পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যজ্ঞ-কথা ; পশুযাগ ও ইষ্টিযাগ \ככ পশুর সংখ্যা নিদিষ্ট হইয়া গিয়াছিল। কয়টি পশু দিতে হইবে, তাহার সংখ্যা বাধা ছিল । নির্দিষ্ট সংখ্যার অধিক দিবার উপায় ছিল না। নিরূঢ়পশুবন্ধ যাগ --যাহ অবশ্যকৰ্ত্তব্য হইলেও বৎসরের মধ্যে এক বারের, জোর দুই বারের অধিক করিতে হইত না, তাহাতেও একটির অধিক পশুর দরকার হইত না। দেবতার প্রীতির জন্য কাম্য কৰ্ম্মে যাহারা পশু বলি দেয়, তাহারা ইচ্ছামত সংখ্যা বাড়াইতে পারে। এ-কালের দেবীপূজায় গরিব লোকে একটা বলি দেয়। বৈদিক যজ্ঞে কিন্তু ইচ্ছামত পশুর সংখ্যা বাড়াইবার উপায় ছিল না। বড় বড় ধনী লোকের কাম্য যজ্ঞে --অশ্বমেধাদি আড়ম্বরের যজ্ঞে বহু পশু আবশ্ব্যক হইতে পারিত ; কিন্তু সাধারণ গৃহস্থের নিত্যযজ্ঞে বহু পশুর দরকার হইত না । বৈদিক যজ্ঞের পশুহত্যায় একট। মহামারী হইত, এইরূপ মনে করিবার সম্যক হেতু নাই। সেই সময়ে পশুবধে লোকের বিতৃষ্ণ জন্মিতেছিল, ইহা মনে করাই সঙ্গত। প্রাচীন প্রথা একেবারে ত্যাগ করা যায় না—বিশেষতঃ ধৰ্ম্মানুষ্ঠানে। তখন পশুবধ যাহা হইত, তাহা আরও প্রাচীন কালের survival মনে করা যাইতে পারে। পশুর বদলে রুটি দেওয়ার তাৎপৰ্য্যই এই । ব্রহ্মবাদীরা বলিতেছেন—পশুমাংসের বদলে কৃষিজাত যব বা চাউল দিলেই পশু দেওয়ার ফল হইবে । ইহাই নিষ্ক্রয় ; পশুর পরিবৰ্ত্তে নিষ্ক্রয় পুরোডাশ । আমি যে উপাখ্যান শুনাইলাম, তাহাতে ব্ৰহ্মবাদী স্পষ্ট বলিতেছেন, হয়ত এক কালে যজ্ঞে নরমাংস দেওয়াই প্রথা ছিল ; কিন্তু ক্রমশঃ তাহা অপ্রচলিত হইয়া গিয়াছে। নরপশুর বদলে ক্রমশঃ ঘোড়া, গরু, ভেড়া, ছাগল, অবশেষে ধান ও যব চলিত হইয়াছে। ইহাই নিষ্ক্রয়। যজ্ঞের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তিনটি পণ্ডিতী মতের উল্লেখ করিয়াছি ; সমাজের অভিব্যক্তির তিনটা স্তরে তিনটা মত । প্রথম স্তরে দেবতার স্বার্থসাধন করিয়া, দেবতার খোরাক যোগাইয়া তাহার প্রতিসাধন এবং তদার নিজের স্বার্থসাধন। দ্বিতীয় স্তরের উদ্দেশু-কোন কিছু অর্পণ করিয়া দেবতার নিকট বস্ত্যতা স্বীকার। এখানে দেবতার লাভালাভ দেখার দরকার হয় না । কেজো জিনিসের বদলে অকেজো জিনিস দিলেও বিশেষ হানি নাই ; নিষ্ক্রয়স্বরূপে অল্প মূল্যের জিনিস দিলেও চলিতে পারে। মাংসের পরিবর্তে রুটি দিলেও চলিবে । আরও উন্নত তৃতীয় স্তরে স্বার্থ অন্বেষণের স্থানে একবারে স্বার্থত্যাগ আসিয়া পড়ে । ত্যাগটাই তখন মুখ্য উদেহু হইয়ু দাড়ায়। বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে এই অভিপ্রায়টা খুব স্পষ্ট হইয়াছিল দেখা যায়। বেদপন্থীরা এই ত্যাগটাকেই প্রধান্ত দিয়াছিলেন । যাজিকের পরিভাষামতে কোনও দ্রব্য ত্যাগেরই নাম যজ্ঞ । অগ্নি, সোম, ইন্দ্র প্রভৃতির উদ্দেশে যে-কোনও যাগে অধ্বষু যজমানের পক্ষ হইতে আহুতি দিতেন ; যজমান তাহাকে স্পর্শ করিয়া থাকিতেন এবং আহুতির পর ত্যাগমন্ত্র পড়িতেন । ত্যাগমন্ত্ৰ—ইদম অগ্নয়ে—ন মম, ইদং সোমায়—ন মম, ইদম ইস্রায়—ন মম, এইরূপ আকারের। তাৎপৰ্য্য এই যে, দেবতাকে সৰ্ব্বস্ব দিতে হইবে ; যাহ। কিছু প্রিয়তম, তাহাই দিতে হইবে। সৰ্ব্বতোভাবে আত্মসমর্পণ করিতে হইবে। স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রাখিলেই চলিবে না। তবে মানুষে সৰ্ব্বস্ব দিতে পারে না, আত্মসমর্পণ করিতে পারে না :