পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১২
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

খাঁ বাঙ্গলার নবাব হইয়া মুর্শিদাবাদে অবস্থিতি করিতেছিলেন, সেই সময়ে উদয়নারায়ণের প্রতি এক বিস্তীর্ণ জমিদারি-শাসনের ভার ছিল। সমগ্র রাজসাহী চাকলা তাঁহার দ্বারা শাসিত হইত। তাঁহার জমিদারি পদ্মার উভয় পারে বিস্তৃত ছিল। বর্তমান মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, সাঁওতালপরগণা এবং রাজসাহীবিভাগস্থ দুই-একটি জেলার অধিবাসিগণ তাঁহাকে রাজস্ব প্রদান করিত। তাঁহার সমস্ত জমিদারির নামই রাজসাহী।[১] এক্ষণে মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলায় রাজসাহী নামে এক-একটি পরগণা দৃষ্ট হয়, এবং তাহাও উদনারায়ণের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলতঃ তাঁহার জমিদারী যে পদ্মার উভয় পারে বিস্তৃত ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। বিশেষতঃ মুর্শিদাবাদে তাঁহার জন্ম হওয়ায়, এতদঞ্চলের রাজস্ব তাঁহার দ্বারা সংগৃহীত হইত। জমিদারগণের প্রতি অত্যন্ত অবিশ্বাস থাকায়, নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ কতিপয় আমীন নিযুক্ত করিয়া, তাঁহাদের দ্বারা রাজস্ব আদায় করিতেন। কেবল দুই-একজন কার্যদক্ষ জমিদারের প্রতি অনুগ্রহ করিয়া নবাব রাজস্ব সংগ্রহের ভার তাঁহাদের উপর অপর্ণ করিয়াছিলেন। রাজা উদয়নারায়ণ তাঁহাদের অন্যতম। বহুদূর বিস্তৃত জমিদারী অবাধে শাসন করায় এবং শাসনকার্যে অত্যন্ত সুনাম থাকায়, নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ তাঁহার প্রতি প্রথমে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন।

 নবাব মুর্শিদকুলী যাঁহার উপর সন্তুষ্ট হইতেন, তিনি যে কিরূপ উপযুক্ত লোক, তাহা বলা বাহুল্য মাত্র; কারণ তাঁহার ন্যায় চতুর, সূক্ষ্মবুদ্ধি ও কার্যকুশল ব্যক্তি বাঙ্গলার নবাবদিগের মধ্যে বিরল বলিয়া ঐতিহাসিকেরা উল্লেখ করিয়া থাকেন। উদয়নারায়ণের সৌভাগ্য, তিনি যে মুর্শিদকুলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারিয়াছিলেন। উদয়নারায়ণ নবাব-কর্তৃক ভারপ্রাপ্ত হইয়া প্রাণপণে আপনার কার্য করিতে লাগিলেন; দিন দিন তাঁহার কার্যদক্ষতা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, বাঙ্গলার সমস্ত জমিদারগণের মধ্যে তাঁহারই নাম বিখ্যাত হইয়া উঠিল। নবাব আরও সন্তুষ্ট হইলেন। এই সময়ে উদয়নারায়ণের জমিদারীর মধ্যে কিঞ্চিৎ গোলযোগ উপস্থিত হয়। নবাব তাহা অবগত হইয়া, উদয়নারায়ণের সাহায্যার্থে জমাদার গোলাম মহম্মদ ও কালিয়া জমাদার নামে দুইজন কার্যদক্ষ সেনানীকে নিযুক্ত করিলেন, তাহদের অধীন দুই শত সুশিক্ষিত অশ্বারোহী সৈন্য ছিল। উক্ত দুইজনের প্রতি এইরূপ আদেশ দেওয়া হয় যে, তাহারা রাজার অধীন থাকিয়া সম্পূর্ণভাবে তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করিবে; যখনই যাহা আবশ্যক হইবে উদয়নারায়ণের আদেশপ্রাপ্তিমাত্র তদ্দণ্ডেই তাহা সম্পাদন করিবে। সৈন্যগণ রাজসাহী প্রদেশের চতুর্দিকে গোলযোগ নিবৃত্তি করিতে লাগিল, যে-যে স্থলে গোলযোগের সম্ভাবনা ছিল, অল্পকাল মধ্যে সেই সেই স্থলে শান্তি স্থাপিত হইল।

  1. যাঁহারা মেজর রেনেলের কাশীমবাজার দ্বীপের মানচিত্র দেখিয়াছেন, তাহারা বুঝিতে পারিবেন যে, পদ্মার উভয় পারেই রাজসাহী চাকলা বিস্তৃত ছিল; বর্তমান মুর্শিদাবাদের অধিকাংশই সেই রাজসাহী চাকলার অন্তর্ভূক্ত ছিল।