পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুৰ্গেশনন্দিনী মলিন । পরিধানে জীর্ণ, ক্ষুদ্র বসন । সে অলঙ্কারভার কোথায় ? সে অংসসংস্পৰ্শলোভী কর্ণাভরণ কোথায় ? চক্ষুঃ ফুলিয়াছে কেন ? সে কটাক্ষ কৈ ? কপালে ক্ষত কেন ? রুধির যে বাহিত হইতেছে। বিমলা ওসমানের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন । ওসমান পাঠানকুলতিলক । যুদ্ধ তাহার স্বার্থসাধন ও নিজ ব্যবসায় এবং ধৰ্ম্ম ; সুতরাং যুদ্ধজয়ার্থ ওস মান কোন কাৰ্য্যেই সঙ্কোচ করিতেন না । কিন্তু যুদ্ধপ্রয়োজন সিদ্ধ হইল, পরাজিত পক্ষের প্রতি কদাচিৎ নিম্প্রয়োজন ভিলাৰ্দ্ধ অত্যাচার করিতে দিতেন না। যদি কতলু বা স্বয়ং বিমল ও তিলেত্তমার অদৃষ্টে এ দারুণ বিধান না করিতেন, তবে ওসমানের কৃপায় তাহারা কদাচ বন্দী থাকিতেন ন । তাহারই অনুকম্পায় স্বামীর মৃত্যুকালে বিমল তৎসাক্ষাৎ লাভ করিয়াছিলেন । পরে যখন ওসমান জানিতে পারিলেন যে, বিমল বীরেন্দ্রসিংহের স্ত্রী, তখন তাহার দাদচিত্ত আরও আদ্রীভূত হইল । ওসমান কতলু গীর ভ্রাতুপুল, * এ জন্য অন্তঃপুরেও কোথাও তাহার গমন বারণ ছিল না ; ইহা পূৰ্ব্বেই দৃষ্ট হইয়াছে। সে বিহারগুহে কতনু শার উপপত্নী সমূহ থাকিত, সে স্থলে কতলু পার পুত্রেরাও যাইতে পারিতেন না, ওসমানও নহে । কিন্তু ওসমান কতলু গার দক্ষিণহস্ত, ওসমানের বাহুবলেই তিনি আমোদরতীর পর্য্যন্ত উৎকল অধিকার করিয়াছিলেন । সুতরাং পৌরজন প্রায় কতলু খার যাদৃশ, ওস্মানের তাদৃশ বাধ্য ছিল । এ জন্যই অদ্য প্রাতে বিমলার প্রার্থনানুসারে, চরমকালে তাহার স্বামিসনদর্শন ঘটিয়াছিল । বৈধব্যঘটনার দুষ্ট দিবস পরে বিমলার যে কিছু অলঙ্কারাদি অবশিষ্ট ছিল, তৎসমুদায় লইয়। তিনি কতলু খার নিয়োজিত দাসীকে দিলেন । দাসী কহিল, “আমায় কি আজ্ঞা করিতেছেন ?" বিমল কহিলেন, “তুমি যেরূপ কাল ওসমানের নিকট গিয়াছিলে, সেইরূপ আর একবার যাও । কহিও যে, আমি তাহার নিকট আর একবার সাক্ষাতের প্রাথিত ; বলিও, এই শেষ, আর তৃতীয়বার ভিক্ষ করিব না ।” দাসী সেইরূপ করিল । ওসমান বলিয়। পাঠাইলেন, “সে মহালমধ্যে আমার যাতায়াতে উভয়েরই সঙ্কট ; তাহাকে আমার আবাস-মন্দিরে আসিতে কহিও ” :

  • ইতিহাসে লেখে পুত্র।

8俭 বিমলা জিজ্ঞাস করিলেন, “আমি যাই কি প্রকারে ?” দাসী কহিল, “তিনি কহিয়াছেন যে, তিনি তাহার উপায় করিয়া দিবেন।” 歌 সন্ধ্যার পর আয়েষার এক জন দাসী আসিয়া, অস্তঃপুররক্ষী খোজাদিগের সহিত কি কথাবাৰ্ত্ত কহিয়৷ বিমলাকে সমভিব্যাহারে করিয়া ওসমানের নিকট লইয়া গেল । ওসমান কহিলেন, “আর তোমার কোন অংশে " উপকার করিতে পারি ?” . বিমলা কহিলেন;–“অতি সামান্ত কথা মাত্র ঃ রাজপুতকুমার জগতসিংহ কি জীবিত আছেন ?” - - ও । জীবিত আছেন । বি । স্বাধীন আছেন কি বন্দী হইয়াছেন ? ও । বন্দী বটে, কিন্তু আপাততঃ কারাগারে নহে। তাতার অঙ্গের অস্ত্রক্ষতের হেতু পীড়িত হইয়া শয্যাগত আছেন । কতলু গার অজ্ঞাতসারে তাহাকে অন্তঃপুরেই রাখিয়াছি । সেখানে বিশেষ যত্ন হইবে বলিয়া রাখিয়াছি । বিমলা শুনিয়া বলিলেন, “এ অভাগিনীদের সম্পর্কমাত্রেই অমঙ্গল ঘটিয়াছে । সে সকল দেবতাকৃত। এক্ষণে যদি রাজপুত্র পুনৰ্জ্জীবিত হয়েন, তবে " তাহার আরোগ্যপ্রাপ্তির পর, এই পত্ৰখানি তাহাকে দিবেন ; আপাততঃ আপনার নিকট রাখিবেন । এই মাত্র আমার ভিক্ষা ।” - ওসমান লিপি প্রত্যুপণ করিয়া কহিলেন, “ইহা আমার অনুচিত কাৰ্য্য ; রাজপুল্ল ষে অবস্থাতেই থাকুন, তিনি বন্দী বলিয়া গণ্য । বন্দীদিগের নিকট কোন লিপি আমরা নিজে পাঠ না করিয়া যাইতে দেওয়া অবৈধ এবং আমার প্রভুর আদেশ-বিরুদ্ধ ” - বিমলা কহিলেন, “এ লিপির মধ্যে আপনাদিগের অনিষ্টকারক কোনও কথাই নাই । সুতরাং অবৈধ কাৰ্য্য হইবে না । আর প্রভুর আদেশ ? আপনি আপন প্রভু " ওসমান কহিলেন, “অন্যান্ত বিষয়ে আমি পিতৃব্যের আদেশবিরুদ্ধ আচরণ কখন করিতে পারি ; কিন্তু এ সকল বিষয়ে নহে । আপনি যখন কহিতেছেন যে, এই লিপিমধ্যে বিরুদ্ধ কথা নাই, তখন সেইরূপই আমার প্রতীতি হইতেছে, কিন্তু এ বিষয়ে নিয়মভঙ্গ করিতে পারি না। অামা হইতে এ কার্ষ্য হইবে না ।” বিমলা ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিলেন, “তবে আপনি পাঠ করিয়াই দিবেন।” ওসমান লিপি গ্রহণ করিয়া পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন ।