পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/১২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অভিনয় আনন্দবর্ধনের পরেই ধ্বনিপ্রস্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ সমর্থক ও প্রবক্তা- সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। এমন কি, যদিও আনন্দবর্ধন ধ্বন্যালােকে ভরতমুনির রসপ্রস্থানের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য প্রদর্শন ও সাহিত্যক্ষেত্রে রসধ্বনির সর্বাতিশায়ী প্রাধান্য খ্যাপন করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা অনুভব করেন নাই, তথাপি রসতত্ত্বকে একটি সুদৃঢ় দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়া সর্বকালের জন্য উহাকে সাহিত্যবিচারের কেন্দ্রীয় তত্ত্বরূপে প্রচার করার গৌরব অভিনবগুপ্তেরই। তাহা ছাড়া কবিকর্মে শান্তরসের প্রাধান্য এবং সর্বপ্রকার রসের শান্তরস হইতেই উদ্ভব ও শান্ত প্রায় আস্বাদ প্রতিপাদনও অভিনব গুপ্তের অন্যতম মহৎ কৃতিত্ব। সেইজন্য মটকৃত কাব্য প্রকাশ’-এর টীকাকার মাণিক্যচন্দ্র অভিনবগুপ্তের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করিতে গিয়া বলিয়াছেন - ‘সর্বস্বং হি রসস্তাত্র গুপ্তপাদা বিজানতে। রসতত্ত্ববিষয়ে অভিনবগুপ্তের মতবাদ ‘অভিব্যক্তিবাদ’-রূপে পরিচিত। ū P. V. Kane, History of Sanskrit Poetics, Bombay, 1951 ; S. K. De, History of Sanskrit Poetics, Calcutta, 1960 ; K. C. Pandey, Abhinavagupta : An Historical and Philosophical Study, Chowkhamba Sanskrit Series, Benares, 1935 ; Raniero Gnoli, The Aesthetic Experience According to Abhinavagupta, Roma, 1956. বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য

অভিনয় একটি শিল্পকলা রূপে গণ্য হইয়া থাকে। কিন্তু নাট্যকারের সৃষ্ট গল্পের গতি, চমক ও উত্তেজনার সাহায্য লইয়া কেবলমাত্র একটি চরিত্রের সংলাপ আবৃত্তি করার মধ্যে বিশিষ্ট কলাসৃষ্টির মর্যাদা কোথায় ? প্রত্যেক শিল্পকলারই একটি নিজস্ব ও স্বাধীন প্রকাশভঙ্গী থাকে। যাহার দ্বারা উহা এমন কিছু আবেগ সৃষ্টি করিতে পারে যাহা অন্য কোনও শিল্পপন্থায় সম্ভব নহে। উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে যে, গানে যখন একটি বিশেষ পদার পর আরও একটি বা একাধিক বিশেষ পর্দা লাগানাে হয়, তখন তাহা শ্রোতাদের মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তাহা অন্য কোনপ্রকারে অনুভবে সঞ্চারিত করা সম্ভব নহে। চিত্রেও সেইরূপ। বিশেষ একটি রঙে বা বিশেষ একটি রেখায় ইহা যে আবেদন দর্শকদের মনে জাগাইয়া থাকে তাহা অন্য কোন প্রকারে সম্ভব নহে। সেইরূপ অভিনয়েও বাচনভঙ্গী, অঙ্গভঙ্গী ও অভিনেতার সত্তার অভিক্ষেপণ দ্বারা এমন কিছু আবেগ সৃষ্টি করা সম্ভব হইয়া উঠে যাহা

________________

অভিনয় লিখিয়া প্রকাশ করা যায় না, আকিয়া প্রকাশ করা যায় , বা গাহিয়া প্রকাশ করা যায় না। তাই বলিয়া সাহিত্যিক-প্রদত্ত সংলাপকে বাদ দিয়া কেবল মূকাভিনয়কেই একমাত্র বিশুদ্ধ অভিনয়ধারা বলা হয় না। অভিনয়শিল্পের অতি শৈশব হইতেই ভাষাকেও ইহার বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে একটি বলিয়া গণ্য কর। হইয়া থাকে। | ‘আমার সাজানাে বাগান শুকিয়ে গেল’- এই কথা কয়টি প্রফুল্ল’ নাটকে হাজারবার পড়িয়াও ইহার উচ্চারণের মাধ্যমে অভিনেতা গিরিশচন্দ্র ঘােষ গভীর ব্যথার যে বিশিষ্ট রূপটি প্রকাশ করিতে পারিতেন তাহা অনুমান | করা অসম্ভব। বা সীতা’ নাটকে শিশিরকুমার যেভাবে ‘শত্রু! শত্রু!– বলিয়া লবের গণ্ডে মৃদু-মৃদু আঘাত করিয়া এক জটিল আবেগ সৃষ্টি করিতেন, তাহাও তেমনই না দেখিয়া আন্দাজ করা সম্ভব নহে। এইগুলি ভাষাকে ছাড়াইয়া ভাষার ব্যবহারের উদাহরণ স্বরূপ স্মর্তব্য। অতি পূর্বে, নাট্যকলার যখন কৈশাের, তখন অভিনেতারা অভিনয়ের ক্ষণেই মুখে মুখে সংলাপ তৈয়ারি করিয়া | বলিতেন; ইহা ইওরােপে Commedia dell Artc-র বিশিষ্ট রূপে প্রকর্ষ লাভ করিয়াছিল। মনােমোহন ঘােষের অনুমান, ভারতেও নাট্যপ্রচেষ্টার প্রাথমিক স্তরে এই পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এবং সেই কারণেই তিনি বলেন যে, গ্রীক পদ্ধতি যখন শ্রবণের উপর বেশি মূল্য | দিয়াছে, ভারত তখন দর্শনের উপর। সেইজন্যই বহুদিন হইতে ভারতে নাটকের নাম দৃশ্যকাব্য। কেবলমাত্র আবৃত্তিনির্ভর না হওয়ার জন্যই ভারতবর্ষে | ভাবপ্রকাশের নিমিত্ত অনেক প্রকার অঙ্গিকমুদ্রার প্রচলন হইয়াছিল। বহুযুগ পূর্বেই নাট্যশাস্ত্রে সেই গুলি বিধিবদ্ধ অবস্থায় উল্লিখিত হইয়াছে। যদিও সেই সকল মুদ্রার অনেক গুলিই অজি ভারতীয় অভিনয়ে অপ্রচলিত, তথাপি প্রাচীন মুদ্রার মত কয়েকটি ভঙ্গী এখনও পর্যন্ত সাধারণ ভাবে এ দেশের সর্বত্র ব্যবহৃত হইয়া থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কাহাকেও নিরস্ত করিতে | আমরা দক্ষিণহস্ত উত্তোলন করিয়া যে ভঙ্গী করি তাহা বােধ হয় ভারতের সকল নাট্যমঞ্চে স্বাভাবিক বােধেই প্রযুক্ত হইয়া থাকে, কিন্তু প্রয়ােগকালে কাহারও মনে হয়ত স্বপ্নেও উদিত হয় না যে, এটিও শাস্নােল্লিখিত একটি মুদ্রা ; ইহার নাম পতাক। মুদ্রা এবং আজিও ভারতনাট্যম নৃত্যে ইহা স্বাভাবিকভাবে ব্যবহৃত হইয়া থাকে।

এইরূপ কিছু কিছু মুদ্রা চলিত থাকিয়া গেলেও বহু | মুদ্রাই কিন্তু আমাদের সামাজিক বিবর্তনের ফলে আজ
৯৬