পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
রাজা উদয়নারায়ণ
১৫

ছিলেন। যোদ্ধা বলিয়া রঘুরামের অত্যন্ত প্রতিপত্তি ছিল, সাধারণে তাঁহাকে রঘুবীর বলিয়া জানিত। রঘুনাথ নবাবের আদেশক্রমে লহরীমালের অনুবর্তী হন।

 বীরকিটির নিকটে শিবিরসন্নিবেশের পর, তাহা হইতে বহুদূরে লহরীমাল পাঁচজন মাত্র সৈনিকপুরুষের সহিত রঘুরামকে লইয়া যুদ্ধসংক্রান্ত পরামর্শ করিতেছিলেন, এমন সময় আলি মহম্মদ অসিচর্ম ধারণ করিয়া, অশ্বারোহণে উনিশ জন সৈন্যের সহিত তাঁহাদিগের দিকে অগ্রসর হইল। ইহাতে লহরীমাল নিরতিশয় ভীত হইলেন। তৎকালে আপনাদিগের সৈন্য দূরে অবস্থান করায় তিনি আলি মহম্মদের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে ইচ্ছা করিলেন না। কিন্তু ‘রঘুরাম’ রণবিমুখ হইতে নিষেধ করিয়া লহরীমালকে সাহস প্রদান করিতে লাগিলেন। এমন সময় আলি মহম্মদ নিকটস্থ হইলে রঘুরাম তাহার প্রতি এক তীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করেন। শর বর্ম ভেদ করিয়া আলি মহম্মদের হৃদয়ে বিদ্ধ হইল এবং তাহাকে তৎক্ষণাৎ ভূতলশায়ী করিল। আলী মহম্মদ পিপাসায় কাতর হইয়া উঠিল, রঘুরাম তাহাকে বারি প্রদান করিয়া শুশ্রূষার্থ আপনাদিগের শিবিরে লইয়া যাইতে ইচ্ছা করিলেন; কিন্তু অচিরকাল মধ্যে আলি মহম্মদের প্রাণবায়ুর অবসান হয়।[১] তাহার সৈন্যগণ নেতৃবিহীন হইয়া ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িলে, নবাবসৈন্যগণ তাহাদিগকে আক্রমণ করিল। তাহাতে একটি সামান্য যুদ্ধমাত্র হয়; এই যুদ্ধে নবাবসৈন্যগণ তাহাদিগকে দলিত ও বিধ্বস্ত করিয়া ফেলিল। তারিখ বাঙ্গালা, রিয়াজুস্ সালাতীন ও স্টুয়ার্টের বাঙ্গলার ইতিহাসে কেবল এইমাত্র লিখিত আছে যে, রাজবাটির নিকটে মহম্মদ জানের সহিত উদয়নারায়ণের সৈন্যদিগের একটি যুদ্ধ হয়; তাহাতে গোলাম মহম্মদ নিহত হয়। এই রাজবাটী তাঁহার বীরকিটিস্থ বাসভবন, তাহার নিকটে ও জগন্নাথ গড়ের সম্মুখে এক পার্বত্য প্রান্তরে উভয় পক্ষের যুদ্ধ হয়। এক্ষণে সে স্থানকে মুণ্ডমালা বা মুড়মুড়ের ডাঙ্গা কহিয়া থাকে। তাহার নিকটে অদ্যাপি দগ্ধ কন্দুকাদি পাওয়া যায়। উদয়নারায়ণের পুত্র সাহেবরাম এই যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করিয়াছিলেন।

 গোলাম মহম্মদের মৃত্যু-সংবাদ রাজা উদয়নারায়ণের কর্ণগোচর হইলে, তিনি অনন্যোপায় হইলেন। সেনাপতি ও যাবতীয় সৈন্য বিনষ্ট হইয়াছে; এরূপ অবস্থায় তিনি একাকী কি করিবেন, স্থির করিতে পারিলেন না; একবার মনে করিলেন, যে কিছু অল্প সৈন্য আছে, তাহা লইয়া সমরক্ষেত্রে আত্মবিসর্জন দেন; কিন্তু স্বীয় পরিবারবর্গের অবস্থা স্মরণ করিয়া তাহা হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। তাঁহার এইরূপ বিশ্বাস ছিল, যে তাঁহার মৃত্যুর পর তদীয় পরিবারবর্গ মুর্শিদাবাদে বন্দী হইয়া মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হইবে।[২] সেই বিশ্বাসে রাজা সপরিবারে পলায়ন করিতে বাধ্য হইলেন। তিনি যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিয়া যশোলাভ

  1. ক্ষিতীশবংশাবলিচরিত—দশম অধ্যায়।
  2. প্রচলিত ইতিহাসে বন্দী জমিদারদিগের পরিবারবর্গকে মুর্শিদকুলী খাঁ-কর্তৃক মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার উল্লেখ দেখা যায়। Riyaz-us-salation, p. 256.