলেন, কেহ ছেলে ঠেঙ্গাইতেছিলেন, ছেলে মুখব্যাদান করিয়া তিনগ্রামে সপ্তম্বরে রোদন করিতেছিল । কোন রূপসী কার্পেট বুনিতেছিলেন, কেহ থাব পাতিয়া তাহা দেখিতেছিলেন । কোন চিত্ৰকুশল কাহারও বিবাহের কথা মনে করিয়া পিড়িতে আলপন দিতেছিলেন, কোন সদ্‌গ্ৰন্থরসগ্রাহিণী বিদ্যাবতী দাশু রায়ের পাচালী পড়িতেছিলেন, কোন বর্ষীয়ুস পুত্রের নিন্দ করিয়া শ্রোত্রীবশ্বের কর্ণ পরিতৃপ্ত করিতেছিলেন, কোন রসিক যুবতী অৰ্দ্ধফুটস্বরে স্বামীর রসিকতার বিবরণ সখীদের কাণে কাণে বলিয়া ৰিরহিণীর মনোবেদন বাড়াইতেছিলেন । কেহ গৃহিণীর নিন্দা, কেহ কৰ্ত্তার নিন্দা, কেহ প্রতিবাসীদিগের নিন্দ করিতেছিলেন ; অনেকেই আত্মপ্রশংসা করিতেছিলেন । বিনি স্বৰ্য্যমুখী কর্তৃক প্রাতে নিজ বুদ্ধিহীনতার জন্য মৃদুভৎসিত হইয়াছিলেন, তিনি আপনার বুদ্ধির অসাধারণ প্রাথর্য্যের । অনেক উদাহরণ প্রয়োগ করিতেছিলেন । যাহার রন্ধনে: প্রায় লবণ সমান হয় না, তিনি আপনার পাকনৈপুণ্য সম্বন্ধে সুদীর্ঘ বক্তৃতা করিতেছিলেন ; wর্যাহার স্বামী