পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/৪০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংসার নাই; পাস্তকে ভিন্ন অন্য স্থানে লক্ষ্য করি নাই। বিদ্যানরোগও সেইরপ। কলিকাতায় আসিবার পাবে আমি প্রকৃত বিদ্যানরোগ কাহাকে বলে জানিতাম না, কেবল জ্ঞান আহরণের জন্য, স্বদেশবাসীদিগের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ জন্য, যৌবন হইতে মধ্য বয়স পৰ্য্যন্ত, মধ্য বয়স হইতে বাদ্ধক্য পয্যন্ত অনন্ত অবারিত পরিশ্রম, তাহা কলিকাতায় দেখিলাম। আর প্রকৃত যশে অভিরুচি, জীবন পণ করিয়া সৎকায্যের দ্বারা মহত্ত্বলাভ করিতে দন্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা ও অধ্যবসায়, ইহা পল্লীগ্রামে কোথায় দেখিব ? ইহাও কলিকাতায় দেখিলাম। শরৎ, আমি কলিকাতার শত শত সদগণে দেখিয়াছি। কিন্তু যেখানে একটী সদগণ আছে, সেইখানে তাহার দশ প্রকার মিথ্যা অনুকরণ আছে, যদি দশজন প্রকৃত দেশহিতৈষী থাকেন, একশতজন দেশহিতৈষীর নাম লইয়া চীৎকার ও ভন্ডামি করিতেছেন, দশজন প্রকৃত সমাজ-সংরক্ষণে যত্নশীল, শতজন সেই সদগণের নামে শত প্রকার প্রতারণার দ্বারা পয়সা রোজগার করিতেছে। এইটী প্রকৃত দোষের কথা । শরৎ। সে দোষ তাহদের, না আমাদের ? বিন্দ দিদি, তোমার এ মাদরে ছারপোকা আছে । বিন্দর। সে কি শরৎবাবু, কামড়াচ্ছে নাকি ? শরৎ । না কামড়ায়নি, জিজ্ঞেসা করছি আছে কি না ? বিন্দর। না শরৎবাবন, আমার বাড়ীতে অমন জিনিসটী নেই। আমি নিজের হাতে প্রত্যহ বিছানা মাদর রোদে দি, জিনিসপত্র ঝাড়ঝোড় করি। নোংরা আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। শরৎ । সে দিন হেমবাব আর আমি দেবীপ্রসন্নবাবরে বাড়ীতে গিয়েছিলাম, বাড়ীর ভিতর আমাদের খেতে নিয়ে গিয়েছিল; তা তাঁদের মাদরে এমন ছারপোকা যে বসা যায় না। তার কারণ কি বিন্দ দিদি ? বিন্দর। কারণ আর কি, নোংরা, অপরিস্কার। জিনিসপত্র নোংরা রাখলেই ঐগুলো জলমায় ৷ শরৎ । বিন্দরদিদি, আমরাও সেইরুপ সমাজ অপরিস্কার রাখলেই তাতে প্রতারণার কীটগলা জন্মায়। আমরা যদি পরনিন্দা ইচ্ছা করি, পরনিন্দা বাজারে বিক্রয় হইবে। আমরা যদি পাণ্ডিত্যাভিমানীর মুখতায় মন্ধে হইয়া হাঁ করিয়া থাকি, সেই মুখতাই বিদ্যারাপে বিক্রয় হইবে। ওঠে বিদ্যমান দেশহিতৈষিতায় যদি আমরা পুলকিত হই, সেইরুপ দেশহিতৈষিতার ছড়াছড়ি হইবে। চিনাবাজারে যখন যেরপে কাপড় লোকের পছন্দ হয়, সেই সময়ে সেইরাপ কাপড়ের মল্যে অধিক হয়, আমদানি অধিক হয়। আমাদেরও যেরপে সদগণে পছন্দ ও রুচি, সেইরাপ ভূরি ভুরি উৎপন্ন হইতেছে। এটী তাহদের দোষ, না আমাদের দোষ ? বিন্দন। আচ্ছা, সে কথা বুঝলেম । কিন্তু মাদরে ছারপোকা হলে মাদর রোদে দিতে পারি, মশারি বা বিছানায় কীট থাকলে তা ধোপার বাড়ী দিতে পারি। সমাজে এরুপ কীট উৎপন্ন হলে তার কি উপায় ? সমাজ কি ধোপার বাড়ী পাঠান যায়, না রোদে দেওয়া যায় ? শরৎ । বিন্দ দিদি, সমাজ পরিকার করিবারও উপায় আছে। সয্যের আলোকে যেরপে মাদরের ছারপোকাগুলি সড় সড় করিয়া বাহির হইয়া যায়, প্রকৃত শিক্ষার আলোকে সমাজের অনিষ্টকর সামগ্রীগুলিও একে একে সমাজ পরিত্যাগ করিয়া অন্ধকারে বিলীন হয়। যদি শিক্ষায় সে ফল না ফলে, তাহা হইলে সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা নহে। ওঠস্থ দেশহিতৈষিতায় যদি আমরা মন্ধে না হই, তবে সেরুপ দ্রব্য কত দিন উৎপন্ন হয় ? পাণ্ডিত্যাভিমানী মুখতা দেখিলে যদি আমরা সহস্যে তথা হইতে প্রস্থান করি, তবে সে সামগ্রী কত দিন বিরাজ করে ? এ সমস্ত মেকি সামগ্রী যে এখন এত পরিমাণে উৎপন্ন হয়, সে আমাদের শিক্ষার দোষে, তাহাদের দোষে নহে। হেম। শরৎ, তোমার উৎসাহ দেখিয়া আমি আনন্দিত হইলাম, কিন্তু তথাপি শিক্ষাগণে সমাজ হইতে প্রতারণা বা প্রবঞ্চনা একেবারে লোপ হইবে এরপে আমার আশা নাই। শিক্ষিত দেশে যতদর প্রতারণা আছে, আমাদের দেশে তত নাই, মনুষ্য-হৃদয়ে যতদিন সুপ্রবত্তি ও কুপ্রবত্তি উভয়ই থাকিবে, জগতে তত দিন ধৰ্ম্মাচরণ ও প্রতারণা উভয়ই থাকিবে, তথাপি প্রকৃত শিক্ষাগণে সমাজে কৰ্ত্তব্য-সাধন-বাসনা ক্রমে বিস্তত হয়, তাহা আমাদেরও বোধ হয়। বিন্দ। তা আজকাল তোমাদের কালেজে যে লেখাপড়া হয় তাতে কি এ শিক্ষা দেয় না? ○ や 。 ૨8