পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/২৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৩১
মহরম পর্ব্ব—ষড়বিংশ প্রবাহ

জলের পরিষ্কার স্নিগ্ধভাব দেখিয়া তিনি ইচ্ছা করিলেন যেন, এককালে নদীর সমুদয় জল পান করিয়া ফেলেন। অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলিয়া মুখে দিবেন, এমন সময় তাহার সমুদয় কথা মনে পড়িল। আত্মীয়-বন্ধুর কথা মনে পড়িল, কাসেমের কথা মনে পড়িল, আলী আক্‌বর প্রভৃতির কথা মনে পড়িল, পিপাসার্ত্ত দুগ্ধপোষ্য শিশুর কথাও মনে পড়িল। এক বিন্দু জলের জন্য ইহারা কত লালায়িত হইয়াছে, কাতরতা প্রকাশ করিয়াছে, কত কষ্টভোগ করিয়াছে। এই জলের নিমিত্তই আমার পরিজনেরা পুত্রহারা, পতিহারা, ভ্রাতৃহারা হইয়া মাথা ভাঙ্গিয়া মরিতেছে, আমি এখন শত্রুহস্ত হইতে ফোরাতকূল উদ্ধার করিয়া সর্বাগ্রেই নিজে সেই জলপান করিব!—নিজের প্রাণ পরিতৃপ্ত করিব!—আমার প্রাণের মায়াই কি এত অধিক হইল? ধিক্‌ আমার প্রাণে!-এই জলের জন্য আলী আক্‌বর আমার জিহবা পর্য্যন্ত চুষিয়াছে! এক পাত্র জল থাকিলে আমার বংশের উজ্জ্বল মণি, মহাবীর কাসেম আজ শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করিত না। এখনও যাহার জীবিত আছে, তাহারা ত শোকতাপে কাতর হইয়া পিপাসায় মৃতবৎ হইয়া রহিয়াছে। এ জল আমি কখনই পান করিব না,—ইহজীবনেও আর পান করিব না।”—এই কথা বলিয়া হস্তস্থিত জল নদীগর্ভে ফেলিয়া দিয়া তিনি তীরে উঠিলেন। কি ভাবিলেন, তিনিই জানেন। একবার আকাশের দিকে লক্ষ্য করিয়া পবিত্র শিরস্ত্রাণ শির হইতে দূরে নিক্ষেপ করিলেন; দুই এক পদ অগ্রসর হইয়াই কোমর হইতে কোমরবন্ধ খুলিয়া দূরে ফেলিয়া দিলেন, সেই পবিত্র মোজা আর পায়ে রাখিলেন না। ভ্রাতৃশোক, পুত্রশোক, সকল শোক একত্রে আসিয়া তাহাকে যেন দগ্ধ করিতে লাগিল। কি মনে হইল, তাহাতেই বোধ হয়, পরিহিত পায়জামামাত্র অঙ্গে রাখিয়া আর আর সমুদয় বসন খুলিয়া ফেলিলেন। অস্ত্রশস্ত্র দূরে নিক্ষেপ করিয়া তিনি ফোরাত স্রোতের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। হোসেনের অশ্ব প্রভুর হন্ত, পদ ও মস্তক শুন্য দেখিয়াই যেন মহাকষ্টে দুই চক্ষু হইতে অনবরত বাষ্পজল নির্গত করিতে লাগিল। আবদুল্লাহ, জেয়াদ, ওমর, সীমার, আর কয়েকজন সৈনিক যাহারা জঙ্গলে লুকাইয়াছিল, তাহারা দূর হইতে দেখিল যে, এমাম্‌