পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/১২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অভিনয় অপরিচিত হইয়া পড়িয়াছে। তাই তাহাদের স্থলে এখন অনেক নৃতন মুদ্রা বা করণেরও উদ্ভব হইয়াছে। যেমন টাকা বুঝাইতে মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে চাপ দিয়া বাজাইবার ভঙ্গী করা বা চিন্তামগ্নতা বুঝাইতে হস্তের উপর মস্তক ন্যস্ত করা। এইভাবে অঙ্গভঙ্গী দ্বারা মনােভাব প্রকাশের যে অজস্র উপায় আছে তাহা আঙ্গিক অভিনয়ের মধ্যে গণ্য হয়। | অভিনয়ের বাচিক অংশ সম্পর্কেও মানুষ বহুযুগ ধরিয়া আলােচনা করিয়াছে। নাট্যশাস্ত্রে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণগুলির উচ্চারণপদ্ধতি খুবই সরল করিয়া বুঝানাে আছে। এবং তাহার পরে বিভিন্ন ছন্দেরও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করিয়া দেওয়া আছে। সর্বোপরি বিভিন্ন ভাবের ও বিভিন্ন রসের প্রকাশে কণ্ঠ কেমন ভাবে ব্যবহৃত হইবে তাহারও বিবরণ দেওয়া আছে। ইওরােপেও অ্যারিস্টটল হইতে বাচিক অভিনয়ের আলােচনা চলিয়াছে। বাংলা রঙ্গমঞ্চেরও অতীত আচার্যগণ নূতন অভিনেতাদের অমিত্রাক্ষর ছন্দ ভাল করিয়া অনুশীলন করাইতেন, যাহাতে তাহাদের উচ্চারণে স্পষ্টতা আসে, ছন্দোবােধ জন্মায় ও স্বর প্রক্ষেপণের ক্ষমতা আয়ত্ত হয়। কিন্তু এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপ প্রাথমিক। কণ্ঠস্বরের যে ক্ষমতায় শিল্পী দুরূহ আবেগময় দৃশ্যের অভিনয়ে মােহবিস্তার করিয়া থাকেন তাহা সংগীতশিল্পীর শিল্পকর্মের মতই। ইহাতে নিজস্ব স্বরগ্রাম জানিতে হয় এবং প্রত্যেক সুর সম্পর্কে আপন কণ্ঠস্বরের আচরণও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানা প্রয়ােজন। যন্ত্রের নিজস্ব আচরণ জানা না থাকিলে যন্ত্ৰী যেমন তাহাকে সম্পূর্ণ ব্যবহার করিতে পারে না, সেইরূপ আপন কণ্ঠস্বরের আচরণও অভিনেতার পক্ষে অবশ্য জ্ঞাতব্য। | আঙ্গিক ও বাচিক অভিনয়ের এই দুই অংশেই শিল্পীদের লক্ষ্য থাকে স্বচ্ছতা লাভ করার দিকে। অর্থাৎ অভিনেয় চরিত্রটির অন্তরকে স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করার দিকে। যদি আঙ্গিক বা বাচিক ভঙ্গী এইরূপ হয় যে তাহার কৌশলটাই লােকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কিন্তু অভিনেয় চরিত্রটির অন্তরকে প্রকাশ করে না, তাহা হইলে সেই অভিনয়কে অস্বচ্ছ বলা চলে। | অভিনয়ের আর একটি অংশ রূপসজ্জা ও চরিত্রোপযােগী সাজ-সরঞ্জাম ব্যবহার করিতে পারা। যেমন, যােদ্ধার ভূমিকা অভিনয়ে তরবারি বহন ও ব্যবহার করিতে পারাও অভিনয়ের অংশ। তেমনই আবার চায়ের দোকানের বয়ের ভূমিকায় চায়ের পাত্র বহন করিতে পারাও অভিনয়ের অংশ।

ভ। ১/১৩

________________

অভিনয় কিন্তু বাহিক সমস্ত প্রকরণের উপর আছে অভিনেতার | সত্তা। সেই সত্তার ব্যবহার ও প্রকাশই হইল অভিনয়ের | কঠিনতম অংশ। এবং সেই অংশের দ্বারাই শিল্পী নিজের গভীরতা ও মহত্ত্ব প্রমাণ করিয়া থাকেন। ইহা যে কি প্রকারে সাধিত হয় সেই সম্পর্কে যুগে যুগে বহু মনীষী বহু প্রকার মত লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। | এই সমস্ত মতের মধ্যে অমিল যেমন প্রচণ্ড, মিলও তেমনই | প্রচুর। সক্রেটিস ও এক আবৃত্তিকারের আলােচনার | যে লিপি প্লেটো বহু প্রাচীন যুগে লিখিয়া গিয়াছেন, | তাহাতে এইরূপ বলা আছে যে, কবি ও তঁাহার | আবৃত্তিকারের অনুপ্রেরণার অস্বাভাবিক অবস্থাতেই নিজ শিল্প সৃষ্টি করিতে সক্ষম হন। সেই সময় হইতে | আধুনিক কাল পর্যন্ত অভিনেতার সৃষ্টির উৎস যে কোথায় | এই সম্পর্কে যেমন বহু মত ব্যক্ত হইয়াছে, তেমনই আবার | প্রতিবাদেরও প্রবল ঝড় উঠিয়াছে। দেনিস দিদেবরা | (Denis Diderot) অভিনয়ের অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য | সম্পর্কে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এক নিবন্ধ লিখিয়াছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীতে ককলা ( Benoit Constant | Coquelin) ও হেনরি আরভিং ( Henry Irving ) | এই তর্কে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। ইহা ব্যতীত বিখ্যাত | ফরাসী অভিনেতা তামা ( Francois Joseph | Talma ) -র প্রায় সমসাময়িক কালে দুইজন বিখ্যাত | অভিনেত্রীর এই সম্পর্কে আলােচনা এবং তাঁহাদের পাশ | কাটাইয়া তার নিজের লিখিত যে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ আছে | তাহা আজিও প্রচুর কৌতূহলের উদ্রেক করে। | রুশ নাট্যাচার্য স্তানিস্লাভস্কি (Constantin Sergey| evich Stanislavsky) প্রতিভাধর অভিনেতাদের | পদ্ধতিটা কি তাহা শিখাইয়াছেন এবং সেই পদ্ধতি | অনুসরণ করিলে ক্ষমতাপন্ন অভিনেতমাত্রেরই সফলতর হইবার সম্ভাবনার কথাও তিনি বলিয়াছেন। | জার্মান নাট্যকার ও নির্দেশক ব্রেখট ( Bertolt | Brecht) আবার স্তানিস্লাভস্কির পদ্ধতির ঘাের বিরােধী। তিনি বলেন, অভিনেতা ও অভিনেয় চরিত্রের মধ্যে | একটা দূরত্ব সকল সময়েই বজায় রাখা প্রয়ােজন। তাহা হইলে দর্শক ভাবাবেগে ভাসিয়া না গিয়া যুক্তি দিয়া সমস্ত জিনিসটি বুঝিবার চেষ্টা করিবে। এই সকল তর্কের এখনও কোনও মীমাংসা হয় নাই। | এবং কোনদিন হইবে কি না তাহাও সঠিক বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যে পারে, সে কেমন করিয়া যেন এত | তর্ক-ঝগড়া সত্ত্বেও পারিয়া যায়, আর রসপিপাসু দর্শকও | অমনি ধন্য ধন্য করিয়া উঠে।

r
৯৭