বিবিধ কথা/সত্য ও জীবন

উইকিসংকলন থেকে

সত্য ও জীবন

 আমরা সকলেই সত্যের অনুরাগী; সত্যের যাহা বিপরীত, অর্থাৎ মিথ্যা, তাহা আমাদিগের মনকে বিমুখ করিয়া তোলে; কথায় ও কাজে আমরা সত্যনিষ্ঠার পক্ষপাতী। কিন্তু এই সত্য কি? জাগতিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক অর্থে ইহার মূল্যভেদ আছে কি না? দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্ম্মশাস্ত্র যে সত্যের সন্ধান বা প্রচার করে, তাহার কোনও প্রয়োজন আছে কি না? এইরূপ প্রশ্ন মনে উদয় হওয়া স্বাভাবিক।

 সত্য ও সত্যবাদ সম্বন্ধে ইংরেজ দার্শনিক বেকন তাঁহার প্রবন্ধের আরম্ভেই লিখিয়াছেন—What is Truth? said jesting Pilate and would not stay for an answer। অর্থাৎ সত্য কি? এই প্রশ্নের উত্তর নাই, অতএব প্রশ্নই বৃথা— সংশয়বাদী Pilate এই কথা বলিয়াছিল। কিন্তু দর্শনে বা বিজ্ঞানে যেমন হউক, ধর্ম্মে ও নীতিশাস্ত্রে সত্যবাদ ও সত্যাচরণের একটা আদর্শ বহুদিন হইতেই নির্দ্দিষ্ট হইয়া আছে। ধর্ম্মগুরু বা সংহিতাকার সামাজিক জীবনযাত্রার আদর্শ যুগে যুগে যতই পরিবর্ত্তন করুন, সত্যের এই নৈতিক মূল্য বা মর্য্যাদা মানুষের সংস্কারে চিরদিন অটুট হইয়া আছে। এই সত্যনিষ্ঠার গৌরবে রামায়ণের নর-চরিত্র দেবতা হইয়া উঠিয়াছেন।

 এই সত্যনিষ্ঠা আদিম বর্ব্বর জাতির মধ্যে আরও অকৃত্রিম, আরও প্রবল। তাহার কারণ, সৃষ্টির মধ্যে যে আত্মরক্ষণ-নীতি আছে, যাহা জীবধর্ম্ম-নীতি, তাহাই এই সত্যনিষ্ঠার মূল। জটিলতর সমাজ-জীবনে উন্নত মনোবৃত্তির প্রভাবে মানুষের এই স্বভাবধর্ম্ম যেমন সজ্ঞান ও সূক্ষ্ম হইয়া উঠিয়াছে, তেমনই ব্যক্তি ও সমাজ এই উভয়ের স্বার্থ যতই পরস্পরবিরোধী হইয়া উঠিয়াছে, ততই যাহা এককালে স্বতঃস্ফূর্ত্ত জৈব প্রবৃত্তি ছিল, তাহাই ক্রমশ স্বার্থসম্বরণমূলক ত্যাগধর্ম্মে পর্য্যবসিত হইয়াছে। এই আদিম সত্যনিষ্ঠার মধ্যে কোনও তত্ত্ব-জিজ্ঞাসা ছিল না; যাহা জানি বলিব, যাহা বলিব তাহা করিব—ইহা যেমন সহজ তেমনই স্বাভাবিক ছিল; সে সমাজে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণ-ধর্ম্মের বিরুদ্ধে কোনরূপ চিন্তার বাধা ছিল না। কিন্তু যখনই সেই বাধা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, তখনই এই সত্যভাষণ ও সত্যাচরণ আর সহজ বা স্বাভাবিক রহিল না; ইহার জন্য আত্মনিগ্রহ, এমন কি আত্মবিসর্জ্জন করারও প্রয়োজন হইল। সেজন্য এক দিকে যেমন ইহার মূল্য বাড়িয়া গেল, তেমনই আর এক দিকে ইহার অর্থ কমিয়া গেল। স্বভাব বা স্বাস্থ্যের জন্যই ছিল যাহার প্রয়োজন, তাহাই একটা নৈতিক আদর্শ-নিষ্ঠায় পরিণত হইল; অর্থাৎ, তাহার দ্বারা কোনও প্রত্যক্ষ কল্যাণ সাধিত না হইলেও—এমন কি অনিষ্ট ঘটিলেও, একটা ব্যক্তিগত কৃচ্ছ্রসাধন বা আত্মনিগ্রহের মহিমাই ইহার একমাত্র অর্থ হইয়া দাঁড়াইল, একটা নৈতিক অহংজ্ঞানই মুখ্য কারণ হইয়া উঠিল।

 অতঃপর এই সত্য-সাধনের মধ্যে মানুষের মনের একটা সূক্ষ্ম অহংকার জড়িত হইয়া গেল—মানুষ আপনার মধ্যে বিবেক নামক যে বস্তুটির আবিষ্কার করিল, তাহা প্রকৃতপক্ষে তাহার নিজেরই উচ্চতর অহংকার। এইরূপে হৃদয়বৃত্তি অপেক্ষা মানসবৃত্তির প্রাধান্য ঘটিল। কারণ, প্রেম এই ন্যায়-অন্যায়-বোধের বিরোধী—অন্যায় বা অসত্য যত বড়ই হোক, প্রেম তাহাকে ক্ষমা করে। কিন্তু যে ব্যক্তি মনে-প্রাণে এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, তাহার পক্ষে কোনরূপ অসত্যের সঙ্গে সন্ধি করা অসম্ভব। মানুষ এই দ্বন্দ্বের নিরসন-চেষ্টাও করিয়াছে, সত্যের সঙ্গে ধৃতি ও ক্ষমাকেও মহাপুরুষ-লক্ষণ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছে। কিন্তু এ সাধনা অতি কঠিন সাধনা,—ইহার মূলে সত্যের যে উপলব্ধি থাকা প্রয়োজন, তাহা জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে একটা বৈরাগ্যমূলক ধারণার উপরেই প্রতিষ্ঠিত। সেখানে এই নৈতিক সত্য বা চরিত্রধর্ম্মের মূল্যও যেমন অল্প, তেমনই, যে প্রেম বলে—“It is really the errors of man that make him lovable”—সেই প্রেমের মোহ নাই বলিলেই হয়।

 “To know all is to pardon all”—এই বাক্যে যে প্রকার জ্ঞানের ইঙ্গিত আছে, সেই জ্ঞানের কাছে সমাজনীতি বা চরিত্রনীতি ছোট হইয়া যায়। পূর্ব্বে বলিয়াছি, সত্যনিষ্ঠার মধ্যে একটা অহঙ্কার আছে, ব্যক্তির একটা স্বাতন্ত্র্য-জ্ঞান আছে; যে ব্যক্তি সত্যনিষ্ঠ, সে যেন সমাজের মধ্যেই দাঁড়াইয়া আপনাকে স্বতন্ত্র মনে করিতে চায়, কারণ, সকলেই তাহার মত সত্যনিষ্ঠ নয়, তাহা সে জানে। কিন্তু পূর্বোল্লিখিত জ্ঞান যাহার হইয়াছে, সে সত্যকে বিশ্বের মধ্যে প্রসারিত করিয়া, সকলকে তাহার অন্তর্গতরূপে দেখে বলিয়া, সকলের সকল ত্রুটিবিচ্যুতির মধ্যে এমন একটা মহানিয়ম আবিষ্কার করে, যাহার জন্য কাহাকেও দায়ী করিতে পারে না। এমন অবস্থায় ‘মরালিটি’কে সে একটা সংস্কার বলিয়াই মনে করে; একেবারে নিষ্প্রয়োজন মনে না করিলেও, সে তাহার একটা সীমা নির্দ্দেশ করিয়া দেয়।

 যে অহং-সংস্কার মানুষের জীবধর্ম্ম, যাহার স্ফূর্ত্তি মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে প্রয়োজন—আদিম সমাজের সত্যনিষ্ঠায় যাহা বীজরূপে বর্ত্তমান ছিল, তাহাই সমাজ-জীবনের জটিলতার প্রভাবে একটা সজ্ঞান নৈতিক আদর্শের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। কিন্তু আরও পূর্ব্ব হইতেই, ইহারই বশে মানুষের প্রাণে আর একটা বৃত্তি জাগিয়াছে, ইহার নাম ভক্তি বা Faith। জগৎ বা জীবন-ব্যাপারের একটা দুর্জ্ঞেয় রহস্য মানুষকে প্রতি পদে অভিভূত করিয়াছে— আপনার অহং-সংস্কারের উপযোগী করিয়া মানুষ যাহাকে ধরিয়া থাকিতে চায়, বাহিরে চতুর্দ্দিকে তাহার বিরুদ্ধ প্রমাণ তাহাকে দিশাহারা করিয়া তোলে। প্রকৃতি যেন প্রতি পদে তাহাকে সাবধান করিয়া দিতেছে—যাহা তোমার জীবধর্ম্মের প্রয়োজন, তাহার অধিক জানিতে চাহিও না। প্রকৃতিপরবশ মানুষ তাহাই স্বীকার করিয়াছে, নিজের অহং-সংস্কার একটা বৃহত্তর অহংকে সমর্পণ করিয়া দুই দিক রক্ষা করিয়াছে। এই পরাজয়মূলক জয়, এই যে আত্মরক্ষার জন্যই আত্মসমর্পণ, ইহারই নাম—Religion। এ প্রবৃত্তি অতিশয় আদিম ও অতিশয় প্রবল। যে নৈতিক সত্যনিষ্ঠার কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি, তাহাতে মানুষ আপনার উপরেই অনেকটা নির্ভর করে, এবং আপনার মত করিয়া একটা যুক্তিবিচারও খাড়া করে, এবং শেষ পর্য্যন্ত বিবেকের দোহাই দেয়। ইহার মধ্যেও প্রকৃতির প্ররোচনা আছে—কেবল, সে তাহা স্বীকার করে না— “অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।” কিন্তু ধর্ম্ম-বিশ্বাসের বলে বলীয়ান মানুষ এই অহংকে বিসর্জ্জন দিয়াই একটি অপূর্ব্ব আত্মপ্রসাদ লাভ করে।

 এই Faith বা ভক্তির মূলে যাহাই থাক, ইহার বশে হৃদয়বৃত্তি জ্ঞানবৃত্তিকে দমন করিয়া রাখে। সত্যনিষ্ঠার মধ্যে যে নৈতিক আদর্শ আছে, তাহাতে সত্য-জিজ্ঞাসা না থাকিলেও একটা ব্যবহারিক সত্যাসত্য-জ্ঞান আছে; ধর্ম্ম-বিশ্বাস অন্ধ, এখানে ‘ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদিস্থিতেন যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি’—অথবা গুরুর আদেশই অভ্রান্ত। ধর্ম্ম-বিশ্বাস ও বিবেক এক নয়—‘হৃদিস্থিত হৃষীকেশ’ বিবেকেরও উপরে। বিবেকের অন্তরালে যে অহং-জ্ঞান আছে, তাহাকেও আবৃত করিয়া এই হৃষীকেশ আপনার আসন পাতিয়াছেন, অর্থাৎ মানুষের ক্ষুদ্র চেতনা বিশ্বচেতনার অঙ্গীভূত হইতে চাহিতেছে। মানসবৃত্তির অনুশীলনে মানুষ আপনাকে প্রকৃতি হইতে স্বতন্ত্র কল্পনা করে, এই স্বাতন্ত্র্য-কল্পনায় বাহিরের সঙ্গে অন্তরের যে বিরোধ অবশ্যম্ভাবী, তাহা হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য মানুষ আর একটা সত্তার আড়ালে আশ্রয় গ্রহণ করে—জানে না, এখানেও সেই প্রকৃতি-পারবশ্য; বাহিরে যাহাকে স্বীকার করে নাই, অন্তরে তাহারই শক্তি ‘হৃষীকেশ’-রূপে তাহাকে জয় করিয়াছে, বুদ্ধি পরাভূত হইয়া একটা অজ্ঞান চেতনার অপূর্ব্ব আবেশে ভক্তিতে পরিণত হইয়াছে। ইহা ধর্ম্ম-বিশ্বাসের এক দিক —অতিশয় ব্যক্তিগত—নিঃসঙ্গ সাধকের অবস্থা। কিন্তু যাহাকে আমরা বহুব্যাপী সামাজিক ধর্ম্ম-বিশ্বাস বলি, তাহার মধ্যে এই অন্তরচেতনা তেমন পরিস্ফুট নয়; সেখানে অহংকার আরও স্পষ্ট—মানুষ গুরুর নামে নিজের অহংকারকে গোপনে তৃপ্ত করে। কারণ, জগতের যাঁহারা ধর্ম্মগুরু, তাঁহারা যে Idea বা তত্ত্ব প্রচার করেন, তাহার মধ্যে একটা অতিশয় কঠিন আত্ম-প্রত্যয় আছে। তাঁহাদের এই আত্ম-বিশ্বাসের অপরিমিত শক্তিই শিষ্যবর্গকে জয় করিয়াছে; সেখানে তত্ত্বটাই বড় নয়, বড় তাঁহাদের সেই Personality, সেই Character। কেবল মাত্র Idea-র মূল্য খুব বেশি নয়, তাহা হইলে ধর্ম্মপ্রচারক অপেক্ষা দার্শনিকের প্রতিপত্তি অনেক বেশি হইত। কিন্তু “If both an Idea and & Character come together, they give rise to events which fill the world with amazement for thousands of years”। তাই, এই সকল গুরুদের বাণী মানুষের মনে কোনও জিজ্ঞাসামূলক সত্যের প্রতিষ্ঠা করে নাই, মানুষকে অন্ধ-বিশ্বাসের বলে বলীয়ান করিয়াছে মাত্র। বাণী অপেক্ষা গুরু বড় হইয়াছে, গুরুর পূজা বাণীতে বর্ত্তিয়াছে। যে যুদ্ধ সত্যকে ব্যক্তিনিরপেক্ষ করিতে চাহিয়াছিলেন, যিনি বার বার উপদেশ দিয়াছিলেন, ‘বুদ্ধ’ কোনও ব্যক্তি নয়, মানুষ মাত্রেরই সাধনার আদর্শ-স্বরূপ একটা Idea—সেই বুদ্ধই পরিশেষে শত সহস্র বিগ্রহ-রূপে পূজা পাইয়াছেন!

 ইহাই মানুষের স্বভাব, ইহাই তাহার ধর্ম্ম। সত্য কি? এ জিজ্ঞাসা মানুষের প্রকৃতিগত নয়; মানুষের প্রকৃতি ও জীবন-যাত্রার সঙ্গে ইহার কোনও সম্বন্ধ নাই। সত্যের যে আদর্শ মানুষের পক্ষে সহজ ও স্বাভাবিক, তাহা কোনও তত্ত্বের ধার ধারে না। জীবধর্ম্মের দুইটা প্রয়োজন—আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসার; এই দুইটির স্বাভাবিক নিয়মে যে নীতির উদ্ভব হইয়াছে, তাহা তত্ত্ববিচারের অধীন নয়। মানুষ যাহা বিশ্বাস করে তাহাই সত্য। এই বিশ্বাস ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত। মানুষ আপনাকে প্রকৃতি হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া যে তত্ত্বজিজ্ঞাসার সূত্রপাত করিয়াছে, তাহা তাহার মনোবৃত্তির বিলাস মাত্র; এই বিলাসকেই যদি সে ধর্ম্ম বলিয়া মনে করে, তবে তাহার স্বাস্থ্যহানি হয়। স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বশে মানুষের একটা স্থূল ঐক্যবুদ্ধি আছে, এই বুদ্ধির দ্বারা মানুষ ভিতরে ও বাহিরে একটা কিছুকে এক করিয়া লইতে চায়—এই একনিষ্ঠার মধ্যে যে সত্য-চেতনা আছে, তাহাই তাহার পক্ষে যথেষ্ট। ইহার বশে আত্মসম্বরণ ও আত্মপ্রসার—এই দুই ধারায় মানুষের জীবন প্রবাহিত হইতেছে। Pontius Pilate যে প্রশ্ন করিয়াছিল—What is Truth? এবং উত্তরের অপেক্ষাও করে নাই—সেই Truth-এর সন্ধান মানুষের একটা মানসিক ব্যাধি মাত্র। মানুষ যে সমস্যার সমাধান করিতে চায়, সে সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে তাহার জীবধর্ম্মের ব্যতিক্রমে; সেই জন্যই জীবনের আলো মৃত্যুর ছায়ায় অন্ধকার হইয়া উঠিয়াছে।

 অতএব মানুষের পক্ষে যদি কোনও সত্য-সমস্যা থাকে, তবে সে প্রকৃতির অনুযায়ী জীবনযাপনের সমস্যা। এই জীবনের আদি-অন্ত রহস্যময়। দূর হইতে এই রহস্য চিন্তা করিবার নয়—এই রহস্যের মধ্যে ঝাঁপ দিয়া নিজেও রহস্যময় হইতে হইবে। সত্য এক নহে, বহু—এ জন্য সকল‍ই সত্য, এবং সকলই মিথ্যা। যেখানে জীবনের স্ফূর্ত্তি, সেইখানেই সত্য। এই স্ফূর্ত্তির কি কোনও নিয়ম আছে? এই বৈচিত্র্যকে ঐক্যসূত্রে বাঁধিবে কে? এই ক্ষণ-সত্যের আদর্শ নির্ণয় করিবে কে? গতি ও প্রবাহই যাহার নিয়ম, মৃত্যুময় জীবনপ্রাচুর্য্যই যাহার ধর্ম্ম—ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্ত্তমান, স্বপ্ন-জাগরণ, স্মৃতি বা বিস্মৃতি যাহার অঙ্গে এতটুকু চিহ্ন রাখে না, তাহার আবার সত্য কি? কোন্ মাপকাঠিতে তাহাকে মাপিবে? ইহার অর্থ করিতে গেলেই—প্রহেলিকা; তত্ত্ব সন্ধান করিলেই—শূন্যবাদ। তাই যাহারা জীবনধর্ম্ম পালন করে, কোনরূপ সত্য-জিজ্ঞাসার মতিভ্রমে যাহারা পড়ে নাই, তাহারাই সত্য পালন করিয়াছে, অজ্ঞানে জ্ঞানীর কাজ করিয়াছে।

 সত্য কি,—প্রাণকে জিজ্ঞাসা কর, বুঝিতে পারিবে। নিজের মধ্যে যে শক্তি যেটুকু আছে, সেই শক্তিটুকুই সত্য; তাহার প্রেরণায় যে জীবধর্ম্ম তোমার পক্ষে স্বাভাবিক, তাহাই সত্য। যে সংস্কার তোমার প্রাণে বদ্ধমূল, তাহাই তোমার স্বধর্ম্ম; আবার যে সংস্কার তোমার প্রাণকে বিচলিত করে, বিদ্রোহী করিয়া তোলে, তাহাই তোমার বিধর্ম্ম। কল্পনা-বিলাস বা তত্ত্ব হিসাবে যাহা তোমার শ্রেয়ঃ, তাহাই সত্য নয়; কারণ, তোমার নিজ চেতনার বাহিরে, কেবলমাত্র চিন্তাহিসাবে, কোনও সত্য নাই; আবার, যাহা তোমার জীবচেষ্টাকে অলস করিয়া দদ্রুকণ্ডূয়নের মত সুখসাধন করে, তাহাও সত্য নয়; কারণ, তাহা স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর। যাহা তুমি বিশ্বাস কর, তাহাই সত্য। সূক্ষ্ম তত্ত্ব, উৎকৃষ্ট যুক্তি বা উদার ভাব—সূক্ষ্ম, উৎকৃষ্ট বা উদার বলিয়াই সত্য নয়; যদি প্রাণে সাড়া না পায়, যদি বিশ্বাস উৎপাদন না করে, তবে তাহাও তোমার পক্ষে মিথ্যা। এই বিশ্বাস অর্থে মনের সম্মতি নয়, ভাববিভোরতাও নয়—প্রাণের মধ্যে শক্তিসঞ্চার। এই বিশ্বাসের প্রমাণ— নিষ্ঠা, অভয় ও একাগ্রতা; নিদ্রালস সুখস্বপ্ন নয়, প্রলাপোক্তি নয়, শক্তিক্ষয়ের সুখলাম্পট্যও নয়। তুমি যাহা বিশ্বাস কর তাহাই সত্য, কারণ, তাহাই তোমার স্বধর্ম্ম। জীবনের স্বাস্থ্যই সত্যের একমাত্র প্রমাণ, সত্যের সত্যহিসাবে আর কোনও মূল্য বা অর্থ নাই।

 তাই মানুষ যখন আপনার সেই প্রাণকে আবৃত করিয়া পরের অনুকরণে আপনাকে সজ্জিত করে, সত্যকে একটা বহির্গত আদর্শ মনে করিয়া এবং আপনা হইতে তাহাকে অতিশয় উচ্চ দেখিয়াই, তাহার রঙে নিজেকে রঙিন করিয়া রাখিতে চেষ্টা করে—বিদ্রোহী বীর বলিয়া পরিচিত হইবার আকাঙ্ক্ষায়, অথবা বহুজন-পূজিত কোনও ব্যক্তির সাদৃশ্যলাভের আশায়, স্বধর্ম্ম ত্যাগ করিয়া পরধর্ম্মের আশ্রয় গ্রহণ করে, তখন সেই মিথ্যার পীড়নে তাহার আত্মা কলুষিত হইয়া উঠে। সারা জীবন একটা অভিনয়ের ভূমিকা রক্ষা করিতে গিয়া সে একটা প্রাণহীন যন্ত্র হইয়া উঠে; বাহিরের প্রতিষ্ঠাই তাহার একমাত্র সম্বল বলিয়া, সে অন্তরে শক্তিহীন হইয়া পড়ে। স্বধর্ম্মের মূল—আত্মস্ফূর্ত্তি, তাহার ফল—বিশ্বাস, ও লক্ষণ— নির্ভীকতা; পরধর্ম্মের মূল—আত্মসঙ্কোচ বা কুণ্ঠা; তাহার ফল আত্মপ্রবঞ্চনা, ও লক্ষণ ভয়। সত্যকে যাহারা তত্ত্ব, শাস্ত্রবিধি বা স্বনুষ্ঠিত পরধর্ম্মের মধ্যে উপলব্ধি করিতে চায়, নিজের প্রাণকে প্রামাণ্য না করিয়া কেবল মনেরই মনরক্ষা করে, জগতে তাহার মত ভাগ্যহত আর কে আছে?

 জগৎ ও জীবনকে মানুষ আপনার প্রাণের মধ্যে আপনার মত করিয়া গ্রহণ করে, তাই জগৎ সম্বন্ধে সকলের মনে একটা সাধারণ ধারণা থাকিলেও, প্রত্যেকের জগৎ স্বতন্ত্র। মন এই প্রাণের সম্বন্ধ স্বীকার না করিয়া জগৎকে ব্যক্তি-নিরপেক্ষ একটা সত্ত্বারূপে ভাবনা করে, তাই দর্শনের সত্য অদর্শন হইয়া উঠে। বিজ্ঞান জড়ের রহস্য ভেদ করিতে চায়, সেও মনের ক্ষুধা, প্রাণের নয়। দুঃশাসন মন প্রকৃতি-দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করিতে চায়,—সে বসন যতই পর্দ্দায় পর্দ্দায় বিচিত্র ও রাশীকৃত হইয়া উঠে, ততই তাহার লালসা বাড়ে; শেষে সে আপনাকে ভুলিয়া যায়, যাদুকরীর যাদুমন্ত্রে আচ্ছন্ন হইয়া ভূতগ্রস্তের মত বিচরণ করে। সত্যকে সেও পায় না, হয়তো শেষে আর চায়ও না—অসংলগ্ন ও অসম্পূর্ণ কতকগুলি তত্ত্ব, জড়শক্তির কতকগুলি ব্যবহারিক নিয়ম আবিষ্কার করিয়া, তাহা হইতেই এমন একটা সিদ্ধান্ত করে, যাহাতে সংশয়ই সত্য হইয়া উঠে; মন প্রথম হইতে যে সত্যের সন্ধান করিয়াছিল, সে সত্যের আশা একেবারেই ছাড়িয়া দিতে হয়। প্রকৃতির অবগুণ্ঠন খুলিতে গিয়া সে এমন একটা যন্ত্রের আভাস পায় যে, গণিতশাস্ত্রই তাহার বেদ হইয়া উঠে। বিজ্ঞান যে-রহস্যের সমাধান করিতে পারে নাই, তাহার রসটুকু বাহির করিয়া দিয়াছে; যন্ত্রের জড়ধর্ম্মই মানুষের জীবন-ধর্ম্মের আদর্শ হইয়া উঠিয়াছে।

 কিন্তু মানুষের প্রাণ এখনও মরে নাই, এবং সম্ভবত কখনও একেবারে মরিবে না, তাই সত্যকে সে আর এক দিক দিয়া উপলব্ধি করিয়া থাকে। এই অসীম বৈচিত্র্য ও বিরোধকে সে প্রাণের দর্পণে প্রতিফলিত করিয়া এক আশ্চর্য্য উপায়ে তাহার মধ্যে একটি ঐক্যরস উপভোগ করে, প্রেমের দ্বারা সে সকল জিজ্ঞাসা ও সকল সংশয় দূর করে; আদি-অন্তের ভাবনা না করিয়া একটি আশ্চর্য্য প্রাণশক্তির বলে সে সুখ-দুঃখ, জয়-পরাজয়, লাভ-ক্ষতিকে যেন একটি গানের সুরে বাঁধিয়া লয়। দর্শন যে প্রশ্ন সমাধান করিতে গিয়া শেষে তাহাকে অস্বীকার করিয়া বসে, বিজ্ঞান যে দুঃখ দূর করিবার আড়ম্বর মাত্র করে—ফলে আরও শতগুণ বৃদ্ধি করিয়া তোলে, সেই দুঃখকে স্বীকার করিয়াই, এই প্রেম তাহাকে নিরস্ত করে। ইহার কারণ কি? প্রেম কোনও সত্যের অধিকারী হইতে চায় না, জগৎ ও জীবনের কোনও অর্থ করিতে চায় না—আপনাকে তাহার নিকটে সমর্পণ করে, বিলাইয়া দেয়। যাহার প্রাণশক্তি যত বেশি, অর্থাৎ যে যত স্বভাবে প্রতিষ্ঠিত, সে এই জগৎ-সমুদ্রে স্নান করিয়া সাঁতার দিয়া ইহার তরঙ্গাঘাত সহ্য করিয়াই তত আনন্দ পায়। যে মানুষের প্রাণে এই আনন্দ আরও ঘনীভূত হইয়া উঠে, তাহার প্রাণে সৃষ্টির বেদনা সঙ্গীতরূপে উৎসারিত হয়, ব্যক্তির সুখ-দুঃখ নির্ব্যক্তিক হইয়া উঠে। এই ব্যক্তির নাম—কবি। ইনি এই আনন্দের সত্যকে রূপ দেন; কিছু বলেন না, কিছু বুঝান না, প্রাণে প্রাণে জানাজানি কানাকানি হয়; যে সত্য জগৎ সৃষ্টিতে প্রচ্ছন্ন রহস্যময় হইয়া রহিয়াছে, মানুষের প্রাণের মধ্যেই সেই রহস্য রসময় হইয়া উঠে। এই রসানুভূতিই সত্যানুভূতি। সত্যের আর কোনও পরিচয় নাই, আর কোনও রূপে তাহাকে জানিবার উপায় নাই।

পৌষ, ১৩৪৫