পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় তৃতীয় খণ্ড.djvu/২৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ষষ্ঠ সংখ্যা । ] তাহার মধ্যে রমেশের মত একজন সাধারণ লোক কোথা হইতে একদিন আণশ্বিনের পীতাভ রৌদ্রে ঐ বাতায়নে একটি বালিকার পাশে নীরবে দাড়াইয়া জীবনকে ও জগৎকে এক অপরিসীম আনন্দময় রহস্তের মাঝখানে ভাসমান দেখিল—একি বিস্ময় ! হৃদয়ের ভিতরে আজ একি বিস্ময়, হৃদয়ের বাহিরে আজ একি বিস্ময় । বিশ্বের যে নিগুঢ় অন্তস্তলে প্রাণ ও প্রেম ও সৌন্দর্য্য অনাদিকাল হইতে অহোরাত্র স্বত উৎসারিত হইয়া উঠিতেছে, সংসারের সমস্ত বন্ধন, জীবনের সমস্ত তুচ্ছতা অতিক্রম করিয়া আজ কেমন করিয়া রমেশ সেই নির্জন অমৃতনিঝরের তটে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল ! সেজন্ত রমেশ আজ রাত্রে কাহায় কাছে জীবন সমপণ করিবে, কাহার কাছে আপনাকে নত করিয়া, লুষ্ঠিত করিয়া, লুপ্ত করিয়া নিবেদন করিয়া দিবে । অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত রমেশ ছাদে বেড়tইল। ধীরে ধীরে কখন একসময়ে থও চাদ সম্মুখের বাড়ীর আড়ালে নামিয় গেল । পৃথিবীতলে রাত্রির কালিম। ঘনীভূত হইল - আকাশ তখনো বিদায়োম্মুখ আলোকের আলিঙ্গনে পা ধুবৰ্ণ । অল্প একটুখানি বাতাস জাগিয়া উঠিল—সে বাতাসে শিশিরের স্পশ জড়িত ৷ দুটো-একটা গাড়ির চাকার শব্দ শুন৷ যাহতেছে। গ্রাম হইতে তরকারীবোঝাই গাড়ি সহরের বাজারে যাত্রা করিয়াছে । রমেশের ক্লাস্ত শরীর শীতে শিহরিয়া উঠিল, হঠাৎ একটা আশঙ্কা থাকিয়াথাকিয় তাহার হৃৎপিণ্ডকে চাপিল্প ধরিতে লাগিল । মনে পড়িয়া গেল, জীবনের রণ নৌকাডুবি । ఫిఆసి ক্ষেত্রে কাল আবার সংগ্রাম করিতে বাহির হইতে হইবে। ঐ আকাশে যদিও চিস্তার রেখা নাই, জ্যোৎসার মধ্যে চেষ্টার চাঞ্চল্য নাই, রাত্রি যদিও নিস্তন্ধ শাস্ত, বিশ্বপ্রকৃতি ঐ অগণ্য নক্ষত্ৰলোকের চিরকৰ্ম্মের মধ্যে চিরবিশ্রামে বিলীন—তবু মামুষের আনাগোনাযোঝাযুঝির অন্ত নাই, মুখে-দুঃখে বাধায়-বিক্সে সমস্ত জনসমাজ তরঙ্গিত । অনন্তকালের নির্লিপ্ত ঔদাসীন্তে, অনন্ত আকাশের নিৰ্ব্বাকৃ নিস্তব্ধতায় মানবের এই ক্ষুদ্রজীবনের দুইদিনকার ক্ষোভ ও নিমগ্ন করিয়া দিতে পারিল না । একদিকে অনন্তের ঐ নিত্য শাস্তি, আর-এক দিকে সংসারের এই নিত্য সংগ্রাম— দুই একইকালে একসঙ্গে কেমন করিয়া থাকিতে পারে, দুশ্চিস্তার মধ্যেও রমেশের মনে এই প্রশ্নের উদয় হইল। কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে রমেশ বিশ্বলোকের অন্তঃপুরের মধ্যে প্রেমের যে একটি শাশ্বত সম্পূর্ণ শাস্তমূৰ্ত্তি দেখিয়াছিল, সেই প্রেমকেই ক্ষণকাল পরে সংসারের ংঘর্ষে, জীবনের জটিলতায়, পদে পদে ক্ষুব্ধক্ষুণ্ণ দেখিতে লাগিল । ইহার মধ্যে কোনটা সত্য, কোনটা মায়া । রমেশ মনে মনে কহিল, “যদি বিঘ্ন ঘটে, আশার প্রতিম। যদি চুর্ণ হইয়। যায়, জীবন যদি ব্যর্থ হইতে থাকে, তবে জগৎচরাচরের মধ্যে প্রেমের এই যে প্রশান্ত বিশ্বরূপ দেখিয়াছি—যাহাকে ভালবাসি, অনন্তের বক্ষের মধ্যে তাহার যে চিরন্তন প্রসন্নমুৰ্ত্তি দেখিয়াছি, তাহাকে ভুলিব না, ছাড়িব না, . তাহাকে সংসারের সমস্ত বিরোধ-বিচ্ছেদব্যর্থতার অন্তরালে মানসমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিব?—তাহা হইতে আমাকে কেহ বঞ্চিত করিতে পরিবে না । হে ভগবন,