বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:প্রবাসী (দ্বাত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আশ্বিন পড়িলেন, দুতলার বারান্দার রেলিঙ হইতে ঝুঁকিয় ডাকিলেন, “ক্ষ্যাস্ত !” ক্ষেস্তি তখন নীচে রান্নাঘরে বসিয়া ঠাকুরের রন্ধনের সমালোচনা করিতে ব্যস্ত ছিল । কাচা লঙ্কা না দিয়ে কিরকম আবার নিরিমিষ তরকারী হচ্ছে...তাতে আবার দুধ, এমন কাণ্ড কখনও কেউ বাপের জন্মে দেখেনি।--দুধে মুনে মিশলে যে গোরক্তের সমান হয় গো ! হেমবালার ডাক শুনিয়া ছুটিতে ছুটিতে উপরে আসিল । কহিল, “আমায় ডাকছিলেন মা ?” হেমবালা মন্দিরাকে তাহার দিকে অগ্রসর করিয়া দিয়া কহিলেন, “এর আয় কোথায় আছে দেখ, একে তার কাছে নিয়ে ষা, কাপড় ছাড়িয়ে খাওয়াতে বল ।” ক্ষেন্তি ভিন্ন অপর কোনও ঝি-চাকরকে হেমবালা পারতপক্ষে নিজের ঘরে ডাকিতেন না। ভাইয়ের সংসার হইতে কোনও দিকে প্রয়োজনাতিরিক্ত কিছু তিনি লইবেন না ইহা স্থির ছিল । ক্ষেস্তি কহিল, “তা ত বলব মা, কিন্তু আমার কথায় এখানে কি কেউ কান দেয় ? সব গা-টেপাটেপি ক’রে হাসে । এদের অদিব দেখে গা জ’লে যায় মা, আমরা রাজবাড়ীর ঝি-চাকর...” হেমবালা তাহাকে তাড়া দিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, তুই স্ব। ত এখন ’ সে চলিয়া গেলে হেমবালা ঘরের দরজাটা বন্ধ করিয়া দিলেন। বালিশের তলা হইতে বইখানি বাহির করিয়া প্রথমে কিছুক্ষণ অকারণেই তাহার কয়েকটা পাতা উণ্টাইলেন। তারপর হঠাৎ এক সময় চিঠিটিকে বাহির করিয়৷ কিছুমাত্র ইতস্তত: না করিয়াই খুলিয়া ফেলিলেন । দাড়াইয়া-দাড়াইয়াই পড়িতে লাগিলেন, যেন বসিয়া পাঠ করিলে চিঠিটিকে অনাবশ্বক বেশী মর্যাদা দান করা হইবে । পরিচিত চিঠির কাগজ, পরিচিত হস্তাক্ষর! "যে অপরাধের ক্ষমা নাই তাহার জন্য তোমার কাছে ক্ষমাভিক্ষা আর করিতে চাহি না । কিন্তু ক্ষমা না করিয়াও ত মানুষে দয়া করে ? তুমি দয়া করিয়াই ফিরিয়া ভাইস । - ‘তুমি কাছে না থাকিলে বাচিয়া থাকার কোনও অর্থ शृचष्ण bペ> থাকে না, ইহা আমি মৰ্ম্মে মৰ্ম্মে অনুভব করিতেছি । এক-একবার এমনও মনে হইতেছে, প্রলোভনে যে ভুলিয়াছিলাম তাহাও তোমাকে দিয়া আমার অন্তর পরিপূর্ণ ছিল বলিয়াই পারিয়াছিলাম। এই অদ্ভুত কথার কি যে অর্থ হইতে পারে তাহা তুমি বুঝিবে না, পৃথিবীর কেহই সম্ভবতঃ বুঝিবে না, এমন কি আমি নিজেও ভাল করিয়া বুঝিতেছি না, কিন্তু ঈশ্বর রাধাগোবিন্দজী জানেন, আমি মিথ্যা কহিতেছি না। আজ তুমি কাছে নাই, পৃথিবীতেও এমন-কিছু নাই ধাহা আমাকে প্রলুব্ধ করিতে পারে ! ‘আমার আর যত দোষই থাকুক, জ্ঞান হইয়া অবধি কখনও আমি মিথ্যা কহি নাই । যদি ইচ্ছা করিতাম, খুব সহজে তোমাকে আমি ফাকি দিতে পারিতাম । কাহারও সাধ্য ছিল না অামার অপরাধ প্রমাণ করিতে পারে, এখনও সে সাধ্য কাহারও নাই । আমি না বলিলে আমাকে সন্দেহ করিবার কথাও তোমার মনে আসিত না । কিন্তু পৃথিবীতে তোমারই জানিবার অধিকার আছে বলিয়া নিজে হইতে অকপটে তোমাকে আমি সত্য কহিয়াছি, কিছু গোপন করি নাই। আজও আমি সত্য কথাই কহিতেছি । ‘অপরাধী নিজে হইতে অপরাধ স্বীকার করিলে তাহার দণ্ড হ্রাস হয়। কিন্তু তুমি আমাকে আমার প্রাপ্য চরম দণ্ডই দিতেছ। হতভাগ্য নরেন্দ্রনারায়ণ । হেমবালা সত্যই কিছু বুঝিতে পারিলেন না, বুঝিবার আগ্রহও তাহার কিছু ছিল না। তাড়াতাড়ি চিঠিটিকে ভাজ করিয়া তবু নিতান্ত কর্তব্যবোধেই ইহার মৰ্ম্মোদ্ধারের চেষ্টা কয়েক মুহূৰ্ত্ত ধরিয়া তিনি করিলেন । ঠোঁটের কোণ দুইটা অবাধ্য হইয়া কঁাপিতেছিল, দৃঢ়তার দ্বারা সেটুকুকে শাসন করিলেন। একবার চিঠিটি ছিড়িতে উদ্যত হইয়াও ছিড়িলেন না, ছেড়া টুকরা কোথায় ফেলিবেন, কে কোথায় কুড়াইয়া পাইয়া পড়িবে, দেরাজ হইতে চাবির গোছা লইয়া নিজের ছোট হাতবাক্সটি খুলিয়া সমস্ত কাগজপত্রের নীচে চিঠিটিকে রাখিয়া দিলেন।