মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/বৈবাহিকপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥বৈবাহিকপর্বাধ্যায়॥

৩৪। দ্রুপদ-যুধিষ্ঠিরের বিতর্ক

 ধৃষ্টদ্যুম্ন যা দেখেছিলেন আর শুনেছিলেন সমস্তই দ্রুপদকে জানিয়ে বললেন, সেই পঞ্চবীরের কথাবার্তা শুনে মনে হয় তাঁরা নিশ্চয় ক্ষত্রিয়। আমাদের আশা পূর্ণ হয়েছে, কারণ, শুনেছি পাণ্ডবরা অগ্নিদাহ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। দ্রুপদ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাঁর পুরোহিতকে পাণ্ডবদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। পুরোহিত গিয়ে বললেন, রাজা পাণ্ডু দ্রুপদের প্রিয় সখা ছিলেন। দ্রুপদের ইচ্ছা তাঁর কন্যা পাণ্ডুর পত্রবধূ হ’ন, অর্জুন তাঁকে ধর্মানুসারে লাভ করুন।

 যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় ভীম পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে পুরোহিতকে সংবর্ধনা করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, পাঞ্চালরাজ তাঁর কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে জাতি কুল শীল গোত্র কিছুই নির্দেশ করেন নি। তাঁর পণ অনুসারে এই বীর লক্ষ্যভেদ ক’রে কৃষ্ণাকে জয় করেছেন। অনুতাপের কোনও কারণ নেই, তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হবে। এমন সময় দ্রুপদের একজন দূত এসে বললে, রাজা দ্রুপদ তাঁর কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে বরপক্ষীয়গণকে ভোজন করাতে চান। অন্ন প্রস্তুত, কাঞ্চনপদ্মচিত্রিত উত্তম অশ্বযুক্ত রথও এনেছি, আপনারা কৃষ্ণাকে নিয়ে শীঘ্র চলুন।

 পুরোহিতকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে পাণ্ডবগণ, কুন্তী ও দ্রৌপদী পাঞ্চালরাজভবনে এলেন। বরপক্ষের জাতি পরীক্ষার জন্য দ্রুপদ বিভিন্ন উপহার পৃথক পৃথক সাজিয়ে রেখেছিলেন, যথা—একস্থানে ফল ও মাল্য, অন্যত্র বর্ম চর্ম অস্ত্রাদি, অন্যত্র কৃষির যোগ্য গো রজ্জু বীজ প্রভৃতি, অন্যত্র বিবিধ শিল্পকার্যের অস্ত্র এবং ক্রীড়ার উপকরণ। দ্রৌপদীকে নিয়ে কুন্তী অন্তঃপুরে গেলেন। সিংহবিক্রম বিশালবাহু মৃগচর্মধারী পাণ্ডবগণ জ্যেষ্ঠানুক্রমে পাদপীঠযুক্ত শ্রেষ্ঠ আসনে উপবিষ্ট হলেন, ঐশ্বর্য দেখে তাঁরা বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। পরিষ্কৃত-বেশধারী দাসদাসী ও পাচকগণ, স্বর্ণ ও রৌপ্যের পাত্রে অন্ন পরিবেশন করলে, পাণ্ডবগণ যথেচ্ছা ভোজন ক’রে তৃপ্ত হলেন। তার পর তাঁরা অন্যান্য উপহার সামগ্রী অগ্রাহ্য ক’রে যেখানে যুদ্ধোপকরণ ছিল সেখানে গেলেন। তা লক্ষ্য ক’রে দ্রুপদ রাজা, তাঁর পুত্র ও মন্ত্রিগণ নিঃসন্দেহ হলেন যে এঁরা কুন্তীপুত্র।

 যুধিষ্ঠির নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, মহারাজ, নিশ্চিন্ত হ’ন, আমরা ক্ষত্রিয়, পদ্মিনী যেমন এক হ্রদ থেকে অন্য হ্রদে যায় আপনার কন্যাও তেমন এক রাজগৃহ থেকে অন্য রাজগৃহে গেছেন। দ্রুপদ বললেন, আজ পুণ্যদিন, অর্জুন আজই যথাবিধি আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করুন। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, আমারও বিবাহ করতে হবে। দ্রুপদ বললেন, তবে আমার কন্যাকে তুমিই নাও, অথবা অন্য কাকে উপযুক্ত মনে কর তা বল। তখন যুধিষ্ঠির বললেন, দ্রৌপদী আমাদের সকলের মহিষী হবেন এই কথা আমার মাতা বলেছেন। আমাদের এই নিয়ম আছে, রত্ন পেলে একসঙ্গে ভোগ করব, এই নিয়ম ভঙ্গ করতে পারি না। দ্রুপদ বললেন, কুরুনন্দন, এক পুরুষের বহু স্ত্রী হতে পারে, কিন্তু এক স্ত্রীর বহু পতি শোনা যায় না। তুমি ধর্মজ্ঞ ও পবিত্রস্বভাব, এমন বেদবিরুদ্ধ লোকবিরুদ্ধ কার্যে তোমার মতি হ’ল কেন? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, ধর্ম অতি সূক্ষ্ম, তার গতি আমরা বুঝি না, প্রাচীনদের পথই আমরা অনুসরণ করি। আমি অসত্য বলি না, আমার মনও অধর্মে বিমুখ, আমার মাতা যা বলেছেন তাই আমার অভিপ্রেত।

 দ্রুপদ, যুধিষ্ঠির, কুন্তী, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি সকলে মিলে বিবাহ সম্বন্ধে বিতর্ক করতে লাগলেন, এমন সময় ব্যাস সেখানে উপস্থিত হলেন। সকল বৃত্তান্ত তাঁকে জানিয়ে দ্রুপদ বললেন, আমার মতে এক স্ত্রীর বহু পতি হওয়া লোকবিরুদ্ধ বেদবিরুদ্ধ। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, সদাচারী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কি ক’রে কনিষ্ঠ ভ্রাতার ভার্যায় উপগত হবেন? যুধিষ্ঠির বললেন, পুরাণে শুনেছি গৌতমবংশীয়া জটিলা সাতজন ঋষির পত্নী ছিলেন; মুনিকন্যা বার্ক্ষীর দশ পতি ছিল, তাঁদের সকলেরই নাম প্রচেতা। মাতা সকল গুরুর শ্রেষ্ঠ, তিনি যখন বলেছেন—তোমরা সকলে মিলে ভোগ কর, তখন তাঁর আজ্ঞা পালন করাই ধর্ম। কুন্তী বললেন, যুধিষ্ঠিরের কথা সত্য, আমি মিথ্যাকে অত্যন্ত ভয় করি, কি করে মিথ্যা থেকে মুক্তি পাব? ব্যাস বললেন, ভদ্রে, তুমি মিথ্যা থেকে মুক্তি পাবে। পাঞ্চালরাজ, যুধিষ্ঠির যা বলেছেন তাই সনাতন ধর্ম, যদিও সকলের পক্ষে নয়। এই ব’লে ব্যাস দ্রুপদের হাত ধ’রে অন্য এক গৃহে গেলেন।

৩৫। ব্যাসের বিধান—দ্রৌপদীর বিবাহ

 ব্যাস দ্রুপদকে এই উপাখ্যান বললেন।—পুরাকালে দেবতারা নৈমিষারণ্যে এক যজ্ঞ করেন, যম তার পুরোহিত ছিলেন। যম যজ্ঞে নিযুক্ত থাকায় মনুষ্যগণ মৃত্যুহীন হয়ে বৃদ্ধি পেতে লাগল। দেবতারা উদ্‌বিগ্ন হয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলে তিনি আশ্বাস দিলেন, যজ্ঞ শেষ হ’লে যম নিজ কার্যে মন দেবেন, তখন আবার মানুষের মরণ হবে। দেবতারা যজ্ঞস্থানে যাত্রা করলেন। যেতে যেতে তাঁরা গঙ্গার জলে একটি স্বর্ণপদ্ম দেখতে পেলেন। ইন্দ্র সেই পদ্ম নিতে গিয়ে দেখলেন, একটি অনলপ্রভা রমণী গঙ্গার গভীর জলে নেমে কাঁদছেন, তাঁর অশ্রুবিন্দু স্বর্ণ পদ্ম হয়ে জলে পড়ছে। রোদনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে রমণী ইন্দ্রকে বললেন, আমার পিছনে পিছনে আসুন। কিছুদূর গিয়ে ইন্দ্র দেখলেন, হিমালয়শিখরে সিদ্ধাসনে ব’সে এক সুদর্শন যুবা এক যুবতীর সঙ্গে পাশা খেলছেন। তাঁরা খেলায় মত্ত হয়ে তাঁকে গ্রাহ্য করছেন না দেখে দেবরাজ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, এই বিশ্ব আমারই অধীন জেনো, আমিই এর ঈশ্বর। যুবা হাস্য ক’রে ইন্দ্রের দিকে চাইলেন, ইন্দ্র স্থাণুর ন্যায় নিশ্চল হয়ে গেলেন। পাশা খেলা শেষ হলে সেই যুবা ইন্দ্রের সঙ্গিনীকে বললেন, ওকে নিয়ে এস, আমি ওর দর্প দূর করছি। সেই রমণীর স্পর্শমাত্র ইন্দ্র অবশ হয়ে ভূপতিত হলেন। তখন যুবকরূপী মহাদেব বললেন, ইন্দ্র, আর কখনও দর্প প্রকাশ ক’রো না। তুমি তো অসীম বলশালী, ওই পর্বতটি উঠিয়ে গহ্বরের ভিতরে গিয়ে দেখ। ইন্দু গহ্বরে প্রবেশ ক’রে দেখলেন, তাঁর তুল্য তেজম্বী চার জন পুরুষ সেখানে রয়েছেন। ইন্দ্রকে ভয়ে কম্পমান দেখে মহাদেব বললেন, গর্বের ফলে এরা এই গহ্বরে রয়েছে, তুমিও এখানে থাক। তোমর। সকলেই মনুষ্য হয়ে জন্মাবে এবং বহু শত্রু, বধ ক’রে আবার ইন্দ্রলোকে ফিরে আসবে।

 তখন পূর্ববর্তী চার ইন্দ্র বললেন, ধর্ম বায়ু, ইন্দ্র ও অশ্বিদ্বয় আমাদের মানুষীর গর্ভে উৎপাদন করবেন। বর্তমান ইন্দ্র বললেন, আমি নিজ বীর্যে একজন পুরুষ সৃষ্টি ক’রে তাকেই পঞ্চম ইন্দ্ররূপে পাঠাব। মহাদেব তাতে সম্মত হলেন এবং সেই লোকবাঞ্ছিতা শ্রীরূপিণী রমণীকে মনষ্যলোকে তাঁদের ভার্যা হবার জন্য আদেশ দিলেন। এই সময়ে নারায়ণ তাঁর একটি কৃষ্ণ এবং একটি শুক্ল কেশ উৎপাটন করলেন। সেই দুই কেশ যদুকুলে গিয়ে দেবকী ও রোহিণীর গর্ভে প্রবিষ্ট হ’ল। শুক্ল কেশ থেকে বলদেব এবং কৃষ্ণ কেশ থেকে কেশব উৎপন্ন হলেন।

 এই উপাখ্যান শেষ ক’রে ব্যাস দ্রুপদকে বললেন, মহারাজ, সেই পাঁচ ইন্দ্রই পাণ্ডবরূপে জন্মেছেন এবং তাঁদের ভার্যারূপে নির্দিষ্টা সেই লক্ষীরূপিণী রমণীই দ্রৌপদী হয়েছেন। আমি আপনাকে দিব্য চক্ষু দিচ্ছি, পাণ্ডবদের পূর্বমূর্তি দেখুন। দ্রুপদ দেখলেন, তাঁরা অনল ও সূর্যতুল্য প্রভাবান দিব্যরূপধারী, তাঁদের বক্ষ বিশাল, দেহ দীর্ঘ, মস্তকে স্বর্ণকিরীট ও দিব্য মাল্য, দেবতার সর্বলক্ষণ তাঁদের দেহে বর্তমান। দ্রুপদ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়ে ব্যাসকে প্রণাম করলেন। তখন ব্যাস এক ঋষিকন্যার কথা[১] বললেন যাঁকে মহাদেব বর দিয়েছিলেন—তোমার পঞ্চপতি হবে। ব্যাস আরও বললেন, মানুষের পক্ষে এরূপ বিবাহ বিহিত নয়, কিন্তু এঁরা দেবতার অবতার, মহাদেবের ইচ্ছায় দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী হবেন।

 তার পর যুধিষ্ঠিরাদি স্নান ও মাঙ্গলিক কার্য শেষ ক’রে বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে পুরোহিত ধৌম্যের সঙ্গে বিবাহ সভায় এলেন। যথানিয়মে অগ্নিতে আহুতি দেবার পর যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করলেন। পরবর্তী চার দিনে একে একে অন্য ভ্রাতাদেরও বিবাহ সম্পন্ন হ’ল। প্রত্যেক বার পুনর্বিবাহের পূর্বে ব্রহ্মর্ষি ব্যাস দ্রৌপদীকে এই অলৌকিক বাক্য বলতেন—তুমি আবার কুমারী হও।

পতিশ্বশুরতা[২] জ্যেষ্ঠে পতিদেবরতানুজে।
মধ্যমেষু চ পাঞ্চাল্যাস্ত্রিতয়ং ত্রিতয়ং ত্রিষু॥

 —জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির পাঞ্চালীর পতি ও ভাশুর হলেন, কনিষ্ঠ সহদেব পতি ও দেবর হলেন, এবং মধ্যবর্তী তিন ভাতা প্রত্যেকে পতি ভাশুর ও দেবর হলেন।

 পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলন হওয়ায় দ্রুপদ সর্ববিধ ভয় থেকে মুক্তিলাভ করলেন। কুন্তী তাঁর পুত্রবধূকে আশীর্বাদ করলেন, তুমি পতিদের আদরিণী, পতিব্রতা ও বীরপুত্রপ্রসবিনী হও। গুণবতী, তুমি পৃথিবীর সকল রত্ন লাভ কর, শত বৎসর সুখে জীবিত থাক। পাণ্ডবদের বিবাহের সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ বহু মণিমুক্তা ও স্বর্ণাভরণ, মহার্ঘ বসন, সালংকারা দাসী, অশ্ব গজ প্রভৃতি উপহার পাঠালেন।

  1. ২৯-পরিচ্ছেদে আছে।
  2. এখানে শ্বশুর অর্থে ভ্রাতৃশ্বশুর বা ভাশুর।