পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট শব্দতত্ত্ব Գ @ Տ ঠিক ধর্মযুদ্ধ বলে না। এখন সে লইয়া আক্ষেপ করা বৃথা । বাংলায় জল হইতে জোলো, মদ হইতে মোদো, পানি হইতে পানতা, নুন হইতে নোনতা, বঁােদর হইতে বীদরাম, জ্যাঠা হইতে জ্যাঠাম প্রভৃতি চলিত কথাগুলি হইতে উয়া, তা, আম প্রভৃতি প্রত্যয় সংকলন করিয়া ভাবী ব্যাকরণকারের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছিলাম। ব্যাকরণ র্তাহারাই করিবেন, আমার কেবল মজুরিই সার। সেই মজুরির জন্য যে অল্প একটুখানি বেতন আমার পাওনা আছুে বলিয়া আমি সাধারণের কাছে মনে মনে দাবি করিয়াছিলাম, তাহা নামঞ্জর হইয়া গেলেও বিশেষ ক্ষতিবোধ করিতাম না । সম্প্রতি দাড়াইয়াছে এই যে, ভিক্ষায় কাজ নাই, এখন কুত্তা বুলাইয়া লইলে दैऽि । এখন আমার নামে উলটা অভিযোগ আসিয়াছে যে, আমি এই চলিত কথাগুলা ও তাহার প্রত্যয় সংগ্রহে সহায়তা করিয়া বাংলাভাষাটাকেই মাটি করিবার চেষ্টায় আছি । যে-কথাগুলা লইয়া আমি আলোচনা করিয়াছিলাম, তাহাদিগকে বাংলায় রাখা বা বাংলা হইতে । খারিজ করিয়া দেওয়া আমার বা আর-কাহারও সাধ্যই নহে। তাহারা আছে, এবং কাহারও কথায় তাহারা নিজের স্থান ছাড়িবে না । জগতে যে-কোনো জিনিসই আছে, তাহা ছোটো হউক আর বড়ো হউক, কুৎসিত হউক আর সুশ্ৰী হউক, প্রাদেশিক হউক আর নাগরিক হউক, তাহার তত্ত্বনির্ণয় বিজ্ঞানের কাজ । শরীরতত্ত্ব কেবল উত্তমাঙ্গেরই বিচার করে এমন নহে, পদাঙ্গুলিকেও অবজ্ঞা করে না । বিজ্ঞানের ঘূণা নাই, পক্ষপাত নাই । কিন্তু এই বাংলা চলিত কথাগুলি এবং সংস্কৃত-ব্যাকরণনিরপেক্ষ বিশেষ নিয়মগুলির উল্লেখমাত্র করিলেই বাংলাভাষা নষ্ট হইয়া যাইবে, এমন ধারণা কেন হয় । হিন্দুঘরে গ্ৰাম্য আত্মীয়ের, দরিদ্র আত্মীয়েরও তো প্রবেশনিষেধ নাই । যদি কেহ নিষেধ করিতে উদ্যত হয়, তবে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে হয়তো জবাব দেয়, উহারা আত্মীয় বটে কিন্তু কুলত্যাগ করিয়া জাতিভ্ৰষ্ট হইয়াছে। বাংলায় যাহা-কিছু সংস্কৃতের নিয়ম মানে না, তাহাকে একদল লোক কুলত্যাগী বলিয়া ত্যাগ করিতে চান । এবং সংস্কৃতের নিয়মকে বাংলায় সর্বত্রই প্রতিষ্ঠিত করিতে র্তাহাদের চেষ্টা। র্তাহাদের বিশ্বাস, স্বরচিত ব্যাকরণে র্তাহারা সংস্কৃতনিয়মকে জাহির করিলে এবং বাংলা-নিয়মের উল্লেখ না করিলেই, বাংলাভাষা সংস্কৃত হইয়া দাড়াইবে । তাহারা মনে করেন, ‘পাগলাম এবং “সাহেবিয়ান” কথা যে বাংলায় আছে, ও ‘আম এবং ‘আনা’ নামক সংস্কৃতের প্রত্যয় দ্বারা তাহারা সিদ্ধ, এ কথা না তুলিলেই আপদ চুকিয়া যায়— এবং যখন প্রয়ােজন হয়, তখন ‘উন্মত্ততা' ও ইংরাজানুকৃতিশীলত্ব' কথা ব্যবহার করিলেই গ্ৰাম্য কথা দুটার অস্তিত্বই ঢাকিয়া রাখা যাইবে । ) বাংলা ব্যাকরণ যে প্রায় সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইহাই প্রতিপন্ন করিবার জন্য র্তাহারা বাংলার কারক-বিভক্তিকে সংস্কৃত কারক-বিভক্তির সঙ্গে অন্তত সংখ্যাতেও সমান বলিতে চান । । সংস্কৃত ভাষায় সম্প্রদানকারক বলিয়া একটা স্বতন্ত্র কারক আছে, বিভক্তিতেই তাহার প্রমাণ । বাংলায় সে কারক নাই, কর্মকারকের মধ্যে তাহা সম্পূর্ণ লুপ্ত। তবু সংস্কৃত ব্যাকরণের নজিরে যদি বাংলা ব্যাকরণে সম্প্রদানকারক জবরদস্তি করিয়া চালাইতে হয়, তবে এ কথাই বা কেন না বলা যায়। যে, বাংলায় দ্বিবচন আছে। যদি “ধোপাকে কাপড় দিলাম’ কর্ম এবং “গরিবকে কাপড় দিলাম’ সম্প্রদান হয়, তবে একবচনে “বালক, দ্বিবচনে বালকেরা ও বহুবচনেও “বালকেরা না হইবে কেন। তবে বাংলাক্রিয়াপদেই বা একবচন, দ্বিবচন, বহুবচন, ছাড়া যায় কী জন্য। তবে ছেলেদের মুখস্থ করাইতে হয়- একবচন হইল, দ্বিবচন হইল, বহুবচন হইল ; একবচন দিয়াছে, দ্বিবচন দিয়াছে, বহুবচন সন্তাড়নকারক ; “ছেলেকে কোলে লইলাম সংলালনকারক ; সন্দেশ খাইলাম সম্ভোজন-কারক ; মাথা নাড়িলাম সঞ্চালন-কারক এবং এক বাংলা কর্মকারকের গর্ভ হইতে এমন সহস্র সঙের সৃষ্টি