পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ । উদিপুরী অৰ্দ্ধজাগ্রতের স্বরে, রসনার জড়তা সহিত বলিল, “এত রাত্রে কেন ?” জে। একটা বড় খবর আছে । উ। কি ? মারহাট্টা ডাকু মরেছে ? জে । তারও অপেক্ষ খোস খবর। এই বলিয়া জেব-উন্নিসা গুছাইয়া, বাড়াইয়া, রং ঢালিয়া দিয়া, চঞ্চলকুমারীর সেই তসবীর ভাঙ্গার গল্পটা করিলেন । উদিপুর জিজ্ঞাসা করিল, “এ আর খোসখবর কি ?” • জেব-উন্নিসা বলিল, “এই মহিষের মত বাদীগুল৷ হজরতের তামাকু সাজে, আমি তাহ দেখিতে পারি না। রূপনগরের সেই সুন্দরী রাজকুমারী আসিয়া হজরতের তামাকু সাজিবে, বাদশাহের কাছে এই ভিক্ষা চাহিও ।” উদিপুরী না বুঝিয়া, নেশার ঝোকে বলিল, “বহুৎ আচ্ছা ।” ইহার কিছু পরে রাজকাৰ্য্যপরিশ্রমক্লাস্ত বাদশাহ শ্রমাপনয়ন জন্ত উদিপুরীর মন্দিরে উপস্থিত হইলেন । উদীপুরী নেশার ঝেণকে চঞ্চলকুমারীর কথা জেবউন্নিসার কাছে যেমন শুনিয়াছিল, তেমনই বলিল । সে আসিয়া আমার তামাকু সাজিবে, এ প্রার্থনাও জানাইল । বলিবামাত্র ঔরঙ্গজেব শপথ করিয়া স্বীকার করিলেন । কেন না, ক্রোধে অস্থির হইয়াছিলেন । -

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ যোধপুরী বেগম পরদিন রাজাজ্ঞা প্রচারিত হইল । রূপনগরের ক্ষুদ্র রাজার উপর এক আদেশপত্র জারি হইল । যে অদ্বিতীয় কুটিলতা-ভয়ে জয়সিংহ ও যশোবন্তসিংহ প্রভৃতি সেনাপতিগণ ও আজিমশাহ প্রভৃতি শাহজাদাগণ সৰ্ব্বদা শশব্যস্ত—ষে অভেদ্য কুটিলতাজালে বদ্ধ হইয়া চতুরাগ্রগণ্য শিবজীও দিল্লীতে কারাবদ্ধ হুইয়াছিলেন-এই আজ্ঞাপত্র সেই কুটিলতাপ্রস্থত । তাহাতে লিখিত হইল যে, “বাদশাহ রূপনগরের রাজকুমারীর অপূৰ্ব্ব রূপলাবণ্যবৃত্তান্ত শ্রবণে মুগ্ধ হইয়াছেন। আর রূপনগরের রাও সাহেবের সৎস্বভাব ও রাজভক্তিতে বাদশাহ প্রীত হইয়াছেন । অতএব বাদশাহ রাজকুমারীর পাণিগ্রহণ করিয়া র্তাহার সেই রাজভক্তি পুরস্কৃত করিতে ইচ্ছা করেন। রাজ কন্যাকে দিল্লীতে পাঠাইবার উদ্যোগ করিতে సి থাকুন ; শীঘ্র রাজসৈন্য আসিয়া কন্যাকে দিল্লীতে: লইয়া যাইবে ” ** এই সংবাদ রূপনগরে আসিবামাত্র মহা হুলস্থূল । পড়িয়া গেল । রূপনগরে আর আনন্দের সীমা রহিল না। যোধপুর, অম্বর প্রভৃতি বড় বড় রাজপুতরাজগণ মোগল-বাদশাহকে কন্যা দান করা অতি । গুরুতর সৌভাগ্যের বিষয় বলিয়া বিবেচনা করিতেন । । সে স্থলে রূপনগরের ক্ষুদ্রজীবী রাজার অদৃষ্টে এই শুভ ফল বড়ই আনন্দের বিষয় বলিয়া সিদ্ধ হইল । বাদশাহের বাদশাহ - যাহার সমকক্ষ মমুম্ভলোকে । কেহ নাই—তিনি জামাতা হইবেন—চঞ্চলকুমারী পৃথিবীশ্বরী হইবেন—ইহার অপেক্ষা আর সৌভাগ্যের বিষয় কি আছে ? রাজা, রাজরাণী, পৌরজন, রূপনগরের প্রজাবৰ্গ আনন্দে মাতিয়া উঠিল । রাণী দেবমন্দিরে পুজা পাঠাইয়া দিলেন । রাজ এই সুযোগে কোন ভূম্যধিকারীর কোন কোন গ্রাম কাড়িয়া লইবেন, তাহার ফর্দ করিতে লাগিলেন । কেবল চঞ্চলকুমারীর সখীগণ নিরানন্দ । তাহার জানিত ষে, এ সম্বন্ধে মোগলদ্বেষিণী চঞ্চলকুমারীর সুখ নাই । ংবাদটা অবশু দিল্লীতেও প্রচার পাইল । বাদশাহী রঙমহালে প্রচারিত হইল। ষোধপুরী বেগম শুনিয়া বড় নিরানন্দ হইলেন । তিনি হিন্দুর মেয়ে, মুসলমানের ঘরে পড়িয়া ভারতেশ্বরী হুইয়াও তাহার মুখ ছিল না । তিনি ঔরঙ্গজেবের পুরীমধ্যেও আপনার হিন্দুয়ানী রাখিতেন। হিন্দু পরিচারিকা দ্বারা তিনি সেবিত হইতেন, হিন্দুর পাক ভিন্ন ভোজন করিতেন না—এমন কি, ঔরঙ্গজেবের পুরীমধ্যে হিন্দুদেবতার মূৰ্ত্তি স্থাপন । করিয়া পূজা করিতেন। বিখ্যাত দেবদ্বেষী ঔরঙ্গজেব ষে এতটা সহ করিতেন, ইহাতেই বুঝা যায় যে, ঔরঙ্গজেব র্তাহাকেও একটু অনুগ্রহ করিতেন । যোধপুরী বেগম এ সংবাদ শুনিলেন । বাদশাহের সাক্ষাৎ পাইলে বিনীতভাবে বলিলেন,—“জাহাপনা ! যাহার আজ্ঞায় প্রতিদিন রাজরাজেশ্বরগণ রাজচ্যুত হইতেছে—এক সামান্ত বালিকা কি তাহার ক্রোধের যোগ্য ?” রাজেন্দ্ৰ হাসিলেন–কিন্তু কিছু বলিলেন না। . সেখানে কিছুই হইল মা । : তখন যোধপুর-রাজকন্যা মনে মনে বলিলেন,. “হে ভগবানু! আমাকে বিধৰা কর। এ রাক্ষস । আর অধিক দিন বাচিলে হিন্দুনাম লোপ হইবে।”