জয়দেবপ্রণীত তৃতীয় কৃষ্ণ চরিত্রে এই রূপক একেবারে অদৃশ্য। তখন আর্য্যজাতির জাতীয় জীবন দুর্ব্বল হইয়া আসিয়াছে। রাজকীয় জীবন নিবিয়াছে—ধর্ম্মের বার্দ্ধক্য আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। উগ্রতেজস্বী, রাজনীতিবিশারদ আর্য্য বীরেরা বিলাসপ্রিয় এবং ইন্দ্রিয় পরায়ণ হইয়াছেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধি মার্জ্জিত চিত্ত দার্শনিকের স্থানে অপরিণামদর্শী স্মার্ত্ত এবং গৃহ সুখবিমুগ্ধ কবি অবতীর্ণ হইয়াছেন। ভারত দুর্ব্বল, নিশ্চেষ্ট, নিদ্রায় উন্মুখ, ভোগপরায়ণ। অস্ত্রের ঝঞ্জনার স্থানে রাজপুরী সকলে নুপুর নিক্বণ বাজিতেছে—বাহ্য এবং আভ্যন্তরিক জগতের নিগূঢ়তত্ত্বের আলোচনার পরিবর্ত্তে কামিনীগণের ভাবভঙ্গীর নিগূঢ় তত্ত্বের আলোচনার ধূম পড়িয়া গিয়াছে। জয়দেব গোস্বামী এই সময়ের সামাজিক অবতার; গীতগোবিন্দ এই সমাজের উক্তি। অতএব গীত গোবিন্দের শ্রীকৃষ্ণ, কেবল বিলাসরসে রসিক কিশোর নায়ক। সেই কিশোর নায়কের মূর্ত্তি, অপূর্ব্ব মোহন মূর্ত্তি; শব্দ ভাণ্ডারে যত সুকুমার কুসুম আছে, সকল গুলি বাছিয়া বাছিয়া, চতুর গোস্বামী এই কিশোর কিশোরী রচিয়াছেন; আদিরসের ভাণ্ডারে, যতগুলি স্নিগ্ধোজ্জ্বল রত্ন আছে, সকল গুলিতে ইহা সাজাইয়াছেন; কিন্তু যে মহা গৌরবের জ্যোতিঃ মহাভারতে ও ভাগবতে কৃষ্ণ চরিত্রের উপর নিঃসৃত হইয়াছিল, এখানে তাহা অন্তর্হিত হইয়াছে। ইন্দ্রিয়পরতার অন্ধকার ছায়া আসিয়া, প্রখর সুখতৃষাতপ্ত আর্য্য পাঠককে শীতল করিতেছে।
তার পর, বঙ্গদেশ যবন হস্তে পতিত হইল। পথিক যেমন বনে রত্ন- কুড়াইয়া পায় যবন সেইরূপ বঙ্গরাজ্য অনায়াসে কুড়াইয়া লইল। প্রধমে নাম মাত্র বঙ্গ দিল্লীর অধীন ছিল, পরে যবন শাসিত বঙ্গরাজ্য সম্পুর্ণরূপে স্বাধীন হইল। আবার বঙ্গ-