বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:প্রবাসী (দ্বাত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভাবে তবে কবির সব সুরই যে এরূপ তা বলছি নে। অধিকাংশ গানেরই ঐৰূপ স্বরবিন্যাস। " তান ব্যবহার কবির সুরে কেন করা সম্ভবপর নয় তা ভাবতে গেলে আমাদের এই মনে হয় যে, তানে কথার ভাব প্রকাশ পায় না—পায় সুরের ভাব । খেয়াল গীতগায়ক আপন খেয়ালবশে তানের পর তান দিয়ে চলবে, তিন-চার মিনিট পরে হয়ত এক-একটা তান-কওঁব শেষ ক’রে গানের কথায় ফিরে আসবে। এতে কথার প্রাধান্ত থাকে না। ঠংরি গানে কথার মূল্য খেয়াল গীতের চেয়ে অনেক বেশী । খেয়ালের মত টপ্পাতেও কথা ছেড়ে দুএক মিনিট দ্রুত গিটকিরী এত ব্যবহার হয় যে, সেখানে স্নরের প্রাধান্যই দিতে হয়। কবি গানে সুরের প্রাধান্য দিতে নারাজ। এ-জন্য খেয়াল-টপ্পী-গীতপদ্ধতি কবির গানে প্রযোজ্য নয় । কবি ছোট ছোট গীত-অলঙ্কার ব্যবহার করেছেন । তানের বদলে উপজ' ব্যবহার করেছেন । ঝটক, মীড়, আশ, দু-কি-তিন-মাত্রা কাল ধ্বনিত গিটকিরী এবং স্পর্শ সুর—এগুলি তিনি ব্যবহার ক’রে থাকেন। ঠুংরির মত স্বরের খোচ ও স্বরের বিন্যাস র্তার গানে পাওয়া যায়, কিন্তু ঠুংরির চালটুকু তিনি গ্রহণ করেন নি। ধ্রুপদের চলনভঙ্গীতে তিনি ঠুংরির স্বরবিন্যাস অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন । রবীন্দ্রনাথ গানের কবিতাটিকে মূৰ্ত্তি ধরে নিয়ে তাতে সুরের বসন পরিয়েছেন ও বিশেষ বিশেষ স্থানে উপযুক্ত গীত-অলঙ্কার সংযোজন করেছেন। এটা ধ্রুপদের পদ্ধতি । কিন্তু খেয়াল গীতে সুর দিয়ে তৈরি রাগ-রাগিণীর রূপই হ’ল গানের অবয়ব। তাতে স্বরবিস্তারেরই বসন পরিয়ে সুর ও গীত-অলঙ্কার দিয়ে তানের মাল গেঁথে মূৰ্বির বিশেষ বিশেষ স্থানে বেঁধে দিতে থাকে খেয়াল-টপ্পাগায়ক । স্বরগুলিকে নাচিয়ে এবং স্বরগুলি নিয়ে থেল ক’রেই থেয়ালী আনন্দ পায়। কাজেই কবির গান এবং পেয়ালটপ্পা এ দুটি হ’ল সম্পূর্ণ পৃথক জিনিষ । ধ্রুপদের মত গজেন্দ্রগামী হলেও কবির গানে টপ্প-ঠংরিতে ব্যবহৃত হালকা রাগ-রাগিণীর কঙ্কালই বেশী পাওয়া যায়। যেমন, ভৈরবী, পিলু বারওয়া, সাহান, সিন্ধু, খাম্বাজ, দেশ, বেহাগ ইত্যাদি। হিন্দোল, রবীন্দ্রনাথের সুর الاعوا মালকোশ, পুরিয়া, সোহিনী ইত্যাদি রাগ-রাগিণীর রূপ পাওয়া যায় না । কবির গানে ঔড়ব ও খাড়ব বলে কিছু নেই, সবই সম্পূর্ণ। কবির প্রথম জীবনের পরবর্তী কালের গীতে ভাটিয়ালী ও বাউল মুরের গান আছে। তিনি যখন জমিদারীর কাজে শিলাইদহে নদীর ধারে থাকতেন সে সময় ভাটিয়ালী ও কীর্তনের ভাঙা স্বরের মিশ্রণে প্রথম গীত রচনা আরম্ভ করেন । শিলাইদহের মাঝিদের গানেই ভাটিয়ালী স্বর পেয়েছেন এরূপ অনুমানই সত্য মনে হয় । শিক্ষিত সমাজের নিকট কবির বাউল স্বর-রচনার পূর্ব পর্যন্তও বাউল ঘৃণিতই ছিল । কবিই তার স্বাদ পেয়ে নিজের গানে সংযোজন ক’রে বাউল মুরকে যথার্থ মূল্যবান ক’রে তুলেছেন। বাউল গানে আমরা পাই কথার ও ভাবের প্রাধান্ত, আর স্বরের ও ছন্দের সরলতা। দু-একটি সরল ও লঘু ছন্দে বাউল গীত হয় ব’লে তা অতি সরল এবং এর গতিও সহজ সাবলীল। বাউলের প্রভাবই কবির গানে খুব বেশী পরিলক্ষিত হয়। কথার প্রাধান্য কবির গানে খুব বেশী, স্বরের সরলতাও যথেষ্ট এবং ছন্দ ও লয়ের সহজ সাবলীল ধারাই কবির গানের বিশেষত্ব । বিষমপদী ছন্দ জটিল ও গম্ভীর । সম্পদী ছন্দের মধ্যে চৌতাল, টিমে তেতাল, আড়াঠেক, মধ্যমান প্রভৃতি ছন্দ কঠিন ও গম্ভীর। কিন্তু কবির সুরে এ সব ছন্দের অভাব । ‘গীত-পঞ্চাশিকা’য় বিষমপদী ছন্দের গান আছে। কিন্তু আধুনিক গানে ছন্দ আরও লঘু হয়ে পড়েছে। ছয় মাত্রার ও আট মাত্রার লঘু ছন্দে প্রায় সমস্ত স্থর রচিত হচ্ছে । গীত-পঞ্চাশিকা’য় ষোল ও বার মাত্রার সম্পদী ছন্দ, অর্থাৎ তেতালা ও একতাল। তালের গান আছে । কিন্তু কবির আধুনিক স্বরে তেতালা ছন্দও খুব কম। ছন্দের দিকে লঘু ভাব হলেও গতিটকু প্রায় প্রত্যেক গীতেরই বিলম্বিত। কথায় ভাবের অনুপাতে ছন্দের ভাব লঘু হয়ে পড়াতে লয়টুকু দিয়েই ভাবের মান-পরিমাণ সমন্বয় করা হয় । কথার ও স্বরের ভাব যে-সব গানে গম্ভীর সে-সব গানের গতিও বিলম্বিত হয়ে যায়। ত৷ না হ’লে গীতের মাধুর্ঘ্য বজায় রাখা সম্ভবপর হয় না। to