পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
রাজা উদয়নারায়ণ
১৩

রাজা উদয়নারায়ণের শাসনে এবং গোলাম মহম্মদের কার্যনিপুণতায় রাজসাহী বাঙ্গলার সকল জমিদারীর আদর্শ হইয়া উঠিল। অন্যান্য জমিদারগণ উদয়নারায়ণের পথানুসরণের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ইহাতে নবাবও তাঁহাদিগের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যলক্ষী চিরদিন কাহারও প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন না। এই গোলাম মহম্মদ হইতেই উদয়নারায়ণের ভাগ্যলক্ষীর অন্তর্ধানের সূচনা হইল। গোলাম মহম্মদের কার্য-দক্ষতায় উদয়নারায়ণ এতদূর সন্তুষ্ট হইলেন যে, তিনি তাহাকে অত্যন্ত প্রিয় জ্ঞান করিতে লাগিলেন। এইরূপ অযথা বিশ্বাস হওয়াতেই তাঁহার অধঃপতনের সূত্রপাত হয়।

 গোলাম মহম্মদের জন্য উদয়নারায়ণ ক্রমে ক্রমে দুর্ভাগ্যের ঘোর আবর্তে নিপতিত হইলেন। গোলাম মহম্মদ এতদূর কার্যকুশল ছিল যে, রাজা তাহাকে বিশ্বাস না করিয়া থাকিতে পারিতেন না। তাহার অধ্যবসায় ও উৎসাহে রাজসাহী প্রদেশে উদয়নারায়ণের জমিদারী বদ্ধমূল হইতেছিল, সুতরাং গোলাম মহম্মদ-যে তাঁহার প্রিয় পাত্র হইবে, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে। উদয়নারায়ণ ও গোলাম মহম্মদের ক্ষমতা দিন দিন বৃদ্ধি হওয়ায়, নবাব মুর্শিদকুলী অত্যন্ত চিন্তান্বিত হইলেন। তিনি মনে ভাবিলেন, উদয়নারায়ণ যেরূপ উপযুক্ত রাজা, তাহাতে গোলাম মহম্মদের ন্যায় কার্যকুশল যোদ্ধা তাঁহার সহায় হওয়ায় পরিণামে ঘোর বিপ্লবের সম্ভাবনা। সুতরাং নবাব তাঁহাদের প্রতি কিঞ্চিৎ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন বোধ করিয়াছিলেন। সহসা এক ঘটনা উপস্থিত হইল। রাজার অধীনতায় যে-সমস্ত সৈন্য ছিল, অনেক দিন হইতে তাহারা বেতন প্রাপ্ত হয় নাই। তৎকালে এইরূপ নিয়ম ছিল যে, সৈন্যদিগের বেতন বাকি পড়িলে, তাহারা প্রজাগণের নিকট হইতে উহা গ্রহণ করিবার অনুমতি পাইত। উদয়নারায়ণের সৈন্যগণ তাহাই আরম্ভ করিল। কিন্তু সেই উপলক্ষে রাজসাহী প্রদেশে ঘোর অত্যাচারের স্রোত প্রবাহিত হইল। সৈন্যগণ নিরীহ প্রজাগণকে উৎপীড়ন করিতে লাগিল। নিঃসহায় দরিদ্র প্রজাবর্গ ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল। সংবাদ নবাবের কর্ণগোচর হইলে, তিনি গোলাম মহম্মদ ও উদয়নারায়ণকে এই সুযোগে দমন করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন।

 রাজা উদয়নারায়ণ গোলাম মহম্মদের এতদূর বশীভূত হইয়াছিলেন যে, তিনি সৈন্যগণের অত্যাচারের কোন প্রতিবিধান করেন নাই। নবাব এই ছল পাইয়া, উভয়কেই শাস্তি প্রদানের ইচ্ছা করিলেন; এতদ্ব্যতীত অনেক দিন হইতে রাজসাহী প্রদেশের রাজস্ব প্রেরিত হয় নাই। অচিরে মহম্মদ জান-নামক একজন সৈন্যাধক্ষের অধীনতায় একদল সৈন্য রাজসাহী প্রদেশে প্রেরিত হইল।[১] রাজা উদয়নারায়ণ এই সংবাদে স্তম্ভিত হইলেন; তিনি কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। সামান্য কারণে তাঁহার প্রতি নবাবের বিদ্বেষ-বহ্নি প্রজ্বলিত হওয়ায় তিনি আশ্চর্য

  1. Riyaz-us-salatin, p. 256. মহম্মদ জানের অগ্রে অনেক কুঠারধারী লোক যাইত বলিয়া ইহাকে ‘কুড়ালী’ বলিত। Ibid p.281.