বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কাজলরেখা
৩৩৯

 রাজার ছেলে কন্যার কথা মানল না। না মাইন্যা[১] কন্যাকে লইয়া তার বাড়ীর দিকে রওয়ানা হইল। তখন কন্যা কান্‌তে কান্‌তে কইল—

“কোথায় রইল মাও বাপ এমন বিপদকালে।
কেহ না বুঝিবে দুঃখ কান্দিয়া মরিলে॥
সোয়ামী যে বনে দিল জাইন্যা কলঙ্কিনী।
জন্ম হইতে কর্ম্মদোষে আমি অভাগিনী॥
মরার উপরে দুষ্টু এবে তুল্‌ছে খাড়া।
সতী নারী হই যদি সমুদ্রে দেউক চড়া[২]

 অম্‌নি সমুদ্রে চড়া পড়িয়া ডিঙ্গা আটকাইয়া গেল। তখন মাঝি-মাল্লা কইল যে এ ডাকুনী[৩] কন্যা, এর দোষেই এমন অইছে[৪]। এরে এইখানে রাইখ্যা যাই। তখন রাজপুত্তুর উপায়ান্তর না দেইখ্যা কন্যারে ডিঙ্গা থাইক্যা[৫] লামাইয়া[৬] দিল, অমনি ডিঙ্গা আবার জলে ভাস্‌ল। তখন অগত্যা রাজার বন্ধু কন্যাকে এইখানে রাইখ্যাই[৭] নিজের দেশে যাইতে বাধ্য হইল।

গান— 
কাজলরেখা কন্যার কথা এইখানে থইয়া।
রত্নেশ্বর সাধুর কথা শুন মন দিয়া॥

 এর কিছুদিন পরেই ধনেশ্বর সাধু মইরা[৮] যায়। সাধু রত্নেশ্বর তখন বাপের বাণিজ্য-তরণী লইয়া বিদেশে বাণিজ্য করিতে বাইর অইল। নানান দেশে বাণিজ্য কইরা সাধু রত্নেশ্বর যখন বাড়ীত পৌছিব[৯] তখন ঝড়তুফানের মুখে পইড়া সেই চড়ায় ডিঙ্গা লাগাইতে বাধ্য হইল—যেখানে কাজলরেখা কন্যা আইজ ছয়মাস খাগরার রস চিবাইয়া[১০] খাইয়া কোনরূপে প্রাণ বাঁচাইতেছিল। রাত্রকাল গেলে পর পর্‌ভাত বেলায় সাধু রত্নেশ্বর দেখ্‌ল যে সেই চড়ার মধ্যে এক পরমা সুন্দরী কন্যা। এ যে তার নিজের বইন্, তা চিন্তে পার্‌ল না। এই দিকে কাজলরেখা মাত্র চার বৎসরের ভাইকে ঘরে রাখিয়া বনবাসিনী হইয়াছিল, সুতরাং সেও তার আপন ভাইকে চিনিতে পারিল না। অনেক বলিয়া কহিয়া কাজলরেখাকে

  1. মাইন্যা=মানিয়া।
  2. দেউক চড়া=চর ভাসিয়া উঠুক।
  3. ডাকুনী=‘ডাকিনী’র অপত্রংশ।
  4. অইছে=হইয়াছে।
  5. থাইক্যা=থেকে, হইতে।
  6. লামাইয়া=নামাইয়া।
  7. রাইখ্যাই=রাখিয়াই।
  8. মইরা=মরিয়া।
  9. বাড়ীত পৌছিব=বাড়ীতে পৌছিবে।
  10. রস চিবাইয়া=রস খাইয়া।