পাতা:সংস্কৃতি কথা - মোতাহের হোসেন চৌধুরী.pdf/২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪
সংস্কৃতি-কথা

মিলিটারি কণ্ট্রাক্টারের খাতায় নাম লেখানোর দরুন পাদ্রি ওয়াট্‌সন সাহেব যা বলেছিলেন তা এখানে মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন: কবিত্বের প্রবণতাসম্পন্ন মানুষের পক্ষে কণ্ট্রাক্টার হওয়া অপরাধ, মহা অপরাধ। নিজের প্রতিভাকে মরতে দেওয়া আর নিজের আত্মাকে মরতে দেওয়া এক কথা। তুমি নিজেকে মরতে দিতে পার, কিন্তু নিজের আত্মাকে মরতে দিতে পার না। যে-পেশা গ্রহণ করলে তোমার সূক্ষ্ম অনুভূতি ও সৌন্দর্য-বোধ ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা, তুমি সে-পেশা গ্রহণ করেছ শুনে আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি চাই তুমি না খেয়ে মর তথাপি তোমার সূক্ষ্মঅনুভূতিকে বাঁচিয়ে রাখ, কেননা সূক্ষ্মঅনুভূতিরই অপর নাম আত্মা। তুমি বলবে তোমার সামান্য প্রতিভা, আর little genius is a great bondage- সামান্য প্রতিভা, কঠিন বন্ধন। কিন্তু সামান্য হলেও তা মূল্যবান। আর যা মূল্যবান তার যত্ন না নেওয়া মহাপাপ। বুঝলে? কথায় বলে ভালো লোকদের ভাত নেই। তোমার ভাত না থাক, কিন্তু ভালোত্ব বজায় থাক, এই আমার কামনা।

 তখনো মার্কসের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ হয় নি। তাই কথাটা শুনে খুশী হয়ে ঘরে ফিরে এলাম, কোনো তর্ক না করে। এখনো মাঝে মাঝে আমার সেই বোকামিকে আমি চুমু খাই। কেননা আমি জানি খুশী হওয়ার জন্যে বোকা হওয়ার প্রয়োজন আছে। বাইবেলের ভাষাটা একটু বদলে দিয়ে বলা যায়: Blessed are the simple hearted for they shall be happy.[১]

 এখন এই যে মূল্যবোধ, এই যে সূক্ষ্মঅনুভূতি আর আত্মাকে এক করে দেখার প্রবৃত্তি একি ধর্মের দান, না কাল্‌চারের কীর্তি? কই সচরাচর তো ধার্মিকের মুখে এ ধরনের সুন্দর কথা শুনতে পাওয়া যায় না। তার কাছে তো আল্লার হুকুম আর বেহেশত দোজখই বড় হয়ে ওঠে, সূক্ষ্মঅনুভূতির কথা নয়। সূক্ষ্মঅনুভূতি কাল্‌চারের দান। Human value সম্বন্ধে কাল্‌চারই মানুষকে সচেতন করে। তবে কাল্‌চার্ড মানুষ ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে কেন? উত্তর, আরামের জন্য। একটা বিশ্বাসের আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে সহজে জীবন যাপন করা যায় বলেই তিনি তা করেন। যে-ধর্মকে তিনি আশ্রয়রূপে গ্রহণ করেন তাতে তিনি নিজেরই কাল্‌চার্ড মনের প্রতিবিম্ব দেখতে পান, এবং দেখতে পেয়ে ঘোষণা করে বেড়ান: দেখো, দেখো এখানে সব আছে, এখানে এসো; কাল্‌চার্ড মনের উপযোগী ধর্ম যদি কোথাও থেকে থাকে তবে তা এখানে, এখানে, এখানে। ব্যাপারটা যে মোটের উপর তাঁরি মনের প্রতিফলন, বাইরের তেমন কিছু নয়, তা তিনি টের পান না। প্রেমিক যেমন নিগ্রো মেয়ের ভুরুতেও হেলেনীয় সৌন্দর্য দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হয়ে থাকে, এখানেও তেমনি একটা ব্যাপার ঘটে। তা তিনি মুগ্ধ হয়ে থাকুন কিন্তু তাঁর ‘সুন্দরী’কে অপরেও সুন্দর বলুক, এমনি একটা গোঁয়ার্তুমি যেন তাঁকে পেয়ে না বসে, এই আমাদের প্রার্থনা।

 সংস্কৃতি মানে জীবনের Value[২] সম্বন্ধে ধারণা। ধর্মের মতো মতবাদ বা আদর্শও


  1. এর কিছুদিন পরে আমার এক ধার্মিক বন্ধুকে বল্লাম: দেখুন তো খ্রীষ্টান পাদ্রীরা কি সুন্দর কথা বলেন, আমাদের মৌলবী সাহেবদের তো এমন সুন্দর কথা বলতে শোনা যায় না। উত্তরে বন্ধুটি বললেন: বোকা কোথাকার, ওদের পাদ্রীদের যে কাল্‌চার আছে। আমাদের মৌলবী সাহেবদের তা কোথায়? ব্যস্, আমার বোকামীর পুরস্কারটি হাতে হাতে পেয়ে গেলাম: কাল্‌চারই সৌন্দর্যের কারণ, অন্য কিছু নয়, তা প্রমাণিত হয়ে গেল।
  2. অনেকে বলেন হায়ার ভ্যালু, কিন্তু হায়ার ভ্যালু বলে কোনো কথা থাকা উচিত নয়। কেননা, ‘ভ্যালু’ জিনিসটা নিজেই একটা ‘হায়ার’ কিছু, সুতরাং হায়ার কথাটা ফাজিল, অতিরিক্ত।