বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী
৩০৭

গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ

কত দিন, কত মাস, কত বৎসর অতীত হইল, আজিও বঙ্গদেশে গঙ্গাগোবিন্দের নাম সমান ভাবেই চলিয়া আসিতেছে! ইংরেজরাজত্বের ভিত্তিস্থাপনের সময়ে যাঁহার কূটমন্ত্রে সমগ্র বঙ্গরাজ্যের শাসননীতি পরিচালিত হইয়াছিল, তাহার নাম যে চিরদিনই অক্ষুণ্ণভাবে বিরাজ করিবে, তাহাতে আর সন্দেহ কি? মানুষ দুই ভাবে অক্ষয় হয়। কেহবা কুনামে, কেহবা সুনামে। রাবণ, দুৰ্যোধন, নিরো, চতুর্দশ লুই, ইঁহাদের নাম আজিও ধরণীপৃষ্ঠ হইতে মুছিয়া যায় নাই, এবং রাম, যুধিষ্ঠির ও আকবরের নামও অদ্যাপি উজ্জ্বলভাবে অঙ্কিত রহিয়াছে। ওয়ারেন হেস্টিংস ও ডালহৌসির নাম ভারতের অস্থিমজ্জায় বিঁধিয়া আছে, আবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে কেহ কখনও লর্ড কর্নওয়ালিস্ ও লর্ড রিপনকে বিস্মৃত হইতে পারিবেন না। যতদিন পর্যন্ত বাঙ্গলায় জমিদারী প্রথা প্রচলিত রহিবে, ততদিন গঙ্গাগোবিন্দের নামও অক্ষয় হইয়া থাকিবে। শত বৎসর পূর্বে যাঁহারা বাঙ্গলার জমিদারী উপভোগ করিয়াছিলেন, তাঁহদের বংশধরদিগের এক্ষণে নিতান্ত অভাব নাই। তাঁহদের অণুপরমাণুতে গঙ্গাগোবিন্দের নাম মিশিয়া আছে।

 সুভাবেই হউক বা কুভাবেই হউক, গঙ্গাগোবিন্দের নিকট তৎকালীন জমিদারদিগের সকলকেই মস্তক অবনত করিতে হইত। বাঙ্গলার শীর্ষস্থানীয় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র চতুর্দিক অন্ধকারময় দেখিয়া, “ভরসা কেবল গঙ্গাগোবিন্দ” বলিয়া আপনাকে রক্ষা করিতে সমর্থ হন। এইরূপ সেই সময়ের প্রত্যেক জমিদার ও ভূস্বামী গঙ্গাগোবিন্দের মনস্তুষ্টির জন্য সর্বদা সচেষ্ট হইতেন। যাঁহার একটু সামান্য ভূমিমাত্র ছিল, তাঁহাকেও 'দেওয়ানজীকে' সন্তুষ্ট রাখিতে হইয়াছিল। লোকে দেশের শাসনকর্তা গবর্নর জেনারেল বাহাদুরকে যেরূপ সম্মান না দেখাইত, দেওয়ানজীকে তদপেক্ষা অধিক দেখাইতে হইত। তাহারা জানিত যে, গঙ্গাগোবিন্দের প্রসাদের উপর তাহাদের জীবনমরণ নির্ভর করিতেছে; অথবা সমস্ত ইংরেজরাজত্ব পরিচালিত হইতেছে। এ কথার মধ্যে যে অধিকাংশই সত্য, তাহা অস্বীকার করা যায় না। গঙ্গাগোবিন্দের সহিত গবর্নর হেস্টিংসের এরূপ একাত্মতা ছিল যে, লোকে তাহদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করিয়া উঠিতে পারিত না। হেস্টিংস নিজমুখে গঙ্গাগোবিন্দকে আপনার বিশ্বাসী বন্ধু বলিয়া উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। মহামতি বার্ক গঙ্গাগোবিন্দকে দেবীসিংহের ন্যায় নিষ্ঠুর বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি ইংলণ্ডের মহাসভায় এইরূপ বলিয়াছিলেন যে, গঙ্গাগোবিন্দের নামে সমস্ত ভারতবাসী বিবর্ণ হইয় উঠে এবং ভারতের ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের মধ্যে ইঁহার ন্যায় দুর্বৃত্ত, দুর্দান্ত, নিৰ্ভীক ও শঠ কখন দেখা যায় নাই। আমরা কিন্তু তাহাকে সেরূপ শয়তানপদ-


১ “A name at the sound of which all India turns pale—the most wicked, the most atrocious, the boldest, the most dexterous villain that ever the rank servitude of that country has produced.” (Burke's Impeachment of W. H., Vol. I, p. 164.)