পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
কিরীটেশ্বরী

কিরীটেশ্বরীর প্রতি বাঙ্গলার সম্ভ্রান্তবংশীয়দিগের দৃষ্টি নিপতিত হয়। দর্পনারায়ণ কিরীটেশ্বরীর জঙ্গল পরিষ্কার করিয়া গুপ্তমঠ নামে তাহার প্রাচীন মন্দিরটির সংস্কার এবং কিরীটেশ্বরীর বৃহৎ মন্দির, শিব ও ভৈরব মন্দির প্রভৃতি নির্মাণ করিয়াছিলেন। কিরীটেশ্বরীর মন্দিরাভ্যন্তরে কালীঘাটাদির ন্যায় কোন স্পষ্ট প্রতিমূর্তি নাই; কেবল একটি উচ্চবেদী ও তাহার পশ্চাতে একখণ্ড বিশাল প্রস্তর ভিত্তির ন্যায় নানাবিধ শিল্পকার্যে অলঙ্কৃত হইয়া, উচ্চভাবে অবস্থিতি করিতেছে; দেবীর কেবল মুখমাত্র বেদীর উপরে অঙ্কিত। বেদীর নিম্নে বসিবার স্থান ও চতুষ্পার্শ্বস্থ গৃহভিত্তির কতক দূর পর্যন্ত কৃষ্ণমর্মর প্রস্তরমণ্ডিত; মন্দিরের সম্মুখে একটি বিস্তৃত বারাণ্ডা আছে। শিবমন্দিরমধ্যে কৃষ্ণপ্রস্তরখোদিত শিবলিঙ্গ ও ভৈরবমন্দিরে কষ্টিপ্রস্তরনির্মিত ভৈরবমূ্র্তি অবস্থান করিতেছেন।[১] এতদ্ভিন্ন আরও দুই-একটি মন্দির ইহার নিকট জীর্ণাবস্থায় বিদ্যমান আছে। এই সমস্ত মন্দিরের নিকট দর্পনারায়ণ রায় কালীসাগর নামে একটি বৃহৎ পুষ্করিণী খনন করিয়া দেন। পুষ্করিণীটি যেমন বৃহৎ, সেইরূপ গভীরও ছিল; মন্দিরের নিকট উহা কষ্টিপাথরনির্মিত সোপানাবলীর দ্বারা অলঙ্কৃত হয়; এক্ষণে তাহদেরও ভগ্নাবশেষ দৃষ্ট হইয়া থাকে। পুষ্করিণী শৈবাল ও পংকে পরিপূর্ণ, জলও অপেয়। দর্পনারায়ণ কিরীটেশ্বরী মেলার সৃষ্টি করেন। এই মেলা উপলক্ষে নানাস্থান হইতে যাত্রীর সমাগম হইত। দোকানপসারিতে পরিপূর্ণ হইয়া, কিরীটকণা অত্যন্ত গৌরবময়ী মূর্তি ধারণ করিত। অদ্যপি পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবারে উক্ত মেলা বসিয়া থাকে, কিন্তু এক্ষণে তাহা প্রাণহীন। বর্ষাকালে কিরীটেশ্বরী গমনের পথ কৰ্দমে পরিপূর্ণ হওয়ায়, লোকের গমনাগমনের বিলক্ষণ অসুবিধা ঘটিত। সেই অসুবিধা নিবারণের জন্য দর্পনারায়ণের পুত্র শিবনারায়ণ পথের সংস্কার ও একটি সেতু নির্মাণ করিয়া দেন; তাহার চিহ্ন অদ্যাপি দৃষ্ট হইয়া থাকে; এক্ষণে তাহ জঙ্গলপূর্ণ ও বৃক্ষাদির দ্বারা আচ্ছাদিত। শিবনারায়ণ মন্দিরাদিরও সংস্কার করিয়াছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বকাল হইতে কোম্পানীর সময় পর্যন্ত শিবনারায়ণের পুত্র লক্ষীনারায়ণ কাননগো ছিলেন, তিনি সাধ্যানুসারে কিরীটেশ্বরীর সেবার যত্ন করিতেন। তাহার পর মুর্শিদাবাদ রাজধানীর গৌরব অন্তহিত হইয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়, যে-সময় পলাশীর সমরক্ষেত্রে মুসলমান রাজলক্ষীর কিরীট স্খলিত হইয়া ভূতলে পতিত হয়, সেই সময় কিরীটেশ্বরীরও কিরীট শিথিল হইতে আরম্ভ হয়। পরিশেষে বঙ্গাধিকারিগণের দুর্দশা উপস্থিত হওয়ায়, তাঁহারও গৌরবের হ্রাস হইতে আরম্ভ হইয়াছে।

 এইরূপে ক্রমে ক্রমে কিরীটেশ্বরীর গৌরব লোপ পাইতে পাইতে অধুনা তাঁহার নামটিকে বহুকালশ্রুত প্রবাদবাক্যের ন্যায় করিয়া তুলিয়াছে। যত দিন মুর্শিদাবাদ

  1. এই ভৈরব ধ্যানী বুদ্ধমূতি, বুদ্ধ ভৈরবরূপে পূজিত হইতেছেন। মুর্শিদাবাদের ইতিহাস দেখ।