পাতা:বিষাদ-সিন্ধু - মীর মোশার্‌রফ হোসেন.pdf/৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিষাদ-সিন্ধু
৪০

 হাসান সন্ধ্যাকালীন উপাসনা সমাধা করিয়া তস্‌বীহ্ (জপমালা) হস্তে উপাসনা-মন্দির সম্মুখে পদচালনা করিয়া ঈশ্বরের নাম জপ করিতেছেন, এমন সময় একজন ফকির জাতীয় প্রথানুসারে অভিবাদন করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। ফকিরের মলিন বেশ, শতগ্রন্থিযুক্ত পরিধান, মলিন বস্ত্রে শির আবৃত, গলায় প্রস্তরের তস্‌বীহ্, হস্তে কাষ্ঠযষ্ঠি। হাসানের কিঞ্চিৎদূরে দণ্ডায়মান হইয়া সেই বৃদ্ধ বলিলেন; “প্রভো! আমি একটি পর্ব্বতের উপর বসিয়াছিলাম। দেখি যে, একজন কাসেদ আসিতেছে। হঠাৎ ঈশ্বরের নাম করিয়া সেই কাসেদ ভূতলে পতিত হইল। কারণ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। নিকটস্থ হইয়া দেখি যে, একটি লৌহশর তাহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিয়া পৃষ্ঠদেশ পার হইয়া, কঠিন প্রস্তরখণ্ড বিদ্ধ করিয়াছে। শোণিতের ধারা বহিয়া চলিতেছে। কোথা হইতে কে শরনিক্ষেপ করিল! লঘুহস্তে শরনিক্ষেপ এমন সুনিপুণ যে, এক বাণে পথিকের হৃদয় বিদ্ধ করিয়া পৃষ্ঠ পর্য্যন্ত ভেদ করিল। তখনও তাহার প্রাণবিয়োগ হয় নাই। অস্ফুট স্বরে দুই একটি কথা যাহা শুনিলাম, আর ভাবেও যাহা বুঝিতে পারিলাম, তাহার মর্ম্ম এই যে, হজরত মাবিয়া আপনার নিকট কাসেদ পাঠাইয়াছিলেন। তিনি অত্যন্ত পীড়িত, বাঁচিবার ভরসা অতি কম। জীবনের শেষ দেখাশুনার জন্যই আপনাকে সংবাদ দিতে, বোধ হয়, কাসেদ আসিতেছিল। আমি দ্রুতগামী অশ্বের পদধ্বনি শুনিয়া সম্মুখে লক্ষ্য করিলাম। দেখিলাম, এজিদ অশ্বোপরি বীরসাজে ধনুহস্তে বেগে আসিতেছে; পৃষ্ঠের বাম পার্শ্বে তুণীর ঝুলিতেছে। দেখিয়াই পর্ব্বতের আড়ালে লুকাইলাম। আড়াল হইতে দেখিলাম, এজিদ অশ্ব হইতে নামিয়া পথিকের কটিবদ্ধ খুলিয়া একখানি পত্র লইয়া অশ্বে কশাঘাত করিতে করিতে চক্ষুর অগোচর হইল। আপনার নিকট সেই সংবাদ দিতে আসিয়াছি। আর আমার কোন কথা নাই।”—এই বলিয়া আগন্তুক ফকির পুনরভিবাদন করিয়া একটু দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

 হাসান ভাবিতে লাগিলেন: ফকির কে? কেনই বা আমাকে এ সংবাদ দিতে আসিয়াছিল? কথার স্বর ও মুখচ্ছবি একেবারে অপরিচিত বলিয়াও বোধ হইল না। অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত ফকিরের বিষয় চিন্তা করিয়া তিনি শেষে