বিষয়বস্তুতে চলুন

জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ/গঠনমূলক স্বদেশসেবা

উইকিসংকলন থেকে

গঠনমূলক স্বদেশ সেবা

 ১৯০৮ সালে পাবনায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের সভাপতিরূপে রবীন্দ্রনাথ যে অভিভাষণ দেন, একাধিক কারণে তাহার বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য। ইতিপূর্বে যাঁহারা ঐ সম্মেলনের সভাপতি হইয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই ইংরেজী ভাষায় বক্তৃতা করেন। বাঙলার রাষ্ট্রক্ষেত্রে বাঙালীর মাতৃভাষা তখনও ‘জাতে উঠে নাই’। ইহা আজিকার দিনে অদ্ভুত শুনাইলেও দুর্ভাগ্যক্রমে ঐরূপই ঘটিয়াছিল। রবীন্দ্রনাথই প্রথম রাষ্ট্র সম্মেলনে বাঙলা ভাষায় সভাপতির বক্তৃতা করেন। সেই হইতেই রাজনৈতিক আন্দোলনে বাঙলা ভাষা তাহার নিজস্ব স্থান অধিকার করিয়াছে বলিলে অত্যুক্তি হয় না।

 দ্বিতীয়ত, এই সময় হইতেই জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণরূপে বদলাইয়া গেল। স্বদেশী আন্দোলনের পূর্বে ১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ “স্বদেশী সমাজ” নামক যে বক্তৃতা করেন, তাহার কথা পূর্বেই বলিয়াছি। এই বক্তৃতার মধ্যেই তাঁহার এই নূতন দৃষ্টিভঙ্গীর সূচনা ছিল। স্বদেশী আন্দোলনের প্রবল আলোড়নের সঙ্গে যোগ দিলেও কবি তাঁহার স্বদেশ সেবায় ঐ নিজস্ব ভাব ও আদর্শ কখনই বিস্মৃত হন নাই। স্বদেশী আন্দোলনের সমুদ্রমন্থনে কেবল অমৃত ও লক্ষ্মীই উঠেন নাই, হলাহলও উত্থিত হইয়াছিল। কাহারা নীলকণ্ঠ মৃত্যুঞ্জয়ের মতো সেই হলাহল পান করিয়াছিল, সেকথা এখানে আলোচনা করিব না। ১৯০৮ সালের পর রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ্য রাজনৈতিক আন্দোলন হইতে অন্তরালে সরিয়া গেলেন এবং গঠনমূলক কার্যে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করিলেন। তৎপূর্বে ১৯০৭ সালেই “ব্যাধি ও প্রতিকার” প্রবন্ধে তিনি লিখিয়াছিলেন,—“দেশের যে সকল যুবক উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছেন, তাঁহাদের প্রতি একটি মাত্র পরামর্শ এই আছে,—সমস্ত উত্তেজনাকে নিজের অস্থিমজ্জার মধ্যে নিস্তব্ধভাবে আবদ্ধ করিয়া ফেল, স্থির হও, কোনো কথা বলিও না, অহরহ অত্যুক্তি প্রয়োগের দ্বারা নিজের চরিত্রকে দুর্বল করিয়ো না। আর কিছু না পার খবরের কাগজের সঙ্গে নিজের সমস্ত সম্পর্ক ঘুচাইয়া। যে কোনো একটি পল্লীর মাঝখানে বসিয়া, যাহাকে কেহ কোনদিন ডাকিয়া কথা কহে নাই তাহাকে জ্ঞান দাও, আনন্দ দাও, আলো দাও, তাহার সেবা কর, তাহাকে জানিতে দাও, মানুষ বলিয়া তাহার মাহাত্ম্য আছে—সে জগৎ সংসারের অবজ্ঞার অধিকারী নহে। অজ্ঞান তাহাকে নিজের ছায়ার কাছেও স্তব্ধ করিয়া রাখিয়াছে; সেই সকল ভয়ের বন্ধন ছিন্ন করিয়া তাঁহার বক্ষপট প্রশস্ত করিয়া দাও, তাহাকে অন্যায় হইতে, অনশন হইতে, অন্ধ সংস্কার হইতে রক্ষা কর।”

 এই সময়েই “প্রবাসী”তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁহার প্রসিদ্ধ “গোরা” উপন্যাসেও বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়া এই গঠনমূলক স্বদেশসেবার আদর্শই তিনি ব্যক্ত করেন।

 পাবনায় প্রাদেশিক সম্মেলনের অভিভাষণে তিনি সেই কথাটাই আরও স্পষ্টভাবে বলেন—

 “দেশের গ্রামগুলিকে নিজের সর্বপ্রকার প্রয়োজনসাধনক্ষম করিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে। কতকগুলি পল্লী লইয়া এক একটি মণ্ডলী স্থাপিত হইবে। সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কার্যের ভার এবং অভাব মোচনের ব্যবস্থা করিয়া মণ্ডলীটিকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করিয়া তুলিতে পারেন, তবেই স্বায়ত্ত সম্মেলনের চর্চা দেশের সর্বত্র সত্য হইয়া উঠিবে। নিজেদের পাঠশালা, শিক্ষালয়, ধর্মগোলা, সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যাঙ্ক স্থাপনের জন্য ইহাদিগকে শিক্ষা, সাহায্য ও উৎসাহ দান করিতে হইবে। প্রত্যেক মণ্ডলীর একটি করিয়া সাধারণ মণ্ডপ থাকিবে। সেখানে কার্য ও আমোদে সকলে একত্র হইবার স্থান পাইবে এবং সেখানে ভারপ্রাপ্ত প্রধানেরা মিলিয়া সালিশের দ্বারা বিবাদ ও মামলা মিটাইবে।”

 পুনশ্চ—

 “অদ্যকার দিনে যাহার যতটুকু ক্ষমতা আছে, তাহাতে একত্র মিলিয়া বাঁধ বাঁধিবার সময় আসিয়াছে। এ না হইলে ঢালু পথ দিয়া আমাদের ছোট ছোট সামর্থ্য সম্বলের ধারা বাহির হইয়া গিয়া অন্যের জলাশয় পূর্ণ করিবে। অল্প থাকিলেও আমরা অন্ন পাইব না এবং আমরা কি কারণে—কেমন করিয়া যে মরিতেছি তাহা জানিতেও পারিব না। আজ যাহাদিগকে বাঁচাইতে চাই, তাহাদিগকে মিলাইতে হইবে।”

 দেশের যুবকদিগকে এই গঠনমূলক কার্যের ভার গ্রহণ করিবার জন্য আহ্বান করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন,—

 “তোমরা যে পার এবং যেখানে পার একটি গ্রামের ভার গ্রহণ করিয়া সেখানে গিয়া আশ্রয় লও।.........এই কার্যে খ্যাতির আশা করিবে না; এমন কি গ্রামবাসীদের নিকট হইতে কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে বাধা, অবিশ্বাস স্বীকার করিতে হইবে। ইহাতে কোন উত্তেজনা নাই, কোন বিরোধ নাই, কোন ঘোষণা নাই; কেবল ধৈর্য ও প্রেম এবং নিভৃতে তপস্যা —মনের মধ্যে কেবল এইটুকুমাত্র পণ যে দেশের মধ্যে সকলের চেয়ে যাহারা দুঃখী, তাহাদের দুঃখের ভাগ লইয়া সেই দুঃখের মূলগত প্রতিকার সাধন করিতে সমস্ত জীবন সমর্পণ করিব।”

 দুঃখের বিষয়, দেশের যুবক সম্প্রদায় তাঁহার সেই নীরব কর্মসাধনার আহ্বানে তখন সাড়া দেন নাই; দিলে বাঙলা দেশের চেহারা ফিরিয়া যাইত, স্বদেশী আন্দোলনের প্রবল বন্যায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে শক্তি সঞ্চিত হইয়াছিল, তাহাকে এইরূপ গঠনমূলক কাজের মধ্য দিয়া পরিচালিত করিলে জাতি শক্তিমান হইত এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আমরা অধিকতর প্রস্তুত হইতে পারিতাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে তাহা হইল না। ফলে জোয়ারের জল যখন কমিয়া গেল, সাময়িক উত্তেজনা যখন দূর হইল, তখন আমরা নিঃসম্বল হইয়া পড়িলাম। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যে অবসাদ ও জড়তা দেখা দিল, তাহা আমাদের জাতীয় জীবনকে এখনও আচ্ছন্ন করিয়া আছে।

 আয়র্লাণ্ডের জাতীয় আন্দোলনের নেতাগণ এই সত্যটি ধরিতে পারিয়াছিলেন। তাই একদিকে যখন প্রবল ‘সিনফিন’ আন্দোলন চলিতেছিল, ঠিক সেই সময়ে আর একদল লোক জর্জ রাসেল, স্যার হোরেস প্লাঙ্কেট প্রভৃতির নেতৃত্বে আয়র্লাণ্ডের গ্রামে গ্রামে গঠনমূলক কার্য করিতেছিলেন। ফলে আইরিশদের জাতীয় শক্তি কখনও দেউলিয়া হইয়া পড়ে নাই, পরবর্তীকালে স্বাধীনতার সাধনায় তাহারা সিদ্ধিলাভ করিয়াছে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। মহাত্মা গান্ধীও এই সত্য তাঁহার স্বচ্ছ দূরদৃষ্টিতে উপলব্ধি করিয়াছেন। তাই অসহযোগ আন্দোলন এবং তাহার পরবর্তী আইন অমান্য আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি গঠনমূলক কার্য করিবার নির্দেশ দিয়াছিলেন। এমন কি, ঐজন্য তিনি কংগ্রেস হইতে স্বতন্ত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও গড়িয়া তুলিয়াছেন। দেশের জনসাধারণের উপর তাঁহার অসীম প্রভাবের মূল উৎস ইহারই মধ্যে নিহিত। রবীন্দ্রনাথ বহুকাল পূর্বে যে সব কথা বলিয়াছিলেন, মহাত্মা গান্ধী তাঁহার নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গীতে সেই সব কথাই গঠনমূলক কর্মসাধনা সম্বন্ধে বলিয়াছেন। বর্তমানে যে জাতীয় সঙ্কট উপস্থিত হইয়াছে, তাহার মধ্যেও মহাত্মা গান্ধী গঠনমূলক কার্যের কথা বিস্মৃত হন নাই, বরং উহাকেই প্রধান স্থান দিয়াছেন।

 সে যাহা হউক, রবীন্দ্রনাথ পাবনা সম্মিলনীতে গঠনমূলক কার্যের ধারা নির্দেশ করিলেন বটে, কিন্তু নিজে কয়েক বৎসর পর্যন্ত সে দিকে তেমন মনোনিবেশ করেন নাই। কাব্য ও সাহিত্য সৃষ্টির আনন্দের মধ্যেই তিনি ডুবিয়া গেলেন, ইউরোপে গিয়া বিশ্বসাহিত্য সমাজের সঙ্গে পরিচয় স্থাপন করিলেন এবং “নোবেল পুরস্কার” লাভ করিলেন। ইউরোপ হইতে ফিরিয়া কিছুদিন পরে তিনি তাঁহার গঠনমূলক স্বদেশ সেবার আদর্শ কার্যে পরিণত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ১৯১৪ সালে এই উদ্দেশ্য লইয়াই তিনি “শ্রীনিকেতন” স্থাপন করিলেন। “শান্তি নিকেতন” পূর্বেই স্থাপিত হইয়াছিল। কিন্তু সেই সময়ে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়া তাঁহার আদর্শ কার্যে পরিণত করিবার পথে নানা অন্তরায় সৃষ্টি হইতে লাগিল। বোধ হয় এই কারণে ১৯১৫ সালে ‘বঙ্গীয় হিতসাধনমণ্ডলী’ (Bengal Social Service League) প্রতিষ্ঠিত হইলে তিনি সভাপতিরূপে উহাতে যোগ দিলেন এবং নিজের আদর্শ ও কার্যপ্রণালী ব্যাখ্যা করিয়া কয়েকটি বক্তৃতা করিলেন। ‘বঙ্গীয় হিতসাধনমণ্ডলী’র কার্যপ্রণালী তিনি নিজে নির্ধারিত করিয়া দেন। উহাতে ছিল—

 (১) নিরক্ষরদিগকে অন্তত যৎসামান্য লেখাপড়া ও অঙ্ক শিখানো। (২) ছোট ছোট ক্লাস ও পুস্তিকা প্রচার দ্বারা স্বাস্থ্যরক্ষা, সেবাশুশ্রূষাদি সম্বন্ধে শিক্ষাদান। (৩) ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, নানাবিধ অজীর্ণ ও উদরাময় রোগ প্রভৃতির প্রতিষেধের জন্য সমবেত চেষ্টা। (৪) শিশুমৃত্যু নিবারণের উপায় নির্ধারণ ও অবলম্বন। (৫) গ্রামে উৎকৃষ্ট পানীয় জলের ব্যবস্থা। (৬) গ্রামে গ্রামে যৌথ ঋণদান সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা ও দরিদ্র লোকদিগকে উহার উপকারিতা প্রদর্শন। (৭) দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মড়ক প্রভৃতির সময়ে দুঃস্থদিগকে বিবিধ প্রকারে সাহায্য।

 এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁহার গঠনমূলক স্বদেশ সেবাকে রূপ দিবার জন্য আর একটি যে মহৎ প্রচেষ্টা করেন, তাহার ইতিহাস দেশবাসীর নিকট বলিতে গেলে এতদিন অজ্ঞাতই ছিল। সম্প্রতি “শনিবারের চিঠি”র শ্রীযুক্ত সজনীকান্ত দাস উহাকে বিস্মৃতির গর্ভ হইতে টানিয়া তুলিয়া দেশবাসীর নিকট প্রকাশ করিয়াছেন। এই মহৎ প্রচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথের দক্ষিণ হস্ত ছিলেন শ্রীযুত অতুল সেন এবং তিনিই এই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কতকগুলি পত্র “শনিবারের চিঠি”তে প্রকাশ করিয়াছেন। অতুলবাবু পূর্বে ছিলেন বিপ্লবপন্থী এবং ঐ মতাবলম্বী একদল দৃঢ়চিত্ত কর্মী যুবকদের নেতা। কিন্তু এই সময়ে নানা কারণে তাঁহারা বিপ্লবের পথ ছাড়িয়া কোনরূপ গঠনমূলক কার্যের মধ্য দিয়া স্বদেশ সেবা করিবার জন্য উৎকণ্ঠিত হইয়াছিলেন। পূর্বেই বলিয়াছি, রবীন্দ্রনাথও এজন্য উৎকণ্ঠিত ছিলেন। যোগাযোগ ঘটিল, উভয়ের সাক্ষাৎ হইল। অতুলবাবু, স্বীয় দলবলসহ রবীন্দ্রনাথের কার্যপন্থা গ্রহণ করিলেন। রবীন্দ্রনাথও সানন্দে তাঁহাদের হস্তে সেই ভার তুলিয়া দিলেন। “শনিবারের চিঠি” এই স্মরণীয় ঘটনার যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাহা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি:—

 “কালিগ্রাম পরগণা ঠাকুরবাবুদের জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত—রাজসাহী ও বগুড়া জিলার আত্রাই, রঘুরামপুর, রাণীনগর, সান্তাহার, তিলকপুর, আদমদিঘী, নসরৎপুর ও তালোয়া—এই কয়টি রেল স্টেশনকে ঘিরিয়া এই পরগণা দৈর্ঘে প্রস্থে অনেক শত মাইল ব্যাপিয়া। অতুল সেন হইলেন প্রধান কর্মী, শ্রীযুত উপেন ভদ্র, বিশ্বেশ্বর বসু প্রভৃতি ছিলেন তাঁহার সহকারী। সঙ্গে অতুলবাবুর কর্মিসংঘ। কবিনির্দ্দিষ্ট কাজের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত পাঁচটি—(১) যথাযোগ্য চিকিৎসা বিধান, (২) প্রাথমিক শিক্ষা বিধান, (৩) পাবলিক ওয়ার্কস্ অর্থাৎ কূপ খনন, রাস্তা প্রস্তুত ও মেরামত, জঙ্গল সংস্কার প্রভৃতি, (৪) ঋণদায় হইতে দরিদ্র চাষীকে রক্ষা ও (৫) সালিশী বিচারে কলহের নিষ্পত্তি।

 “প্রথম কাজ আরম্ভ হয় তিনটি কেন্দ্রে—পতিসর, কামতা ও রাতোয়ালে। তিনটি হাসপাতাল ও ঔষধালয় স্থাপন করিয়া বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ চলিতে থাকে, হাসপাতালে যথারীতি ডাক্তার ও দুই একটি ‘বেডের’ও ব্যবস্থা করা হয়। এই সকল সৎকার্যের ব্যয়ভার অংশত জমিদার রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ও অংশত প্রজারা বহন করিতেন। খাজনার টাকা পিছু এক আনা তিনি দিতেন, প্রজারা এক আনা দিত।”

 দ্বিতীয় উদ্দেশ্য অনুসারে দুই শতাধিক অবৈতনিক নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া বিভিন্ন কেন্দ্রে নিরক্ষরতা; দূরীকরণের কাজ আরম্ভ হয়; রাত্রির ও দিনের উভয়বিধ বিদ্যালয়েরই বন্দোবস্ত হয়; শিশু ও বয়োবৃদ্ধ সকলেরই জন্য ব্যবস্থা করা হয়। তৃতীয় উদ্দেশ্য অনুযায়ী পাবলিক ওয়ার্কস সম্বন্ধে দরিদ্র পল্লীবাসীদের সজাগ করিয়া কাজে নিয়োগের ব্যবস্থা হইয়াছিল। এই কার্যে ব্যয় অত্যন্ত অধিক। পুকুর প্রতিষ্ঠা, কূপ খনন, রাস্তা মেরামত ও প্রস্তুত, জঙ্গল সাফ প্রত্যেকটি ব্যয়সাধ্য কাজ। কিন্তু অতুলবাবুর সুচিন্তিত স্কীম অনুসারে প্রজাদের নিকট হইতে কায়িক পরিশ্রম স্বরূপে চাঁদা লওয়া হইতে লাগিল, অর্থাৎ এই সকল কাজে তাহারা ‘জন’ খাটিতে লাগিল। এইরূপে মাত্র সাত আট মাসের মধ্যেই কালিগ্রাম পরগণায় বহু সহস্র টাকার কাজ করা সম্ভব হইয়াছিল।

 চতুর্থ উদ্দেশ্য, ঋণদায় হইতে বিপন্ন প্রজাদের রক্ষা; ইহাও কালিগ্রামে সম্ভব হইয়াছিল। ইহার স্কীমটি সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথের। পঞ্চম উদ্দেশ্য—সালিশী দ্বারা কলহের নিষ্পত্তি। প্রজাদের মধ্যে পরস্পর বিরোধ উপস্থিত হইলে ব্যাপারটা অতুলবাবুর নিকট উপস্থাপিত করা হইত। তিনি বিচার বুদ্ধিমত সুরাহা করিয়া দিতেন। এই কার্যে প্রজারা খুবই সন্তুষ্ট হইয়াছিল।

 “স্বদেশী সমাজে” রবীন্দ্রনাথ যে আদর্শ ব্যক্ত করিয়াছিলেন, পাবনায় প্রাদেশিক সম্মেলনের অভিভাষণে পল্লীসংগঠন সম্বন্ধে তিনি যে সব উপদেশ দিয়াছিলেন, অতুলবাবু ও তাঁহার কর্মিসংঘের সহায়তায় রবীন্দ্রনাথ কালিগ্রাম পরগণায় সেই সবই কার্যে পরিণত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। কাজও বেশ ভাল চলিতেছিল। অতুলবাবু ও তাঁহার কর্মিসংঘের উৎসাহের অন্ত ছিল না। সর্বপ্রকার পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকারের জন্যই তাঁহারা প্রস্তুত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁহার জীবনের স্বপ্ন সফল হইতে চলিল দেখিয়া বিশেষ আনন্দলাভ করিয়াছিলেন। এই সময়ে অতুলবাবুকে তিনি যে সব পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে এই ভাবটি বেশ পরিস্ফুট। কিন্তু বিধাতা অলক্ষ্যে বোধ হয় ক্রূর হাস্য করিতেছিলেন। এত বড় একটা মহৎ প্রচেষ্টা সফল হইতে চলিল, গ্রামবাসীরা শিক্ষিত যুবকদের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হইয়া নিজেদের উন্নতি সাধন করিতে লাগিল, সরকারী গোয়েন্দা পুলিস বিভাগের বোধ হয় কিছুতেই সে দৃশ্য সহ্য হইল না। অতুলবাবু ও তাঁহার দলবল পূর্ব হইতেই বিপ্লববাদী বলিয়া সন্দেহভাজন ছিলেন। এই সন্দেহের সুযোগ লইয়া গোয়েন্দা পুলিস একদিন তাঁহাদের সকলকে গ্রেপ্তার করিল এবং সরকারী আদেশে তাঁহারা অন্তরীণ বা নজরবন্দী হইলেন। কালিগ্রাম পরগণায় প্রায় এক বৎসর কাজ চলিবার পর এই বিপত্তি ঘটিয়াছিল। রবীন্দ্রনাথ যে ইহাতে প্রবল আঘাত পাইয়াছিলেন, তাহা অনুমানেই বুঝা যাইতে পারে। মাত্র তাঁহার অসাধারণ ধৈর্য ও সংযম বলেই তিনি ভাঙ্গিয়া পড়েন নাই। অতুলবাবু প্রভৃতি অন্তরীণ হইবার পর অতুলবাবুর পত্নীকে রবীন্দ্রনাথ নিম্নলিখিত পত্র লিখিয়াছিলেন,—

“কল্যাণীয়াষু,

 তোমার স্বামীর অন্তরীণ সংবাদ আমি পূর্বেই শুনিয়াছি। কি কারণে এই বিপত্তি ঘটিল তাহা কিছুই জানি না। এ সম্বন্ধে রাজপুরুষদের নিকট আমি পত্র লিখিয়াছি। তাহার কোন ফল হইবে কিনা বলা যায় না। তোমরা যে দুঃখ ভোগ করিতেছ, ভগবান তোমাদের সেই দুঃখকে কল্যাণে পরিণত করুন। এই কামনা করা ছাড়া আর আমাদের কিছু করিবার নাই।”

 এইরূপে কবির সকল উদ্যম আয়োজন ব্যর্থ হইল, কিন্তু ইহাতে তিনি নিরাশ ও ভগ্নোৎসাহ হইলেন না। শান্তিনিকেতন বিশেষ করিয়া শ্রীনিকেতনের মধ্য দিয়া তিনি তাঁহার পল্লীসংগঠন নীরব কর্মসাধনার আদর্শ বাস্তবে পরিণত করিতে দ্বিগুণ উৎসাহে প্রবৃত্ত হইলেন। বলিতে গেলে, ১৯১৬ সাল হইতে আরম্ভ করিয়া জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন লইয়াই ছিলেন। গ্রামের স্বাস্থ্যসংস্কার, পল্লীশিল্পের পুনরুদ্ধার ও প্রসার, লোকশিক্ষা বিস্তার, সমবায় সমিতি গঠন—এই সবই ছিল শ্রীনিকেতনের লক্ষ্য। আমার স্বর্গীয় বন্ধু কালীমোহন ঘোষ শ্রীনিকেতনের কর্ণধার এবং এই সব কাজে রবীন্দ্রনাথের দক্ষিণ-হস্তস্বরূপ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যে এই পল্লীসংগঠন সম্বন্ধে কত চিন্তা করিতেন, কালীমোহনবাবু বহুবার আমার নিকট তাহা বলিয়াছেন। কবির বন্ধু এল্ম্হার্স্ট সাহেব এই পল্লীসংগঠন কার্যে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন এবং এজন্য তিনি বার্ষিক অর্থসাহায্যের ব্যবস্থাও করেন। উহার ফলে শ্রীনিকেতনের কাজের বিশেষ সুবিধা হইয়াছিল সন্দেহ নাই।

 রবীন্দ্রনাথ গ্রামবাসীদের দুঃখদুর্দশা কিরূপ গভীরভাবে অনুভব করিতেন এবং পল্লীসংগঠনের কাজ কত বড় মনে করিতেন, কয়েকবার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎকালে তাঁহার নিজের মুখ হইতেই সে বিষয়ে শুনিবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছিল। একবার তিনি আমাকে বলেন,—“দেশের সবচেয়ে বড় দুর্গতি গ্রামবাসীদের এই ঘোর দারিদ্র্য ও অস্বাস্থ্য। তাহারা কুকুর বিড়ালের মতো না খেয়ে মরে, বিনা চিকিৎসায় মরে, এমন কি চৈত্রের কাঠফাটা রৌদ্রে একফোটা পানীয় জলও তাদের পক্ষে দুর্লভ হয়ে ওঠে। যদি এই গ্রামবাসীদেরই বাঁচান না গেল, তাদের দুঃখদুর্দশা দূর করা না গেল, তবে আর দেশোদ্ধারের বড় বড় কথা বলে লাভ কি?”

 আর একবার কয়েকজন সাংবাদিক মিলিয়া তাঁহার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে সাক্ষাৎ করিয়াছিলাম। তিনি আমাদের বলেন,—“তোমরা বড় বড় রাজনীতির কথা লেখ, কিন্তু ও সবে আমার মন ভরে না। এই যে প্রতিদিন গ্রামবাসীদের দুঃখদারিদ্র্য চোখের সম্মুখে দেখ‍্তে পাচ্ছি, এইটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে হয়। তোমাদের হাতে শক্তিশালী অস্ত্র সংবাদপত্র আছে, তোমরা সেই অস্ত্র এদের জন্য প্রয়োগ কর। দেশের লোককে জানাও এদের দুঃখ দুর্দশা কিরূপ অপরিমেয়, কি ভাবে সেই দুঃখ মোচন করতে হবে তার পথ দেখিয়ে দাও। তবেই তোমাদের সংবাদপত্রসেবা সার্থক হবে।”

 শেষ জীবনে তাঁহার মনে এই ধারণা হইয়াছিল যে তিনি শান্তিনিকেতনের ও শ্রীনিকেতনের মধ্য দিয়া যে গঠনমূলক কাজ করিতেছেন, তাহার সম্যক পরিচয় দেশের লোক পায় নাই। উহা যাহাতে লোকে ভাল করিয়া জানিতে পারে, সেজন্য তাঁহার বিশেষ আগ্রহ হইয়াছিল। তিনি নিজে কালীমোহনবাবুকে বলিয়া বিশেষ ব্যবস্থা করিয়া শ্রীনিকেতনের কাজ আমাদিগকে দেখাইয়াছিলেন। আর একবার ‘রবিবাসর’-এর সাহিত্যিকমণ্ডলীর সদস্যদিগকে তিনি শান্তিনিকেতনে নিমন্ত্রণ করেন। সদস্য হিসাবে আমিও তাঁহাদের মধ্যে ছিলাম। রবীন্দ্রনাথ আমাদের ন্যায় দরিদ্র সাহিত্যিকদিগকে যেরূপ রাজোচিত অভ্যর্থনা করেন, তাহা জীবনে ভুলিব না। যে দিন ‘উত্তরায়ণে’ আমাদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়ান, সেদিনের দৃশ্য এখনও চোখের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিতেছে। বৃহৎ হলে আমরা সকলে খাইতে বসিয়াছি। মধ্যস্থলে রবীন্দ্রনাথ আতিথেয়তার প্রতিমূর্তি স্বরূপ বসিয়াছেন। পরিবেশন করিতেছেন কবির পুত্রবধূ, দৌহিত্রী ও পালিতা পৌত্রী। একদিকে রবীন্দ্রনাথের সরস গল্প ও হাস্য পরিহাস, অন্যদিকে নানাবিধ মনোরম খাদ্য—কোন‍্টি যে বেশী উপভোগ্য হইয়াছিল, তাহা ঠিক বুঝিতে পারি নাই।

 কবি সে দিনও কতকটা ক্ষোভের সঙ্গে আমাদিগকে বলিয়াছিলেন,—“লোকে মনে করে, আমি শুধু কল্পনাবিলাসী কবি। কিন্তু বাস্তব কার্যক্ষেত্রে আমি যে জিনিষ সারাজীবন ধরে গড়ে তুললাম, তার পরিচয় কেউ নিতে চায় না। তোমরা সব সাহিত্যিক, আমার এই গঠনমূলক কার্য যদি তোমরা নিজেরা দেখ এবং দেশের লোকের কাছে উহার কথা প্রচার কর, তা’হলে আমি আনন্দিত হব।”

 কবি তাঁর এই অমরকীর্তি—শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন, বিশ্বভারতী দেশবাসীদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন। এগুলিকে রক্ষা করবার মহৎ দায়িত্ব এখন দেশবাসীর উপরেই পড়িয়াছে।