পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০৩
মহরম পর্ব্ব—চতুর্বিংশ প্রবাহ

সেই ছিন্ন মস্তক আবদুল ওহাবের মাতার সম্মুখে গিয়া পড়িল। বীরজননী পুত্রশির ক্রোড়ে লইয়া ত্রস্তে শিবিরে আসিয়া নির্জ্জনকক্ষে হোসেনের সম্মুখে রাখিয়া দিলেন। এই অবসরে আবদুল ওহাবের শিক্ষিত অশ্ব শিরশূন্য দেহ লইয়া অতি বেগে শিবিরের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল।সকলের সম্মুখে শিরশূন্য দেহ অশ্বপৃষ্ঠ হইতে মৃত্তিকায় পড়িয়া গেল। আবদুল ওহাবের মাতা শোণিতাক্ত হস্ত উত্তোলন করিয়া ঈশ্বর সমীপে প্রার্থনা করিলেন এবং আবদুল ওহাবের উদ্দেশে আশীর্ব্বাদ করিলেন,—“আবদুল ওহাব! তুমি ঈশ্বরকৃপায় স্বর্গীয় সুখভোগে সুখী হও। হোসেনের বিপদ-সময়ে তুমি প্রাণ দিয়া সাহায্য করিলে, প্রভু মোহাম্মদের বংশধরগণের পিপাসার শান্তিহেতু কাফের হস্তে জীবন বিসর্জ্জন করিলে, তোমায় শত শত আশীর্ব্বাদ! তুমি যে জননীর গর্ভে জন্মিয়াছিলে, তাঁহারও সার্থক জীবন! তোমার মস্তক দেহ হইতে কে বিচ্ছিন্ন করিল?” আবদুল ওহাবের মাতা পুত্রের ছিন্ন মস্তকটি লইয়া পতিত দেহে সংলগ্ন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “আবদুল ওহাব! বৎস! প্রাণাধিক! অশ্ব সজ্জিত আছে, তোমার হাতের অস্ত্র হাতেই রহিয়াছে, বিধর্ম্মীর রক্তে অস্ত্র রঞ্জিত করিয়াছ, তবে আর ধূলায় পড়িয়া কেন? বাছা! দুঃখিনীর জীবন-সর্ব্বস্ব! উঠিয়া অশ্বে আরোহণ কর। এইবার যুদ্ধক্ষেত্র হইতে ফিরিয়া আসিলে আর আমি তোমাকে যুদ্ধে পাঠাইব না। ঐ দেখ, তোমার অর্দ্ধাঙ্গরূপিণী বণিতা তোমার যুদ্ধবিজয়-সংবাদ শুনিবার জন্য উৎকণ্ঠিত কর্ণে সতৃষ্ণনয়নে আক্ষেপ করিতেছে!”

 আবদুল ওহাবের বিয়োগে হোসেন কাঁদিলেন। হোসেনের পরিজন বর্গ ডাক ফুক্‌রাইয়া দিলেন। আবদুল ওহাবের মাতা অশ্রুনয়নে রোষভরে বলিতে লাগিলেন, “আবদুল ওহাব! এত ডাকিলাম, উঠিলে না; তোমার মায়ের কথা আর শুনিলে না!” শোকাবেগে এই কথা বলিয়া বৃদ্ধ পুনরায় পুত্রমস্তক বক্ষে ধারণ করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, আমার পুত্রহন্তা কে? আবদুল ওহাব কাহার হস্তে জীবন বিসর্জ্জন করিল। কে আমার আবদুল ওহাবের মস্তক আমার ক্রোড়ে আনিয়া নিক্ষেপ করিল? দেখি, দেখি—দেখিব, দেখিব!” বলিয়া আবদুল ওহাব-জননী তখনি ত্বরিত