পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

বাঙ্গলার রাজধানী ছিল, ততদিন কিরীটেশ্বরীর গৌরবের সীমা ছিল না; বাঙ্গলার রাজা-মহারাজগণ, বণিক-মহাজনবৃন্দ রাজধানীতে সমাগত হইলেই কিরীটেশ্বরী-দর্শনে গমন করিতেন। তৎকালে কিরীটেশ্বরী এতদঞ্চলে মহাতীর্থভূমি ছিল। এক্ষণে কলিকাতা ভারত সাম্রাজের রাজধানী বলিয়া, কালীঘাটে যেরূপ অবিরত উৎসব হইয়া থাকে, মুর্শিদাবাদের গৌরবের সময় কিরীটেশ্বরীও তদ্রুপ নিত্যোৎসবময়ী ছিলেন। তখন রাজধানীর নহবতাদি বাদ্যধ্বনি কিরীটেশ্বরীর শঙ্খঘণ্টারোলের সহিত বিমিশ্রিত হইয়া প্রসন্নসলিলা ভাগীরথীকে তালে তালে নৃত্য করাইত। যেমন মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হইলে, লোকে আনন্দ-উৎসাহে পূর্ণ হইয়া উঠিত, সেইরূপ কিরীটেশ্বরীর দর্শনমাত্র তাহাদিগের হৃদয় শান্ত ভাবে ভরিয়া যাইত। এক দিকে যেমন রাজকর্মচারিগণ কার্যব্যপদেশে প্রতিনিয়ত নগরমধ্যে যাতায়াত করিতেন, সেইরূপ অপর দিকে দেবীর পাণ্ডাগণ যাত্রীর অন্বেষণ ও মায়ের সেবার আয়োজনে বহির্গত হইতেন। এইরূপ ঘোরকোলাহলময়, উদ্যমময়, উৎসাহময়, নগরের নিকটে কিরীটেশ্বরী অবস্থিতি করায়, তাহার মধ্যে ধর্মভাব ও শান্তভাব অনুপ্রাণিত করিয়া মুর্শিদাবাদকে মধুর করিয়া তুলিতেন। মুর্শিদাবাদের নবাবগণের নিকটও কিরীটেশ্বরীর মহিমা অবিদিত ছিল না। নবাব মীরজাফর খাঁ তাহার প্রিয় ও বিশ্বাসী মন্ত্রী মহারাজ নন্দকুমারের অনুরোধে অন্তিম সময়ে কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত পান করিয়া, চিরদিনের জন্য নয়ন মুদ্রিত করিয়াছিলেন।[১] এখন আর সেদিন নাই,—মুর্শিদাবাদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহারও মহিমা যেন বিলীন হইতে চলিয়াছে। ভবানীর প্রিয়পুত্র নাটোররাজ রামকৃষ্ণ যেসময়ে রাজকার্যোপলক্ষে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হইতেন, সেই সময়ে তিনি সাধনার জন্য কিরীটেশ্বরীতে গমন করিতেন। এই সময়ে বঙ্গাধিকারিগণের অবস্থা হীন হইতে আরম্ভ হওয়ায়, তিনি মন্দিরাদির সংস্কার করিয়া দেন। বৈদ্যরাজ রাজবল্লভের স্থাপিত দুইটি শিবমন্দির এখনও বিদ্যমান আছে। কিন্তু কিরীটেশ্বরীর মন্দিরগুলি যেরূপ জীর্ণ হইয়াছে, তাহাতে যে, সে-সমস্ত অচিরাৎ ভগ্নস্তুপে পরিণত হইবে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। বর্তমান সময়ে বঙ্গাধিকারিগণের অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে; বিশেষত, কিরীটেশ্বরী এক্ষণে তাঁহাদের হস্তে নাই। ইহার আর সংস্কার হইবে কিনা জানি না।[২] যদি কখনও মুর্শিদাবাদ পূর্বগৌরবের ছায়ামাত্র প্রাপ্ত হয়, আবার যদি শিল্প-বাণিজ্যে তাহার গৌরবজ্যোতিঃ দেশবিদেশে বিকীর্ণ হইতে থাকে, তাহা হইলে কিরীটেশ্বরীর কিরীটভ্রষ্ট রত্ন পুনঃস্থাপিত হইলেও হইতে পারে, কিন্তু সে আশা সুদূরপরাহত।

  1. Seir Mutaqherin (English Translation)Vol. II, p. 342.
  2. কাশীমবাজারের দেশহিতৈষী মহারাজ মনীন্দ্রচন্দ্র কিরীটেশ্বরীর মন্দির-সংস্কারের চেষ্টা করিতেছিলেন।
    মহারাজ মনীন্দ্রচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁহার উত্তরাধিকারিগণ মন্দিরের কিছু সংস্কার করিয়াছেন।