পাতা:বেগম রোকেয়া রচনাবলী.pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অবলাগণ অত্যন্ত নিবিষ্টচিত্তে বিজ্ঞান আলোচনা আরম্ভ করিলেন। এই সময় রাজধানীর একতর বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলা প্রিন্সিপ্যাল একটি অভিনব বেলুন নির্মাণ করিলেন, এই বেলুনে কতকগুলি নল সংযোগ করা হইল। বেলুনটি শূন্যে মেঘের উপর স্থাপন করা গেল—বায়ুর আর্দ্রতা ঐ বেলুনে সংগ্রহ করিবার উপায় ছিল—এইরূপে জলধরকে ফাঁকি দিয়া তাঁহারা বৃষ্টিজল করায়ত্ত করিলেন। বিদ্যালয়ের লোকেরা সর্বদা ঐ বেলুনের সাহায্যে জলগ্রহণ করিত কি না, তাই আর মেঘমালায় আকাশ আচ্ছন্ন হইতে পারিত না। এই অদ্ভুত উপায়ে বুদ্ধিমতী লেডি প্রিন্সিপ্যাল প্রাকৃতিক ঝড়বৃষ্টি নিবারণ করিলেন।’

 ‘বটে? তাই আপনাদের এখানে পথে কর্দম দেখিলাম না।’ কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝিতে পারিলাম না—নলের ভিতর বায়ুর আর্দ্রতা কিরূপে আবদ্ধ থাকিতে পারে; আর ঐরূপে বায়ু হইতে জল সংগ্রহ করাই বা কিরূপে সম্ভব। তিনি আমাকে ইহা বুঝাইতে অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু আমার যে বুদ্ধি—তাহাতে আবার বিজ্ঞান রসায়নের সঙ্গে আমাদের (অর্থাৎ মোসলেম ললনাদের) কোনো পুরুষে পরিচয় নাই। সুতরাং ভগিনী সারার ব্যাখ্যা কোনোমতেই আমার বোধগম্য হইল না। যাহা হউক তিনি বলিয়া যাইতে লাগিলেন।

 ‘দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই জলধর বেলুন দর্শনে অতীব বিস্মিত হইল—অতিহিংসায়[১] তাহার উচ্চাকাঙ্ক্ষা সহস্রগুণ বর্ধিত হইল। প্রিন্সিপ্যাল মনস্থ করিলেন যে, এমন কিছু অসাধারণ বস্তু সৃষ্টি করা চাই, যাহাতে কাদম্বিনী বিজয়ী বিদ্যালয়কে পরাভূত করা যায়। তাঁহারা অল্পকাল মধ্যে একটি যন্ত্র নির্মাণ করিলেন, তদ্বারা সূর্যোত্তাপ সংগ্রহ করা যায়। কেবল ইহাই নহে, তাঁহারা প্রচুর পরিমাণে ঐ উত্তাপ সংগ্রহ করিয়া রাখিতে এবং ইচ্ছামতো যথাতথা বিতরণ করিতে পারেন।

 ‘যৎকালে এদেশের রমণীবৃন্দ নানাবিধ বৈজ্ঞানিক অনুশীলনে নিযুক্ত ছিলেন, পুরুষেরা তখন সৈনিক বিভাগের বলবৃদ্ধির চেষ্টায় ছিলেন। যখন নরবীরগণ শুনিতে পাইলেন যে, জেনানা বিশ্ববিদ্যালয়দ্বয় বায়ু হইতে জল গ্রহণ করিতে এবং সূর্যোত্তাপ সংগ্রহ করিতে পারে, তাহারা তাচ্ছিল্যের ভাবে হাসিলেন। এমনকি তাঁহারা বিদ্যালয়ের সমুদয় কার্যপ্রণালীকে ‘স্বপ্নকল্পনা’ বলিয়া উপহাস করিতেও বিরত হন নাই।’

 আমি বলিলাম, ‘আপনাদের কার্যকলাপ বাস্তবিক অত্যন্ত বিস্ময়কর। কিন্তু এখন বলুন দেখি, আপনারা পুরুষদের কী প্রকারে অন্তঃপুরে বন্দি করিলেন? কোনোরূপ ফাঁদ পাতিয়াছিলেন নাকি?’

 ভগিনী বলিলেন, ‘না’।

 ‘তাঁহারা যে নিজে ধরা দিবেন ইহাও তো সম্ভব নয়। মুক্ত স্বাধীনতায় জলাঞ্জলি দিয়া স্বেচ্ছায় চতুষ্প্রাচীরের অভ্যন্তরে বন্দি হইবে কোন্ পাগল? তবে অবশ্যই পুরুষেরা কোনোরূপে আপনাদের দ্বারা পরাভূত হইয়াছিলেন।’

 ‘হাঁ, তাই বটে’!

 ‘কে প্রথমে পুরুষ-প্রবরদের পরাভূত করিল—সম্ভবত কতিপয় নারীযোদ্ধা?’

  1. হিংসা বৃত্তিটা কি বাস্তবিক বড় দোষণীয়? কিন্তু হিংসা না থাকিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছা হয় কই? এই হিংসাই তো মানবকে উন্নতির দিকে আকর্ষণ করে। তবে দেশকাল ভেঙে ঈর্ষায় পতন হয়, সত্য। তা যে-কোনো মনোবৃত্তির মাত্রাধিক্যেই অনিষ্ট হয়; সকল বিষয়েরই সীমা আছে।

■ ১০৯ ■