পাতা:আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা - প্রবীর ঘোষ.pdf/৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করতে গিয়ে কখনও শিকার হয়েছে। জলোচ্ছাসে, বন্যায় আস্তানা ভেসেছে বার-বার। এসেছে মৃত্যু। খরায় মাটি ফেটেছে, ছাতি ফেটেছে। সঙ্গে কত না রোগের আক্রমণ, অপরিশোধিত জল থেকে বাহিত রোগ, অপুষ্টিজনিত রোগ, মশা-মাছি বাহিত রোগ ইত্যাদি তো ছিলই নিত্যসঙ্গী। অসহায় মানুষ প্রকৃতির শক্তিকে ভয় করেছে, শ্রদ্ধা করেছে। ভয় ও শ্রদ্ধা করেছে জল, ঝড়, বৃষ্টি, নদী সমুদ্র, মেঘ, বজ্রপাত, বন্যা, আগুন, পাহাড়-পর্বত, মাটি ইত্যাদিকে। এ সবেরই প্রাণ আছে বিশ্বাসে বসিয়েছে দেবতার আসনে। চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, শনি প্রভৃতি জড় নক্ষত্র ও গ্রহগুলো পৃজিত হয়েছে জীবন্ত দেবতা হিসেবে। মানুষের জীবনে সম্পদ হিসেবে প্রবেশ করেছে বৃক্ষ, অরণ্য, গরু-ছাগল, শুয়োর এবং আরও নানা ধরনের গৃহপালিত জন্তু এবং সেই সঙ্গে তারাও দেবতা হিসেবে পুজো পেয়েছে। পুজো পেয়েছে বনের বিপদ হয়ে দাঁড়ান পশু বাঘ, সিংহ, হাতি, হনুমান থেকে সরীসৃপ সাপ, কুমির পর্যন্ত। বিপদ থেকে ভয়, আর ভয় থেকেই বিপদের কারণগুলোকে খুশি করতে চেয়েছে মানুষ। সেই খুশি করতে চাওয়াই হয়ে উঠেছে 'পুজো'। ওরা শিকারে সফলকাম হতে নাচ করেছে,বর্ষা নামাতে মেঘের দেবতাকে তুষ্ট করতে নেচেছে, জমির উর্বরতা কামনায় নাচে উদ্দাম হয়েছে। ওদের পুজোয় ধর্মগুরুর কোনও ভূমিকা ছিল না। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গুরুদের তখন আবির্ভাবই হয়নি, যে গুরুরা ধর্মকে সমষ্টিতে রূপ দিয়েছিল। তখন এসব পুজোর পুরোহিত ছিল ওঝা, গুনীন, জ্ঞানগুরু ইত্যাদি এবং তাদের স্তরটা ছিল ব্যক্তিগত।

 প্রাচীন ভারতের কর্ম-মীমাংসা দর্শনের দিকে তাকালে দেখাতে পাবেন ওই দর্শন নিখুঁত যাগযজ্ঞগুলোকেই ক্ষমতার উৎস, মনোবাঞ্ছা পূরণের চাবিকাঠি মনে করত। ঈশ্বর বা পরমাত্মাকে সন্তুষ্ট করার মধ্য দিয়ে অভীষ্টে পোঁছবার চেষ্টা করেনি। বলতে কি, ঈশ্বর পরমাত্মার ক্ষমতাকে গণনার মধ্যেই আনতে চায়নি। কর্ম-মীমাংসার যুগে ইচ্ছেপূরণের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল যাগযজ্ঞের, ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য নয়।

 প্রকৃতি পুজোর সময়কার মানুষ পরমাত্মাজাতীয় ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিল না। প্রকৃতিই ছিল তাদের ঈশ্বর। তাদের ঈশ্বরের সংজ্ঞা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ঈশ্বরের সংজ্ঞার চেয়ে ভিন্নতর। এদের ঈশ্বর প্রকৃতি।

 প্রকৃতি পুজোরও আগের মানুষের ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে দেখতে পাব, তাদের চিন্তা দেবতাশূন্য। প্রকৃতির সমস্ত রকম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিটি পদক্ষেপে টিকে থাকার লড়াই চালাতে সে সময়কার মানুষদের কোনও দেবতার কাছেই নতজানু হতে হয়নি। তবু তারা টিকে ছিল। দেবতাকে পাত্তা না দিয়েও টিকে ছিল। তাদের টিকে থাকার জন্য সেই ভয়ংকর প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কোনও দেবতার প্রয়োজন হয়নি। তারা যে টিকে ছিল, আমাদের বর্তমান উপস্থিতিই তার প্রমাণ।

৯৩