পাতা:বিবিধ সমালোচন (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়).pdf/১৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শকুন্তলা, মিরন্দা এবং দেসদিমোনা।
১৩৯

 তুলনীয়া, কেননা উভয়েই বীরপুরুষ দেখিয়া আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন—উভয়েরই “দুরারোহিণী আশালতা” মহামহীরুহ অবলম্বন করিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু বীরমন্ত্রের যে মোহ, তাহা দেস্‌দিমোনায় যাদৃশ পরিস্ফুট, শকুন্তলায় তাদৃশ নহে। ওথেলো কৃষ্ণকায়, সুতরাং সুপুরুষ বলিয়া ইতালীয় বালার কাছে বিচার্য্য নহে, কিন্তু রূপের মোহ হইতে বীর্য্যের মোহ নারীহৃদয়ের উপর প্রগাঢ়তর। যে মহাকবি, পঞ্চপতিকা দ্রৌপদীকে অর্জ্জুনে অধিকতন অনুরক্তা করিয়া, তাঁহার সশরীরে সর্গারোহণ পথরোধ করিয়াছিলেন তিনি এ তত্ত্ব জানিতেন, এবং যিনি দেস্‌দিমোনার সৃষ্টি করিয়াছেন তিনি ইহার গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশ করিয়াছেন।

 তুলনীয়া, কেননা দুই নায়িকারই “দুরারোহিণী আশালতা” পরিশেষে ভগ্না হইয়াছিল—উভয়েই স্বামীকর্ত্তৃক বিসর্জ্জিতা হইয়াছিলেন। সংসার অনাদর, অত্যাচার পরিপূর্ণ। কিন্তু ইহাই অনেক সময়ে ঘটে যে, সংসারে যে আদরের যোগ্য, সেই বিশেষ প্রকারে অনাদর অত্যাচারে প্রপীড়িতা হয়। ইহা মনুষ্যের পক্ষে নিতান্ত অশুভ নহে, কেন না মনুষ্যপ্রকৃতিতে যে সকল উচ্চাশয় মনোবৃত্তি আছে, এই সকল অবস্থাতেই তাহা সম্যক্ প্রকারে স্ফূর্ত্তিপ্রাপ্ত হয়। ইহা মনুষ্যলোকে সুশিক্ষার বীজ—কাব্যের প্রধান উপকরণ। দেসদিমোনার অদৃষ্টদোষে বা গুণে সে সকল মনোবৃত্তি স্ফূর্ত্তিপ্রাপ্ত হইবার অবস্থা তাহার ঘটিয়াছিল। শকুন্তলারও তাহাই ঘটিয়াছিল। অতএব দুইটি চরিত্র যে পরস্পর তুলনীয়া হইবে, ইহার সকল আয়োজন আছে।

 এবং দুইজনে তুলনীয়া, কেন না উভয়েই পরম স্নেহশালিনী—উভয়েই সতী। স্নেহশালিনী, এবং সতী ত যে সে।