মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/বিদুরাগমনপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥বিদুরাগমনপর্বাধ্যায়॥

৩৬। হস্তিনাপুরে বিতর্ক

 পাণ্ডবগণ দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন এবং দুর্যোধনাদি লজ্জিত ও ভগ্নদর্প হয়ে ফিরে এসেছেন জেনে বিদুর প্রীতমনে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, ভাগ্যক্রমে কুরুকুলের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। ধৃতরাষ্ট্র ভাবলেন, দুর্যোধনই দ্রৌপদীকে পেয়েছেন। তিনি আনন্দিত হয়ে বললেন, কি সৌভাগ্য! এই ব’লে তিনি দুর্যোধনকে আজ্ঞা দিলেন, দ্রৌপদীর জন্য বহু অলংকার নির্মাণ করাও এবং তাঁকে নিয়ে এস। বিদুর প্রকৃত ঘটনা জানালে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, যুধিষ্ঠিরাদি যেমন পাণ্ডুর প্রিয় ছিলেন তেমন আমারও প্রিয়। তাঁরা কুশলে আছেন এবং শক্তিশালী মিত্র লাভ করেছেন এজন্য আমি তুষ্ট হয়েছি। বিদুর বললেন, মহারাজ, এই বুদ্ধিই আপনার চিরকাল থাকুক।

 বিদুর চ’লে গেলে দুর্যোধন ও কর্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, শত্রুর উন্নতিকে আপনি স্বপক্ষের উন্নতি মনে করছেন। এখন আমাদের চেষ্টা করা উচিত যাতে পাণ্ডবদের শক্তিক্ষয় হয়, যেন তারা আমাদের গ্রাস করতে না পারে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমারও সেই ইচ্ছা, কিন্তু বিদুরের কাছে তা প্রকাশ করতে চাই না। তোমরা কি কর্তব্য মনে কর তা বল। দুর্যোধন বললেন, আমরা চতুর ও বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণদের দ্বারা পাণ্ডবদের মধ্যে ভেদ জন্মাব, দ্রুপদ রাজাকে বিস্তর অর্থ দিয়ে বলব তিনি যেন যুধিষ্ঠিরকে ত্যাগ করেন অথবা নিজ রাজ্যেই তাঁকে রাখেন। দ্রৌপদীর অনেক পতি, তাঁকে অন্য পুরুষে আসক্ত করাও সুসাধ্য। আমরা চতুর লোক দিয়ে ভীমকে হত্যা করাব, সে মরলে তার ভ্রাতাদের তেজ নষ্ট হবে।

 কর্ণ বললেন, তুমি যেসব উপায় বললে তাতে কিছু হবে না। পূর্বে তুমি গুপ্ত উপায়ে পাণ্ডবদের নিগৃহীত করবার চেষ্টা করেছিলে কিন্তু কৃতকার্য হও নি। তারা যখন অসহায় বালক ছিল এবং এখানেই বাস করত তখনই কিছু করতে পার নি। এখন তারা শক্তিমান হয়েছে, বিদেশে রয়েছে, কৌশলপ্রয়োগে তাদের নির্যাতিত করা অসম্ভব। তাদের মধ্যে ভেদ ঘটানোও অসাধ্য, যারা এক পত্নীতে আসক্ত তাদের ভিন্ন করা যায় না। দ্রপদের বহু ধন আছে, ধনের লোভ দেখালে তিনি পাণ্ডবদের ত্যাগ করবেন না। আমার মত এই—পাঞ্চালরাজ যত দিন দুর্বল আছেন, পাণ্ডবরা যত দিন প্রচুর অশ্বরথাদি এবং মিত্র সংগ্রহ করতে না পারে, যে পর্যন্ত কৃষ্ণ যাদববাহিনী নিয়ে পাণ্ডবদের সাহায্যার্থে না আসেন, তার মধ্যেই তুমি বলপ্রয়োগ কর। আমরা বিপুল চতুরঙ্গ সৈন্য নিয়ে দ্রুপদকে পরাজিত করে সত্বর পাণ্ডবদের এখানে নিয়ে আসব।

 ধৃতরাষ্ট্র বললেন, কর্ণ, তুমি যে বীরোচিত উপায় বললে তা তোমারই উপযুক্ত, কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ আর বিদ্যুরের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। এই ব’লে তিনি ভীষ্মাদিকে ডেকে আনালেন। ভীষ্ম বললেন, পাণ্ডুপুত্রদের সঙ্গে যুদ্ধ করা আমার রুচিকর নয়, আমার কাছে ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডু দুইই সমান। দুর্যোধন যেমন এই রাজ্যকে পৈতৃক মনে করে, পাণ্ডবরাও সেইরূপ মনে করে। অতএব অর্ধরাজ্য পাণ্ডবদের দাও। দুর্যোধন, তুমি কুরুকুলোচিত ধর্ম পালন কর। ভাগ্যক্রমে পাণ্ডবগণ ও কুন্তী জীবিত আছেন। যেদিন শুনেছি তাঁরা পুড়ে মরেছেন সেদিন থেকে আমি মুখ দেখাতে পারি না। লোকে পুরোচনকে তত দোষী মনে করে না যত তোমাকে করে।

 দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহাত্মা ভীষ্মের যে মত আমারও তাই। আপনি বহু ধনরত্ন দিয়ে দ্রুপদের কাছে লোক পাঠান, সে গিয়ে বার বার বলবে যে তাঁর সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ হওয়ায় আপনি আর দুর্যোধন অতিশয় প্রীত হয়েছেন। তার পর পাণ্ডবদের এখানে আনবার জন্য দুঃশাসন ও বিকর্ণ[১] সুসজ্জিত সৈন্যদল নিয়ে যান। পাণ্ডবরা এখানে এসে প্রজাদের সম্মতিক্রমে পৈতৃক পদে অধিষ্ঠিত হবেন এবং আপনি নিজের পুত্রের তুল্যই তাঁদের সমাদর করবেন।

 কর্ণ বললেন, মহারাজ, যে ভীষ্ম-দ্রোণ আপনার কাছে ধন মান পেয়ে আসছেন এবং সর্ব কর্মে আপনার অন্তরঙ্গ, তাঁরা আপনার হিতকর মন্ত্রণা দিলেন না এর চেয়ে আশ্চর্য আর কি আছে। যদি আপনাদের ভাগ্যে রাজ্যভোগ থাকে তবে তার অন্যথা হবে না, যদি না থাকে তবে চেষ্টা করেও রাজ্য রাখতে পারবেন না। আপনি বুদ্ধিমান, আপনার মন্ত্রণাদাতারা সাধু কি অসাধু তা বুঝে দেখুন। দ্রোণ বললেন, কর্ণ, তুমি দুষ্টস্বভাব সেজন্য আমাদের দোষ দিচ্ছ। আমি হিতকর কথাই বলেছি, তার অন্যথা করলে কুরুকুল বিনষ্ট হবে।

 বিদুর বললেন, মহারাজ, আপনার বন্ধুরা হিতবাক্যই বলবেন, কিন্তু আপনি যদি না শোনেন তবে বলা বৃথা। ভীষ্ম ও দ্রোণের চেয়ে বিজ্ঞ এবং আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী কেউ নেই, এঁরা ধর্মজ্ঞ অপক্ষপাতী। বলপ্রয়োগে পাণ্ডবদের জয় করা অসম্ভব। বলরাম আর সাত্যকি[২] যাঁদের সহায় কৃষ্ণ যাঁদের মন্ত্রণাদাতা, দ্রুপদ যাঁদের শ্বশুর এবং ধৃষ্টদ্যুম্নাদি শ্যালক, তাঁরা যুদ্ধে কি না জয় করতে পারেন? আপনি দুর্যোধন কর্ণ আর শকুনির মতে চলবেন না, এঁরা অধার্মিক দুর্বুদ্ধি কাণ্ডজ্ঞানহীন।

 ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ভীষ্ম দ্রোণ আর বিদুর হিতবাক্যই বলেছেন। যুধিষ্ঠিরাদি যেমন পাণ্ডুর পুত্র তেমন আমারও পুত্র। অতএব বিদুর, তুমি গিয়ে পঞ্চপাণ্ডব কুন্তী আর দ্রৌপদীকে পরম সমাদরে এখানে নিয়ে এস।

 বিদুর নানাবিধ ধনরত্ন উপহার নিয়ে দ্রুপদের কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার সঙ্গে সম্বন্ধ হওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন; তিনি, ভীষ্ম, এবং অন্যান্য কৌরব আপনার কুশল জিজ্ঞাসা করেছেন। আপনার প্রিয়সখা দ্রোণ আপনাকে গাঢ় আলিঙ্গন জানিয়েছেন। এখন পঞ্চপাণ্ডবকে যাবার অনুমতি দিন। কুরুকুলের নারীগণ পাঞ্চালীকে দেখবার জন্য উৎসুক হয়ে আছেন।

  1. দুর্যোধনের এক ভ্রাতা।
  2. যদুবংশের বীর বিশেষ।