বিবিধ কথা/জাতির জীবন ও সাহিত্য

উইকিসংকলন থেকে

জাতির জীবন ও সাহিত্য

 উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের পরিচয় করিতে গিয়া এই জাতির সমাজ ও ধর্ম্মজীবন, নৈতিক সংস্কার, পুরুষপরম্পরাগত সাধনার ধারা—তাহার অন্তরের আকৃতি ও বাহিরের দৈন্য, মনের দীপ্তি ও চরিত্রের দুর্ব্বলতা—যে ভাবে জানিবার সুযোগ পাইয়াছি, তাহাতে আজ এই জাতির জন্য আমার এই ক্ষুদ্র হৃদয়ে জাতিস্মরতার বেদনা জাগিয়াছে, এ জাতির বর্ত্তমান দুর্দ্দশা দর্শনে আমি অতিশয় বিহ্বল হইয়াছি। আজ আমি বাঙালী কবি ও বাংলা কাব্যের কথায় উৎফুল্ল হইতে পারিতেছি না, এমন কি, বাংলা সাহিত্যের বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উৎকণ্ঠিত হইলেও, সে চিন্তাও দূর করিয়া আপাতত এই জাতির জীবন-মরণ সমস্যার কথা ভাবিয়া অধিকতর উদ্‌ভ্রান্ত হইয়াছি। বাংলা সাহিত্যের কথা যখন চিন্তা করি, তখন ইহাই ভাবিতে বাধ্য হই যে, যে ভাষা ও যে সাহিত্য আমরা গড়িয়া তুলিয়াছি, এবং আধুনিক ভারতের সংস্কৃতিকে যাহার দ্বারা পুষ্ট করিয়াছি, সেই সাহিত্য ও সেই ভাষা এক শতাব্দী পরে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় হইবে কি না; এত বড় মন্বন্তরের মুখেই যদি পড়িতে হইবে, তবে এই স্বল্প কালের জন্য আমাদের এই জাগৃতি ঘটিল কেন? আমাদের দেশে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথের জন্ম হইল কেন? বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে যখন বয়স অল্প ছিল, প্রবল জীবনানুভূতি যখন মৃত্যুকে স্বীকার করিত না, তখন সে যুগের সেই ঘূর্ণিবাত্যায় বাঙালীর বাস্তুভিটার ভিত্তিমূল যখন টলিতে আরম্ভ করিয়াছিল—আত্ম ও পর উভয়বিধ শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণে যখন ভিতরে ও বাহিরে আগুন লাগিয়াছিল—তখনও আশা করিতাম, এ জাতি মরিবে না; শ্মশানে শব লইয়া সাধন করার অভ্যাস ইহার আছে, তাই বিভীষিকার সকল প্রহরে ইহার প্রাণশক্তি অটুট থাকিবে, ভিখারী হইয়াও সে অমৃতের স্বাদ ভুলিবে না। কারণ, তখনও উনবিংশ শতাব্দীর সেই নবজন্মের ঘটনা দূরবর্ত্তী হয় নাই—বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-বিদ্যাসাগরের করম্পর্শ এ জাতির বক্ষে তখনও শীতল হয় নাই। তাই মনে হইত, যে মাটিতে এই সকল অমর প্রাণ অঙ্কুরিত হইয়াছে, সে মাটিতে জীবনের অমর বীজ নিহিত আছে, মৃত্যু তাহাকে ধ্বংস করিতে পারিবে না। আজ আর সে ভরসা পাইতেছি না; দিকে দিকে মৃত্যুর বাতাস বহিতেছে, জাতির জীবনীশক্তি নিঃশেষ হইয়া আসিতেছে, যেন জীবধর্ম্মও লোপ পাইতেছে।

 কালরাত্রির এই প্রহরে, এই সর্ব্বগ্রাসী অন্ধকারের মধ্যে, ঘোর ঘনঘটাক্ষুব্ধ আকাশতলে দাঁড়াইয়া আমি বাংলা সাহিত্য ও বাঙালী প্রতিভার বর্ত্তমান বা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কি আলোচনা করিব? আমার মত ব্যক্তিও—যে চিরদিন ভাব-চিন্তার জগতে ঘুরিয়াছে, যে জীবনের কর্ম্মশালার ঘর্ষাক্ত ধূলিধূসর দেহের অভিজ্ঞতা সভয়ে বর্জ্জন করিয়াছে— স্বপ্ন ও জাগরণের মধ্যবর্ত্তী একটা জীবনই যাহার কাম্য ছিল—সেও আজ সূক্ষ্ম চিস্তা ও সুক্ষ্ম ভাবের চর্চ্চাকে নিতান্ত নিরর্থক মনে করিতে বাধ্য হইয়াছে। গাছই যদি মরিয়া গেল, তবে ফুলের হিসাবে আর প্রয়োজন কি? ভিটাই যদি উৎসন্ন হইল, তবে পুষ্পোদ্যানের ভাবনা করিয়া কি হইবে? তথাপি একটা কাজ আছে। সাহিত্য তো কেবল কাব্যসৃষ্টিই নয়, ভাষা কেবল বিদ্যারই বাহন নয়। যতক্ষণ শ্বাসপ্রশ্বাস বহিতেছে, ততক্ষণ ভাবনাও আছে, সাহিত্যও শেষ পর্য্যন্ত সেই শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রবাহ। অতএব একালে সকল সাহিত্যচর্চ্চার মূলে থাকিবে জাতির জীবনরক্ষার ভাবনা—মৃত্যুঞ্জয়-মন্ত্রের আরাধনা।

 দেশে অতিশয় বর্ত্তমানে যাহা ঘটিতেছে, তাহার সম্বন্ধে কিছু বলিবার অধিকার আমার নাই, সেদিকে তাকাইলে হৃদয় অবসন্ন হয়। অবস্থা এমন হইয়াছে যে, সে যেন মামুষের হাতে আর নাই—আমরা এখন ভগবানের বা মহাকালের দরবারে বিচারাধীন হইয়াছি। কিন্তু তাহাতেই অভিভূত হইলে চলিবে না, বিনাশের মহাগহবরতীরে দাঁড়াইয়া চৈতন্য হারাইলে চলিবে না। কারণ, মানুষের প্রাণ, কৃতকর্ম্মেরর বিচার বা প্রায়শ্চিত্তের ভয়ঙ্কর মুহূর্ত্তেও জাগ্রত থাকে—আত্মার দুর্ব্বলতা কোন কালেই মার্জ্জনীয় নয়। মৃত্যু যদি অবধারিত হয়, তথাপি মানুষের অধিকার ত্যাগ করিব না; ন্যায় ও সত্যের নিকটে যেমন মস্তক অবনত করিব, তেমনই মানুষের যাহা শ্রেষ্ঠ সম্পদ, সেই প্রেমকে ক্ষুন্ন করিব না। আমার জাতি অপরাধ করিয়াছে—ইহাই যদি সত্য হয়, যদি পাপ করিয়াছে বলিয়া দণ্ডের যোগ্য হয়, তথাপি সেই পাপ ও অপরাধকে স্বীকার করিয়াও, তাহার প্রতি প্রেমহীন হইব না। জাতির মধ্যে যদি একজনও প্রেমিক থাকে, তবে তাহার পুণ্যে সমগ্র জাতি উদ্ধার পাইবে; যদি তাহাও সম্ভব না হয়, তবে মৃত্যুতেও সদ্‌গতি লাভ করিব—এই বিশ্বাসে আমাদের প্রত্যেককে সেই প্রেমের সাধনা করিতে হইবে। আজ এই চরম দুর্গতির দিনেও ভগবানের আশীর্ব্বাদে বিশ্বাস রাখিব, প্রেমের মহাশক্তিকে হৃদয়ের মধ্যে সঞ্জীবিত করিব। ইহাই মৃত্যুঞ্জয়মন্ত্রের সাধনা, এবং সে সাধনার জন্য, অন্যান্য ক্ষেত্রের মত, সাহিত্যের পঞ্চবটবেদিকায় আসন দৃঢ়তর করিবার প্রয়োজন আছে।

 এ সঙ্কটে, সাহিত্যের শরণাপন্ন হইবার প্রয়োজন আরও যে কারণে আছে, তাহাই বলিব। সম্মুখে যে অন্ধকার ক্রমশ ঘনাইয়া উঠিতেছে, তাহাতে নিকট-ভবিষ্যৎও দুর্নিরীক্ষ্য হইয়া উঠিয়াছে। এ অবস্থায় স্বভাবত পশ্চাতে একবার ফিরিয়া চাহিতেই হয়। কিন্তু এ জাতির তেমন ইতিহাস নাই, যাহার দ্বারা উত্তীর্ণ পথের বাধা-বিঘ্ন ও উত্থানপতনের কাহিনী ভাল করিয়া বুঝিয়া লই। তথাপি বহির্জীবনযাত্রার সেই ইতিহাস না থাকিলেও, এ জাতির অন্তর্জীবনের ইতিহাস, তাহার সাহিত্যের স্রোতোধারায়, কালের অক্ষয় তটে উৎকীর্ণ হইয়া আছে। আমি প্রধানত তাহারই সাহায্যে আমার জাতিকে চিনিবার চেষ্টা করিয়াছি। এ কথাও বলিতে বাধা নাই যে, আমি প্রধানত উনবিংশ শতাব্দীর সেই নবজাগরণের সাহিত্যই আলোচনা করিয়াছি এবং তাহা হইতেই আমার মনে এ জাতির বিশিষ্ট চরিত্র ও প্রতিভার ধারণা জন্মিয়াছে। তৎপূর্ব্ব-ইতিহাসে যে আর এক জাগরণ ঘটিয়াছিল, তাহার কথাও জানি; কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর সেই অপূর্ব্ব উদ্দীপ্তির কথা এই সদ্যতম জাগরণের প্রখর আলোকে জন্মাস্তর-স্মৃতির মত কতকটা স্নান হইয়া আছে। এ কথাও সত্য যে, সে ইতিহাস ভাল করিয়া আলোচনা করিবার সুযোগ আমার ঘটে নাই, তাহার উপযুক্ত জ্ঞান-সাধনা আমি করি নাই। তথাপি যেটুকু জ্ঞান জন্মিয়াছে, তাহাতে সে যুগের বাঙালীসমাজের একটা বৃহৎ রেখাচিত্র আমার মনশ্চক্ষুর সম্মুখে সর্ব্বদা বিদ্যমান আছে। সে যুগের বাঙালী-জীবনের সেই শাক্ত ও বৈষ্ণব সাধনার যুগ্মধারার মধ্যে জাতির ধাতুপ্রকৃতির যে পরিচয় পাই, তাহাতে বিস্ময় বোধ করি। স্পষ্ট দেখিতে পাই, শাস্ত্র ও সংহিতার দ্বারা দৃঢ়বন্ধ এক সমাজ—সেই সমাজে অতিশয় স্বাস্থ্যবান ও দীর্ঘায়ু পুরুষপরম্পরা; এক দিকে ভক্তিসাধনার আত্মবিলোপ, অপর দিকে শক্তিসাধনার বজ্রকঠিন মনোবৃত্তি; আচার-অনুষ্ঠানের নাগপাশে যেমন আত্মশাসন—সমাজের হিতার্থে আত্মসংকোচ, তেমনই, ব্যক্তিগত ভাবসাধনার পূর্ণ স্বাধীনতা। সে যুগের রাষ্ট্রীয় অধীনতার মধ্যেই স্বধর্ম্ম বজায় রাখিবার জন্য এ জাতির সেই আগ্রহ—এবং তাহার উপায় উদ্ভাবনে ধর্ম্মে ও সমাজে, ভাবে ও চিন্তায়, প্রতিভা ও মনীষার সেই অভাবনীয় আকস্মিক স্ফুরণ— সে কাহিনী সম্পূর্ণ জ্ঞানগোচর না হইলেও আমি তাহাকে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা করি; উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর নূতনতর আদর্শে দীক্ষিত ও প্রভাবিত হইলেও, আমার চিত্ত সেই পিতৃ-পিতামহগণের মহিমা স্মরণ করিয়া কৃতার্থ হয়। আমি রঘুনাথ, রঘুনন্দন, শ্রীচৈতন্য ও কৃষ্ণানন্দ— সকলের স্মৃতিকে সমভাবে অর্চ্চনা করি। জাতির অতীতকে যে শ্রদ্ধাসহকারে অধ্যয়ন করে নাই, সে আত্মজ্ঞান লাভ করে নাই— তাহার আত্মা জাতিভ্রষ্ট হইয়াই ধর্ম্মভ্রষ্ট হইয়াছে। বিশ্বমানববাদের কোন অর্থ বা মূল্যই নাই, যদি তাহার মূলে জাতিধর্ম্মেরও সুস্থ প্রেরণা না থাকে। যে সমাজের অতীত নাই, সে সমাজ কালস্রোতে শৈবালের মত; তাহার বর্ত্তমানই আছে, ভবিষ্যৎ নাই।


 পূর্ব্বে বলিয়াছি, আমার চিত্তবিকাশ হইয়াছে উনবিংশ শতাব্দীর সেই নবজাগরণের মধ্যাহ্ন-দিবালোকে, আমি জন্মিয়াছিলাম বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-বিদ্যাসাগরের যুগে। তেমন যুগ যে-কোন জাতির ইতিহাসে একটা গৌরবময় যুগ; সে যুগে জ্ঞান কর্ম্ম ও প্রেমের মানুষী-সাধনার জন্য বাংলা দেশে যেন দেবকুল অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। অসংখ্য সাধকের মধ্য হইতে বাঙালী-প্রতিভার এই তিন চূড়া সেদিন বাংলা দেশের আকাশ স্পর্শ করিয়াছিল; এই তিন যুগন্ধরই বাঙালী জাতির জন্য বৃহত্তর জীবনের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছিলেন—ইঁহাদের সহিত সেকালের আর কাহারও তুলনা হয় না। তাই বলিয়া আমি অপর কোন বিশিষ্ট প্রতিভার অসম্মান করিতেছি না। বাংলার উনবিংশ শতাব্দীতে বহু মনীষীর আবির্ভাব হইয়াছিল—তাঁহাদের সাধনমন্ত্র ও সাধনক্ষেত্র সকলের এক ছিল না; না থাকিলেও কেহ কেহ বিশেষ ক্ষেত্রে অপর সকল অপেক্ষা প্রতিভায় শ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য হইতে পারেন; এবং সে প্রতিভা বাঙালীরই, অতএব বাঙালীমাত্রেরই নমস্য। আজ আমি যাঁহাদের বন্দনা করিতেছি, তাঁহাদের প্রতিভার শ্রেষ্ঠত্বই তাহার একমাত্র কারণ নয়—উৎকৃষ্ট চিন্তা, অসাধারণ মেধা বা দৃষ্টিশক্তির তীক্ষতাই তাঁহাদের মহত্ত্বের কারণ নয়। তাঁহাদের সেই প্রতিভার সঙ্গে প্রেম ছিল। কেবল মস্তিক্ষচর্চ্চার মৌলিকতা বা আত্মমতনিষ্ঠার নির্ভীকতাই নয়,—সেই আত্মগত অভিমান অপেক্ষা, তাঁহারা জাতিগত চেতনার উৎকণ্ঠায় অধিকতর উদ্বুদ্ধ হইয়াছিলেন। সাধারণ জনগণের পথেই পথিকের হৃদয়মনের সঙ্গে আপনার হৃদয়ের যোগ রক্ষা করিয়া, তাঁহাদের কেহ—সমাজ ও শিক্ষা, কেহ—পৌরুষ ও উচ্চাভিলাষ, কেহ বা—আধ্যাত্মিক কল্যাণ, এই ত্রিবিধ মার্গের উন্নতিসাধনে প্রাণের সকল শক্তি প্রয়োগ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের প্রতিভার সঙ্গে মহাপ্রাণতার যে অগ্নিদীপ্তি ছিল—হৃদয়ের যে সত্যকার কাতরতা ছিল, তাহাতেই জাতির প্রাণে সাড়া জাগিয়াছিল, সাম্প্রদায়িক চিত্তোৎকর্ষ নয়—সার্ব্বজনীন চেতনার উন্মেষ হইয়াছিল। তাই আজিকার দিনে এই তিন মহাপুরুষের মাহাত্ম্যই ধ্যান করিতে হইবে; তাহাতে এই পরম সত্যের উপলব্ধি করিব যে, ব্যক্তিবিশেষের বিবেক বা আত্মগত সত্যের আদর্শ যত বড় হউক, তাহাতে জাতির কল্যাণ হয় না; কোন একটা আইডিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব মনে মনে স্বীকার করিলে এবং তাহাই প্রচার করিলে, এই একান্ত দেহদশাধীন মানুষের মৃত্যুভয় নিবারিত হয় না। আজ ইহাই প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে যে, নিশ্চিত্র যুক্তি, অত্যুচ্চ ভাব, নিরপেক্ষ সত্য— এ সকলের মূল্য বিশ্বজীবনের পক্ষে এবং ব্যক্তির আত্মার পক্ষে যতই কল্যাণকর হউক, জাতির জীবনে তাহার অতিরিক্ত অনুশীলন তীব্র বিষের মতই ভয়াবহ। আমি আজ যাঁহাদের নাম লইতেছি, তাঁহাদের সাধনা ও সিদ্ধির কথা ভাল করিয়া চিন্তা করিলে দেখা যাইবে, তাহার মূলে ছিল—পরার্থে আত্মোৎসর্গের আকাঙ্ক্ষা; ‘আমি’ নয়, ‘তুমি’— ব্যক্তি নয়, জাতিই ছিল তাহার মূলমন্ত্র।


 আজিকার এই সাহিত্য-সভায় আমি যে অসাহিত্যিক প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছি, তাহার কৈফিয়ং ইতিপূর্ব্বে দিয়াছি। তথাপি আমার এ চিন্তা যে একেবারে সাহিত্যসম্পর্কবজ্জিত নয়, তাহার আভাসও আপনারা পাইয়াছেন। দূর ও নিকট ভবিষ্যতের কথা ভাবিতে না পারিলেও, জাতির এই জীবন-মরণ সঙ্কটের দিনে, আমি যে মৃত্যুঞ্জয়-মন্ত্রের সন্ধান করিয়াছি, তাহার নির্দ্দেশ ও আশ্বাস গত যুগের সাধনার ইতিহাসে আছে। সে ইতিহাস মুখ্যত ভাবসাধনার ইতিহাস, এবং সেজন্য তাহার অধিকাংশ সাহিত্য হইলেও, তাহাতে এই জাতির প্রাণ-ধর্ম্মেরই একঠি পরিচয় পরিস্ফুট হইয়া আছে। আমি এক্ষণে তাহারই সম্বন্ধে সবিস্তারে কিছু বলিব। সে যুগের যে তিন শ্রেষ্ঠ পুরুষের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি, তাঁহাদেরই সাধনায় ও সাধন-মন্ত্রে সেই পরিচয় মিলিবে। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম ও বিবেকানন্দ, ইহারা প্রত্যেকেই প্রাণে যে নূতন ধর্ম্মের প্রত্যাদেশ পাইয়াছিলেন, তাহা, ভারতীয় হিন্দু-সাধনার যে মূল আদর্শ, তাহা হইতে ভিন্ন, কোথাও বা—সেই আদর্শেরই একটা যুগোচিত নূতন প্রবর্ত্তনা। ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ শেষ পর্য্যস্ত আত্ম বা অহংকেই মুখ্য সাধনবস্তু করিয়াছে; তাহাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের চিন্তা, জীবে দয়া, সর্ব্বভূতে সমদৃষ্টির যে তত্ত্বই থাকুক, তাহার মূল লক্ষ্য—ব্যক্তি; সে সাধনা ব্যক্তিকেন্দ্রিক—বহুর উপরে একের প্রতিষ্ঠাই তাহার মূল প্রবৃত্তি। এই অধ্যাত্মবাদ ব্যক্তির স্বতন্ত্র মুক্তিসাধনারই অমুকুল; ইহা একান্তই তত্ত্বপ্রধান ও ভাবতান্ত্রিক—জাগতিক সর্ব্বব্যাপারে অনাসক্তির জন্মদাতা। ইহা মানুষকে—অর্থাৎ পরকে—সর্ব্বজীব বা সর্ব্বভূতের সামিল করিয়া দেখে; মানুষের বাস্তব জীবন-সমস্তা, ব্যথা-বেদনা, কামনা-বাসনা প্রভৃতি দেহদশার নিয়তিকে কোন পৃথক মূল্য দেয় না; মানুষকে মানুষহিসাবেই শ্রদ্ধা কমিয়া তাহাকে ভালবাসার যে মানবধর্ম্ম, তাহা এই ভারতীয় আদর্শে কোন বিশেষ মর্য্যাদা লাভ করে নাই। উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালী জাতির যে নবজাগরণ ঘটিয়াছিল, তাহাতে এই জগৎবিমুখ ব্যক্তিসর্ব্বস্ব আধ্যাত্মিক আদর্শই বিচলিত হইয়াছিল। সেই নব ভাব-বন্যার তিনটি তরঙ্গচূড়া ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিলে বুঝিতে পারা যায়, বাঙালী এই যুগে তাহার জীবনে এক নূতন সত্যের প্রেরণা পাইয়াছিল। সেই ভাব-বন্যার প্রথম বিপুল তরঙ্গ বিদ্যাসাগর; তাঁহার ধর্ম্মে কর্ম্মে, ভাবনা-চিন্তায় আধ্যাত্মিকতার লেশমাত্র ছিল না— কেবল মানব-সেবার—মামুষের ঐহিক কল্যাণ-সাধনের—এক অতি প্রবল কামনা তাঁহার সারা জীবনে যজ্ঞাগ্নির মত জ্বলিয়াছিল। সেই কামনা এমনই সহজাত ও দ্বিধাহীন যে, ভাবিলে আশ্চর্য্য হইতে হয়, এই ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের সন্তান—যাঁহার চিত্ত হিন্দুশাস্ত্র, সাহিত্য ও দর্শনে আজন্ম লালিত হইয়াছিল, যিনি হিন্দু-সংস্কার ও হিন্দু-আচারের দ্বারা আজীবন পরিবেষ্টিত থাকিতে আপত্তি করেন নাই—তিনিই হিন্দুর শিক্ষা হইতে ষড়দর্শনকে বহিষ্কারযোগ্য বলিয়া স্বমত-প্রকাশে কুণ্ঠ বোধ করেন নাই। তাহার একমাত্র কারণ এই যে, মানুষের বাস্তবজীবন-সমস্যার সঙ্গে এইরূপ বিদ্যার কোন সম্পর্ক নাই; বরং ইহার অতিরিক্ত অনুশীলন মানুষকে অমানুষ করিয়া তোলে। মানুষের পক্ষ হইতে এতবড় বিদ্রোহ-ঘোষণা এ সমাজে তাঁহার পূর্ব্বে আর কেহ করে নাই। এই সঙ্গে তাঁহার কীর্ত্তিরাজি স্মরণ করিলেই বুঝিতে পারা যাইবে, কেন বিদ্যাসাগরকেই সেই নবযুগের পূর্ণ প্রতীক বলিয়া মনে হয়।

 এই ধর্ম্মকেই আর এক দিক দিয়া প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি ভাবের ক্ষেত্রকে একটু সঙ্কীর্ণ করিয়া, মানব-সেবার প্রাথমিক ব্রতহিসাবে, একটা জাতি বা গোষ্ঠীচেতনার উদ্বোধন করিয়াছিলেন; এই মানব-প্রেমকেই একটা নির্দ্দিষ্ট দিক্‌-দেশে, তটশালিনী নদীর রূপে, প্রবাহিত করিবার জন্য সমস্ত প্রাণ-মন ও প্রতিভা নিয়োজিত করিয়াছিলেন। এজন্য, তিনি ব্যক্তির স্বতন্ত্র-জীবনকে বৃহত্তর সংঘজীবনে যুক্ত করিয়া, ঐহিক ও পারমার্থিক উভয়বিধ কল্যাণকে একই সাধনার লক্ষ্য করিয়া ‘বন্দে মাতরম্’-মন্ত্র প্রচার করিলেন; এই মন্ত্রে, ব্যক্তিগত ইষ্টসাধনার যে দেবতা, সেই দুর্গা প্রভৃতির স্থানে, জাতি বা গোষ্ঠীর কল্যাণ-রূপিণী দেবতার প্রতিষ্ঠা করিলেন। এই দেবতার নাম—দেশ; বিগ্রহপূজক হিন্দুর জন্য তিনি এমন এক বিগ্রহ নির্ম্মাণ করিলেন, যাহা কোন আধ্যাত্মিক তত্ত্বের প্রতীক নয়; জীবনে প্রতি পদে যাহার সহিত পরিচয়, যাহার মূর্ত্তি রসে ও রূপে সহজে হৃদয়গোচর হয় বলিয়াই সকল কর্ম্মপ্রচেষ্টার সাক্ষাৎ উৎস-স্বরূপিণী হইবার যোগ্য,তাহাকেই তিনি আপন প্রতিভাবলে বাঙালীর একমাত্র ইষ্টদেবতারূপে স্থাপন করিলেন। এ ধর্ম্মেরও মূলে রহিয়াছে সেই এক প্রেরণা—মানব-প্রেম ও মানব-সেবা, সমষ্টির জন্য ব্যাষ্টির আত্মবিসর্জ্জন—সকল অহঙ্কার বা আত্মমমতার উচ্ছেদ। ইহার পর, সে যুগের সেই নব প্রেরণাই বিবেকানন্দে আরও প্রখর উর্দ্ধশিখায় জ্বলিয়া উঠিল; তাহাতে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদকে অস্বীকার না করিয়া—তাহাকে যেন বিপরীত মুখে উলটাইয়া ধরিয়া— অতি তীব্র আধ্যাত্মিক পিপাসাকেই মানব-প্রেমের আকারে শোধন করিয়া লওয়া হইল। আশ্চর্য্য নয় কি? এই তিন মহাপুরুষের জীবনে সেই এক বাণীই বিভিন্ন রূপ ধারণ করিয়াছিল। সে বাণী এই যে—মানুষের চেয়ে বড় আর কিছু নাই; পুরুষের পরম পুরুষার্থসাধনের ক্ষেত্র এই ইহলোক—এই জগৎ ও জীবন; মানুষের মত বাঁচিতে হইলে মানুষকে শ্রদ্ধা করিতে হইবে, সেই শ্রদ্ধা প্রেমে ও সেবায় সার্থক করিয়া তুলিতে হইবে; আত্মচিন্তা ও আত্মসাধনা সকল অনর্থের মূল; পরের জীবনে আপন জীবন মিলাইয়া ধন্য হও—অহংচেতনাকে খর্ব্ব কর। এই তিন জন তিন রূপে এই বাণীকে রূপ দিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর কোন তত্ত্বচিন্তা বা ঐতিহাসিকতার ধার ধারিতেন না। সাক্ষাং যথাপ্রাপ্ত জগতে অতিশয় নিকট ও প্রত্যক্ষ যাহা, তাহারই উপরে তিনি যেন অন্ধবিশ্বাসে আপনার হৃদয়-মনকে প্রচণ্ডভাবে প্রয়োগ করিয়াছিলেন। তাঁহার নিকটে বাঙালীও কেবল মানুষ—বাঙালীজাতি বলিয়া কোন সংস্কার তাঁহার ছিল না। বিবেকানন্দ তাঁহার গুরুর দ্বারা আরও দুরূহ মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়াছিলেন, তাঁহার প্রবল হৃদয়াবেগ একটা বড় তত্ত্বকেই আশ্রয় করিয়াছিল। সে তত্ত্বও তাঁহার গুরুর মূর্ত্তিতে শরীরী হইয়া তাঁহার প্রত্যক্ষগোচর হইয়াছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ মানুষের মনুষ্যত্বকে কোন দিকে ক্ষুন্ন না করিয়া, আধিভৌতিক ও আধ্যাত্মিকের এক অপূর্ব্ব সমন্বয় সাধন করিয়াছিলেন। যে প্রেম ভূমিকে ভূমার সহিত যুক্ত করিয়া এই মর্ত্ত্যজীবনেই মানুষকে মহামহিমার অধিকারী করে—সেই প্রেমকেই বিবেকানন্দ তাঁহার গুরুর মূর্ত্তিতে দেখিয়াছিলেন; তাই তাঁহার জন্মগত অধ্যাত্ম-পিপাসা, ব্যক্তিসাধনার পথে বাধা পাইয়া, মানব-প্রেম ও মানবসেবার বিপরীত মুখে নিয়ন্ত্রিত হইয়াছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ এই সমন্বয়ের অবতার—তাঁহার প্রদর্শিত পথে, ভারতীয় অধ্যাত্মবাদকে বর্জ্জন না করিয়াও, মানুষকে তাহার স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হইয়াছিল।

 যে সঙ্কটের ভাবনায় আমি গত যুগের বাঙালী-প্রতিভার একটি বিশিষ্ট পরিচয় আপনাদের সমক্ষে উপস্থাপিত করিয়াছি, সেই সঙ্কটে, এই তিন যুগন্ধর পুরুষের মধ্যে যাঁহার মনীষা ও প্রতিভা সর্ব্বাপেক্ষা শিক্ষাপ্রদ, সেই বঙ্কিমচন্দ্রের সম্বন্ধে অতঃপর কিছু বিশেষ করিয়া বলিব। বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগরের মত, এই মানব-ধর্ম্মের সহজ সংস্কারবশে, যুগসন্ধির একটা সাক্ষাৎ প্রয়োজন-সাধনে জীবন উৎসর্গ করেন নাই। বিদ্যাসাগর সমাজের ভূত-ভবিষ্যৎ চিন্তা না করিয়া তাহার বর্ত্তমান সম্বন্ধেই পূর্ণ-সচেতন ছিলেন—তাঁহার ভাবিবার সময় ছিল না, তিনি কেবল কর্ম্ম করিয়াছিলেন। তাঁহার সেই মানব-প্রেম কোন চিন্তাভিত্তির সন্ধান করে নাই—সে প্রেমকে জাতির ধর্ম্মরূপে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনবোধ তাঁহার ছিল না। তিনি মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বা চিন্তানায়ক— কোনটাই ছিলেন না; তিনি যেন মানব-প্রেমের সাকার বিগ্রহরূপে সমাজমধ্যে বিচরণ করিয়াছিলেন। এজন্য বিদ্যাসাগর নিজের মধ্যেই নিজে সমাপ্ত, প্রেম ও পৌরুষের একটি অক্ষয় প্রতিমারূপে, এ জাতির পূজা-মন্দিরে বিরাজ করিতেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রও বিবেকানন্দের মত ছিলেন না; তিনি মানব-প্রেমকে দেশ-জাতি-নিরপেক্ষ একটা অত্যুচ্চ আদর্শের প্রভায় মণ্ডিত করিয়া সর্ব্বমানবের উপযোগী সাধনপন্থা আবিষ্কার করিতে প্রবৃত্ত হন নাই। তিনি ছিলেন কবি—কেবল ভাবুক বা ধ্যানী নয়,—শিল্পী ও স্রষ্টা। তাই তিনি তত্ত্ব অপেক্ষা তথ্যের—নির্ব্বিশেষ অপেক্ষা বিশেষের—অনুরাগী ছিলেন। তিনি সর্ব্বমানবের আদর্শকেই, একটা জাতির বিশিষ্ট হৃদয়-মনের উপাদানে, একটা বিশেষ রূপে গড়িয়া তুলিতে চাহিয়াছিলেন। তিনি খাঁটি মানবতার পূজারী, মানবধর্মী ছিলেন বলিয়াই, উচ্চ চিন্তা ও উচ্চ ভাবের নিরাকার-সাধনা সাবধানে পরিহার করিয়াছিলেন—সকল শ্রেষ্ঠ সংগঠনী ও স্বজনী প্রতিভার মত, তাঁহার প্রতিভাতেও তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে প্রখর বাস্তবজ্ঞান ছিল। তিনি এক দিকে যেমন প্রেমহীন যুক্তিবাদ বা আত্মভাবপন্থা পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তেমনই, মহাপ্রেমিক হইলেও— জাতিবর্ণহীন সন্ন্যাসীর আদর্শ তাঁহার আদর্শ হইতে পারে নাই। বিবেকানন্দ মানুষকে তাহার স্বকীয় মাহাত্ম্য উপলব্ধি করিয়া নির্ভয় হইতে বলিয়াছিলেন, কিন্তু তাহাতেও আত্মদর্শন বা অধ্যাত্মজ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রেমকে মানুষের সুস্থ ও সহজ জীবনচেতনায় জাগাইয়া তুলিতে চাহিয়াছিলেন; এজন্য শাশ্বত সত্যের সন্ধানকে আপাতত দূরে রাখিয়া, এমন একটি পন্থা নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন —যাহাতে প্রত্যক্ষ বাস্তবের প্রেরণাই মানুষকে তাহার ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডি হইতে উদ্ধার করিতে পারে। তিনি বাঙালীর মধ্যে মনুষ্যত্বের একান্ত অভাব লক্ষ্য করিয়াছিলেন; পরবর্ত্তী কালের কবির ভাষায়, “শুধু দিনযাপনের প্রাণধারণের গ্লানি,—লাভক্ষতি টানাটানি, অতি ক্ষুদ্র ভগ্ন অংশভাগ, কলহ সংশয়” তাহার জীবনে অতিশয় প্রবল হইতে দেখিয়াছিলেন; অতি হীন স্বার্থপরতাই তাহার অধঃপতনের মূল বলিয়া বুঝিয়াছিলেন। ইহার ঔষধস্বরূপ, স্বজাতি ও স্বদেশ-প্রেমকেই তিনি অপেক্ষাকৃত সহজ অথচ উদার সাধনমার্গ বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস করিয়াছিলেন। এ বিষয়ে তাঁহার দৃষ্টি ঋষির মতই ছিল, তিনিই সর্ব্বপ্রথম সত্যকার যুগধর্ম্মকে ধরিতে পারিয়াছিলেন। মনুষ্যজীবনের মহিমাও তিনি যেমন বুঝিয়াছিলেন, তেমনই ইহাও বুঝিয়াছিলেন যে, এ যুগে মনুষ্যত্ব-সাধনের অন্য পন্থা নাই। অতঃপর উৎকৃষ্ট কবি-প্রতিভার সাহায্যে তিনি ইহাকেই রূপে ও রসে একটি সর্ব্বজনহৃদয়বেদ্য মূর্ত্তি দিয়াছিলেন—মনের উপলব্ধিকে প্রাণের প্রতিমায় পরিণত করিয়াছিলেন। এখানে ইহাও স্মরণ রাখিতে হইবে যে, বঙ্কিমচন্দ্রের এই জাতীয়তা-ধর্ম্ম বা ‘বন্দে মাতরম্’-মন্ত্র বিলাতী ‘ন্যাশনালিজ্‌ম’ নয়; ইহা অতিশয় আধুনিক হইলেও—ইহার মূলে য়ুরোপীয় প্রভাব থাকিলেও, বঙ্কিমের প্রতিভা ইহাকে ভারতীর উপাদানে নূতন করিয়া সৃষ্টি করিয়াছিল। ইহাতে স্থূল বাস্তব বা ব্যবহারিক সত্যের বশ্যতাও যেমন ছিল, তেমনই ভারতীয় হিন্দুমনের শ্রেষ্ঠ আকৃতির কিছুমাত্র লাঘব হয় নাই। ইহাকেই বলে— সৃষ্টি-প্রতিভা! মনীষার সঙ্গে উৎকৃষ্ট কবিদৃষ্টির এই মিলন হইয়াছিল বলিয়াই সে যুগের বাঙালীর ইতিহাসে এমন একটা নবজীবন প্রয়াস সম্ভব হইয়াছিল।

 এমনই করিয়া আমরা সেদিন আসন্ন মন্বন্তরের সূচনামাত্রে মৃত্যুকে জয় করিবার উদ্যম করিয়াছিলাম। এই যে নবধর্ম্মের প্রেরণা, ইহার মূলে ছিল—প্রেম; আত্মদানের মহাব্রতই এই নবধর্ম্মসাধনার নামান্তর। মানুষকে ভালবাসিতে হইবে, কিন্তু আপাতত তাহার সাধন-ক্ষেত্র এই দেশ ও এই সমাজ। এ সাধনার প্রথম সোপান—চিত্তশুদ্ধি; তজ্জন্য নিজ জাতি ও নিজ সমাজের কল্যাণকে একান্তভাবে বরণ করিতে হইবে; তাহাতে জাতি বাঁচিবে, এবং সঙ্গে সঙ্গে তোমারও আত্মার সদ্‌গতি লাভ হইবে। জাতির সেবা করিতে হইলে—তাহার পাপ, তাহার অজ্ঞান, তাহার সকল দুর্গতি ও লাঞ্ছনা আপনার সর্ব্ব অঙ্গে বহন করিতে হইবে; পতিতের পাতিত্যকে ঘৃণা করিলে চলিবে না, সেই পাতিত্যকে নিজেরই পাতিত্য মনে করিয়া অধীর হইতে হইবে। এই প্রেম বিবেকানন্দেরও ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রেম-কল্পনা দেশমাতৃকার একটি মহনীয় মূর্ত্তির ধ্যান ও তাহারই দেশকালসম্মত বিগ্রহ রচনা করিয়াছিল; তিনি সেই মূর্ত্তির প্রতি ভক্তি উদ্রেক করিয়া পঙ্গুকে গিরিলঙ্ঘন করাইতে চাহিয়াছিলেন। বিবেকানন্দের প্রেম জ্ঞানমূলক, বঙ্কিমের ভক্তিমূলক; বঙ্কিমচন্দ্র এ জাতির মর্ম্মের কথা জানিতেন।

 কিন্তু এই ধর্ম্মের সাধনপথে শীঘ্রই বিঘ্ন উপস্থিত হইল। প্রথমত, জাতি মানুষ হইয়া উঠিবার পূর্ব্বেই রাজনৈতিক সংগ্রামে মাতিয়া উঠিল। যাহারা অন্তরে জ্ঞান ও শক্তি লাভ করে নাই, নিঃস্বার্থ জনসেবার দ্বারা যাহাদের চিত্তশুদ্ধি হয় নাই—তাহাদের পক্ষে এই রাজনৈতিক আন্দোলন পরধর্ম্মের মতই ভয়াবহ। আগে সমাজ, পরে রাষ্ট্র—অন্তত জাতির শিক্ষা ও সমাজ কিয়ৎ পরিমাণে উন্নত না হইলে, রাজনীতির আলেয়া যে তাহাকে দিকভ্রান্ত করিবেই, তাহা বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দ উভয়েই জানিতেন; এজন্য তাঁহারা এ বিষয়ে বার বার জাতিকে সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু আমাদের আর তর সহিল না—বঙ্কিম-বিবেকানন্দের বাণীরই এক ভাব-বিকার উৎকট আত্মত্যাগের মোহে জাতিকে উদ্ভ্রান্ত করিয়া তুলিল— প্রবল জীবনানুভূতিই তীব্র সন্ন্যাস ও মৃত্যুপিপাসার নিদান হইল। সেই সময়ে ভাগ্যদোষে এমন সকল নেতা ও শিক্ষাগুরুর আবির্ভাব হইল, যাঁহাদের আত্ম-অভিমান অথবা পর-বিদ্বের জাতি-প্রেমকেও অতিক্রম করিল— জাতির ঐতিহ্য, তাহার গূঢ়তর ভাব-অভাবের সহিত ইঁহাদের পরিচয় ছিল না, জাতির সহিত সামাজিক হৃদয়-বন্ধনও ছিল না। এক দিকে যেমন এই রোচক মিথ্যা বা পরানুচিকীর্ষা প্রসূত আবেগের উত্তেজনা, তেমনই আর এক দিকে, সাহিত্যের আদর্শও ইতিমধ্যে দ্রুত পরিবর্ত্তিত হইতেছিল—সমাজের উপরে ব্যক্তির, বস্তুগত তথ্যের উপরে ভাগবত সত্যের প্রাধান্য বাড়িয়া উঠিতেছিল। শেষে সমাজ ভাঙিতে আরম্ভ করিল; জাতি, গোষ্ঠী বা সংঘের সকল চেতনা লোপ পাইতে বসিল। গত পঁচিশ বৎসর ধরিয়া এই আত্মঘাতী আত্মপরায়ণতা অন্যান্য কারণ সহযোগে দ্রুত প্রসারলাভ করিয়াছে। দারুণ অভাবের তাড়নায়, সমাজের নিম্ন ও মধ্য স্তরে, মনুষ্যত্বের পরাজয় যেমন অনিবার্য্য হইয়া উঠিয়াছে, তেমনই, সমাজের শীর্ষস্থানে বসিয়া সমাজকে রক্ষা করাই ছিল যাঁহাদের স্বাভাবিক অধিকার—সেই ধনী মানী ও শিক্ষিত সম্প্রদায় আজ জাতি ও সমাজ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ দায়িত্বহীন; নৃত্যকলার যে নটমনোভাব, এবং নবতন ব্যক্তিতান্ত্রিক সাহিত্যের যে স্বৈরাচার—একালে তাহাই উৎকৃষ্ট কাল্‌চারের নিদর্শনরূপে, তাঁহাদের দারুণ স্বার্থপরতার আবরণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। চারিত্রিক অধঃপতন হইতে এই যে নূতন ব্যক্তিধর্ম্মের উদ্ভব হইয়াছে, তাহার কাহিনী আমি আর এখানে সবিস্তারে বর্ণনা করিব না—জাতির পক্ষে তাহা গ্লানিকর, ভাগ্যদেবতার পরিহাসরূপে তাহা অসহ্য বেদনাময়। একটু চক্ষু মেলিয়া চাহিলেই দেখা যাইবে, জাতির আত্মবিনাশ-যজ্ঞের সেই অগ্নি এখনও দিগন্ত জুড়িয়া জ্বলিতেছে। আজ আমরা জাতীয়তার নামে শিহরিয়া উঠি; মানবজাতির ইতিহাসে যাহা অতুলনীয়, সেই হিন্দু-সংস্কৃতির উল্লেখ করিতেও আমাদের রসনা অবশ হইয়া উঠে। ইহার কারণ এই নয় যে, আমরা এক্ষণে আরও বড় সংস্কৃতি লাভ করিয়াছি—আমাদের প্রাণে-মনে কোন উদারতর উপলব্ধি ঘটিয়াছে। ইহার এক মাত্র কারণ, আমাদের মনুষ্যত্ব আর বাঁচিয়া নাই, আমাদের চরম অধঃপতন হইয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্র এ জাতির চরিত্রে যে কদর্য্য স্বার্থপরতা দেখিয়া শঙ্কিত, এমন কি হতাশ হইয়াছিলেন, তাহাই আজ নূতন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কাল্‌চারের অনুমোদন পাইয়া নির্লজ্জ তাণ্ডবে মাতিয়া উঠিয়াছে। বড় কথাকে আমরা সাগ্রহে শিরোধার্য্য করিয়াছি, পাছে ছোট কথার অপরিসর গণ্ডিতে আত্মসুখচর্চ্চার ব্যাঘাত হয়। আজ বাঙালীর বিদ্যাসাগর নাই, বঙ্কিমচন্দ্র নাই, বিবেকানন্দ নাই; শিবা ও সারমেয় বেষ্টিত কয়েকটা শশ্মান-প্রহরী মাত্র আছে।

 অপেক্ষাকৃত আধুনিক ইতিহাসে আমাদের নবজীবনলাভের প্রয়াস ও তাহার নিষ্ফলতার কাহিনী সংক্ষেপে আপনাদিগকে শুনাইলাম। ইহা অবশ্য ঘটনা বা তথ্যগত ইতিহাস নয়; কিন্তু জাতির চারিত্রিক কোষ্ঠীবিচারে যে গুরু-বল ও শনির দৃষ্টি—উভয়ের ফলাফল দেখা যায়, আমি সাধ্যমত তাহাই বিচার করিবার চেষ্টা করিয়াছি— ঘটনাগত ফলাফল আপনারা মিলাইয়া দেখিবেন। আপনারা যেরূপ সাহিত্য-সেবায় ব্যাপৃত আছেন, তাহার সহিত জাতির এই ভাগ্যবিপর্য্যয়ের কথাও যেন ভাবনা ও চিন্তার বিষয় হইয়া থাকে। সাহিত্যের সঙ্গে জাতির সর্ব্ববিধ আশা-আকাঙ্ক্ষার যোগ যে কত ঘনিষ্ঠ, তাহা আপনারা জানেন; বাহিরের সংঘাতে জাতির অন্তর্জীবনে যে স্রোতোবেগ বা তরঙ্গভঙ্গ উৎপন্ন হয়, সাহিত্যের উন্নতি-অবনতি মুখ্যত তাহার উপরেই নির্ভর করে। সেই স্রোত যদি রুদ্ধ হইয়া আসে, বাহিরের জগতে যদি সে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে আসিয়া দাঁড়ায়, তাহা হইলে তখন আর সাহিত্যের সাহিত্যিক সমস্যা, ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্বই, কোনও বিদ্বন্মণ্ডলীর একমাত্র গবেষণার বস্তু হইয়া থাকিতে পারে না। তাই আজিকার দিনে আমি সাহিত্য অপেক্ষা জীবনের কথা ভাবিতেছি, সাহিত্যের কলাশিল্প অপেক্ষা তাহার অন্তর্গত পৌরুষ, প্রতিভা ও প্রাণশক্তির সন্ধান লইতে ব্যাকুল হইয়াছি। জাতির ভাষা ও সাহিত্যই তাহার প্রাণশক্তির আধার, সেই আধারেই তাহার শ্রেষ্ঠ সাধনার সিদ্ধিফল সঞ্চিত হইয়া থাকে; কিন্তু অমৃতের সঙ্গে বিষও উৎপন্ন হয়, জীবনের উৎসঙ্গে মৃত্যুর বীজ নিহিত থাকে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক শেষ না হইতেই আমাদের সাহিত্যে সেই মৃত্যুর বীজ অঙ্কুরিত হইয়াছে—জীবনোত্তাপবর্জ্জিত ভাবসৌন্দর্য্যের আরাধনা, আত্মরতির গীত-রস, ও কলাকৌশলময় শব্দবিন্যাসের মোহ আমাদের মেরুদণ্ড শিথিল করিয়াছে— চরিত্রবল হরণ করিয়াছে। এ যুগে সাহিত্যের যে আদর্শ আমাদিগকে মুগ্ধ করিল, তাহা ব্যক্তির মানসবিলাসের অনুকূল; তাহাতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ আত্মীয়তার অবকাশ সঙ্কীর্ণ হইয়া উঠিল; সামাজিকতা ও সমজাতীয়তার যে প্রাণস্পন্দন ও তজ্জনিত যে দায়িত্ববোধ, তাহার পরিবর্ত্তে স্বৈরতন্ত্রের দুর্নীতি, ও আর্টের সর্ব্বসংস্কারমুক্তি অতিরিক্ত প্রশ্রয় পাইল; এবং তাহার ফলে একালে ইহাই যেন সত্য হইয়া উঠিল যে—“for the creative artist the right and wrong of æsthetics are above the right and wrong of morality”। আমাদের মত একটা জাতি, যাহার জীবনই সুস্থ ও সবল হইয়া উঠিতে পারে নাই, যে বহুকালের জড়ত্বের পর সবেমাত্র জাগিয়া উঠিতেছিল, তাহার সাহিত্যে এই তুরীয় ভাব সাধনার ফল যাহা হইবার তাহাই হইয়াছে; সেই সঙ্গে ইহাও চিন্তা করুন যে, এ জাতি স্বভাবতই ভাবপ্রবণ, কর্ম্ম অপেক্ষা স্বপ্নের প্রতিই ইহার আস্থা অধিক; ইহার—সাহিত্যে জীবনের প্রভাব অপেক্ষা, জীবনের উপরেই সাহিত্যের প্রভাব বেশি। এ হেন জাতির পক্ষে ‘right and wrong of morality’ হইতে অব্যাহতি পাওয়ার এমন সুযোগ ব্যর্থ হইতে পারে না। এমনই করিয়া আমরা অবশেষে জীবনকে তুচ্ছ করিয়া মৃত্যুর সাধনা করিয়াছি।

 জাতির যে অবস্থা আমি চিত্রিত করিয়াছি, আপনাদের অনেকের মতে হয়তো তাহাতে কিছু অতিরিক্ত নৈরাশ্যের ছায়া আছে; যদি তাহা সত্য হয়, তবে তাহাতে আমা অপেক্ষা কেহ অধিক সুখী হইবে না। কিন্তু আমি গতযুগের সহিত এ যুগের প্রবৃত্তির তুলনা করিয়া যে সকল দুর্লক্ষণ গণনা করিয়াছি—এবং জাতির যে পরিণাম আজ প্রকট হইয়া উঠিয়াছে, তাহাতে কোথাও আশার স্থল দেখি না। তথাপি এই নৈরাশ্যের মধ্যেও এক আশা আছে, সে আশার কথা সর্ব্বপ্রথমে জানাইয়াছি, এবং তাহারই আশ্বাসে এ পর্য্যন্ত এই দুঃখের কাহিনী আপনাদিগকে শুনাইবার মত সামর্থ্য রক্ষা করিয়াছি। সে আশা এই যে—এমনই দুর্দ্দিনে, এই চরমতম দুর্গতির তলদেশে, জাতির মহাপ্রাণীর নিরুদ্ধ হাহাকার হইতেই শক্তির বিকাশ হইবে; সে শক্তি প্রেমের, এবং প্রেমের বলিয়াই—অলৌকিক। সে শক্তি অসাধ্য সাধন করে, তাহার প্রাণদ মন্ত্রে মরুভূমিতে উৎসবারি শুষ্ক তরুতে মঞ্জরীশোভা, এবং রুক্ষ পাষাণে অঙ্কুরোদ্গম সম্ভব হইয়া থাকে। সেই শক্তির আবির্ভাব হইবে—বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম ও বিবেকানন্দের তপস্যা নিষ্ফল হইবে না। আমাদেরই বংশধর বর্ত্তমান যুব-সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই প্রাণের আভাস ইতিমধ্যেই যেন কিঞ্চিৎ দেখা যাইতেছে। সত্য বটে, বয়স্ক-সমাজ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের আচার-আচরণ লক্ষ্য করিয়া, এবং দেশের মধ্যেই কোন শক্তি বা ধর্ম্মবুদ্ধির আশ্বাস না পাইয়া, তাহারা দেশ ও জাতির গণ্ডি অতিক্রম করিবার প্রয়াসী; তাহাতে যে জীবনের সত্য নাই, ইহাও ঠিক। কিন্তু মতবাদের জড়ধর্ম্মের উপরে হৃদয়ের প্রেমধর্ম্ম যদি জয়ী হয়, তবে এ ভুল শীঘ্রই ভাঙিবে, এবং ইহাদেরই মধ্য হইতে সেই পুরুষের আবির্ভাব হইবে, যাঁহার নিশ্বাস-বায়ুর স্পর্শমাত্রে সমগ্র জাতি সঞ্জীবিত হইয়া উঠিবে। এই সঞ্জীবনী-শক্তির প্রমাণস্বরূপ আমি গত শতাব্দীর সেই সাধনার কথা বলিলাম, মানব-প্রেম ও মানব-সেবার সেই প্রাণগত আদর্শের পরিচয় করিলাম। উত্তরকালে মানব-প্রেমের যে অর্থ দাঁড়াইয়াছে—এ প্রেম তাহা হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ প্রেম আত্মার নামে আত্মপূজা করে না, মানুষকে ভাল না বাসিয়া মহামানবকে ভালবাসে না, ভালবাসা নিষ্ফল হইল দেখিয়া আক্ষেপ ও অনুশোচনায় অধীর হয় না, আপন শুচিতা রক্ষার জন্য সর্ব্বদা কলুষভয়ে ভীত নয়, মুমূর্ষুর শিয়রে বসিয়া তাহার পাপের পরিমাণ চিন্তা করে না। সেরূপ সুক্ষ্মহিসাবী সত্যনিষ্ঠ প্রেমের মোহ হইতে আমি আমার জাতির মুক্তি কামনা করি। তাহার জন্য যে ধরনের সাহিত্যচর্চ্চা আবশ্যক, সকল সাহিত্য-সংসদ যেন তাহারই সহায়তা করেন—এ কালরাত্রির সকল প্রহরে সতর্ক থাকিয়া আমরা যেন সেই মৃত্যুঞ্জয়-মন্ত্রের সাধনা করিতে পারি।

জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৭

[বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ মেদিনীপুর শাখার সপ্তবিংশতিতম বার্ষিক উৎসবে সভাপতির অভিভাষণ]