মহাভারত (রাজশেখর বসু)/উদ্‌যোগপর্ব/উলূকদূতাগমনপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥ উলূকদূতাগমনপর্বাধ্যায় ॥

২৫। উলূকের দৌত্য

 কুরুক্ষেত্রে হিরন্বতী নদীর নিকটে পাণ্ডববাহিনী সন্নিবেশিত হ’লে কৌরবগণও সেখানে তাঁদের সেনা স্থাপিত করলেন। কর্ণ দুঃশাসন ও শকুনির সঙ্গে মন্ত্রণা করে দুর্যোধন স্থির করলেন যে শকুনির পুত্র উলূক দূত হয়ে পাণ্ডবদের কাছে যাবেন। তিনি উলূককে এইরূপ উপদেশ দিলেন।

 তুমি যুধিষ্ঠিরকে বলবে, তুমি সর্ব প্রাণীকে অভয় দিয়ে থাক, তবে নৃশংসের ন্যায় জগৎ ধ্বংস করতে চাও কেন? পুরাকালে দেবগণ প্রহ্লাদের রাজ্য হরণ করলে প্রহ্লাদ এই শ্লোকটি গেয়েছিলেন—হে সুরগণ, প্রকাশ্যে ধর্মের ধ্বজা উন্নত রাখা এবং প্রচ্ছন্নভাবে পাপাচরণ করার নাম বৈড়াল ব্রত। উলূক, নারদকথিত এই উপাখ্যানটি তুমি যুধিষ্ঠিরকে শুনিও।—এক দৃষ্ট বিড়াল গঙ্গাতীরে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তপস্যার ভান করত। পক্ষীরা তার কাছে গিয়ে প্রশংসা করতে লাগল, তখন বিড়াল ভাবলে, আমার ব্রত সফল হয়েছে। দীর্ঘকাল পরে এক দল মূষিক স্থির করলে, এই বিড়াল আমাদের মাতুল, ইনি আমাদের সকলকে রক্ষা করবেন। মূষিকদের প্রার্থনা শুনে বিড়াল বললে, তপস্যা এবং তোমাদের রক্ষা এই দুই কর্ম এক কালে করা অসম্ভব, তথাপি তোমাদের যাতে হিত হয় তা করব। কিন্তু আমি তপস্যায় পরিশ্রান্ত হয়ে আছি, কঠিন ব্রত পালন করছি, কোথাও যাবার শক্তি আমার নেই। বৎসগণ, তোমরা আমাকে প্রত্যহ নদীতীরে বহন করে নিয়ে যেয়ো। মূষিকরা সম্মত হ’ল এবং বালক বৃদ্ধ সকলেই বিড়ালের আশ্রয়ে এল। মূষিক ভক্ষণ ক’রে বিড়ালের শরীর ক্রমশ স্থূল চিক্কণ ও বলিষ্ঠ হতে লাগল। মূষিকরা ভাবলে, মাতুল নিত্য বৃদ্ধি পাচ্ছেন কিন্তু আমাদের ক্ষয় হচ্ছে কেন? একদিন ডিণ্ডিক নামে এক মূষিক বিড়ালের আচরণ লক্ষ্য করবার জন্য তার সঙ্গে সঙ্গে গেল, বিড়াল তাকে খেয়ে ফেললে। তখন কোলিক নামে এক অতি বৃদ্ধ মূষিক বললে, এঁর শিখাধারণ ছল মাত্র, এর বিষ্ঠায় লোম দেখা যায়, কিন্তু ফলমূলভোজীর বিষ্ঠায় তা থাকে না। ইনি স্থূল হচ্ছেন এবং আমাদের দল ক্ষীণ হচ্ছে, সাত আট দিন থেকে ডিণ্ডিককেও দেখছি না। এই কথা শুনে মূষিকরা পালিয়ে গেল, দুষ্ট বিড়ালও তার পূর্ব স্থানে ফিরে গেল। দুরাত্মা যুধিষ্ঠির, তুমিও বৈড়াল ব্রত অবলম্বন ক’রে জ্ঞাতিদের প্রতারিত করছ। তুমি পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলে, আমি তা দিই নি, কারণ আমার এই ইচ্ছা যে তুমি ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ কর। তুমি কৃষ্ণকে দিয়ে ব’লে পাঠিয়েছিলে যে তুমি শান্তি ও সমর দুইএর জন্যই প্রস্তুত আছ। আমি যুদ্ধের আয়োজন করেছি, এখন তুমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন কর।

 উলূক, তুমি কৃষ্ণকে বলবে, কৌরবসভায় যে মায়ারূপ দেখিয়েছিলে সেই রূপ ধারণ করে আমার প্রতি ধাবিত হও। ইন্দ্রজাল মায়া কুহক বা বিভীষিকা দেখলে অস্ত্রধারী বীর ভয় পায় না, সিংহনাদ করে। আমরাও বহু প্রকার মায়া দেখাতে পারি, কিন্তু তেমন উপায়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাই না। কৃষ্ণ, তুমি অকস্মাৎ যশস্বী হয়ে উঠেছ, কিন্তু আমরা জানি পুংশ্চিহ্নধারী নপুংসক অনেক আছে। তুমি কংসের ভৃত্য ছিলে সেজন্য আমার তুল্য কোনও রাজা তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করেন নি।

 উলূক, তুমি সেই শৃঙ্গহীন বৃষ বহুভোজী মূর্খ ভীমকে বলবে, বিরাটনগরে তুমি বল্লব নামে পাচক হয়ে ছিলে, তা আমারই পৌরুষের ফল। দ্যূতসভায় যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে তা যেন মিথ্যা না হয়, যদি শক্তি থাকে তবে দুঃশাসনের রক্ত পান কর। নকুল-সহদেবকে বলবে, দ্রৌপদীর কষ্ট স্মরণ ক’রে এখন যুদ্ধে তোমাদের পৌরুষ দেখাও। বিরাট আর দ্রুপদকে বলবে, প্রভু ও ভৃত্য পরস্পরের গুণাগুণ বিচার করে না, তাই গৌরবহীন যুধিষ্ঠির আপনাদের প্রভু হয়েছে। ধৃষ্টদ্যুম্নকে বলবে, তুমি দ্রোণের সঙ্গে পাপযুদ্ধ করবে এস। শিখণ্ডীকে বলবে, তুমি নির্ভয়ে যুদ্ধ করতে এস, ভীষ্ম তোমাকে স্ত্রী মনে করেন, তোমাকে বধ করবেন না।

 উলূক, তুমি অর্জুনকে বলবে, রাজ্য থেকে নির্বাসন, বনবাস, এবং দ্রৌপদীর ক্লেশ স্মরণ ক’রে এখন পুরুষত্ব দেখাও। লৌহময় অস্ত্রসমূহের সংস্কার হয়েছে, কুরুক্ষেত্রে কর্দম নেই, অশ্বসকল খাদ্য পেয়ে পুষ্ট হয়ে আছে, যোদ্ধারাও বেতন পেয়েছে, অতএব কেশবের সঙ্গে এসে কালই যুদ্ধ কর। তুমি কূপমণ্ডুক তাই দুর্ধর্ষ বিশাল কৌরবসেনার স্বরূপ বঝতে পারছ না। বাসুদেব তোমার সহায় তা জানি, তোমার গাণ্ডীব চার হাত দীর্ঘ তাও জানি, তোমার তুল্য যোদ্ধা নেই তাও জানি; তথাপি তোমাদের রাজ্য হরণ ক’রে তের বৎসর ভোগ করেছি। দ্যূতসভায় তোমার গাণ্ডীব কোথায় ছিল? ভীমের বল কোথায় ছিল? তোমরা আমাদের দাস হয়েছিলে, দ্রৌপদীই তোমাদের মুক্ত করেন। তুমি নপুংসক সেজে বেণী দুলিয়ে বিরাটকন্যাকে নৃত্য শেখাতে। এখন কৃষ্ণের সঙ্গে এসে যুদ্ধ কর, আমি তোমাদের ভয় করি না। সহস্র সহস্র বাসুদেব এবং শত শত অর্জুনও আমার অব্যর্থ বাণের প্রহারে দশ দিকে পলায়ন করবে।


 উলূক পাণ্ডবশিবিরে গিয়ে দুর্যোধনের সকল কথা জানালেন। ভীমকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ দেখে কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, শকুনিনন্দন, শীঘ্র ফিরে যাও, দুর্যোধনকে জানিও যে তাঁর সব কথা আমরা শুনেছি, অর্থও বুঝেছি, তিনি যা ইচ্ছা করেছেন তাই হবে। ভীম বললেন, মূর্খ, তুমি দুর্যোধনকে বলবে, আমি দুঃশাসনের রক্তপান ক’রে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করব। আর উলূক, তোমার পিতার সমক্ষে আগে তোমাকে বধ করব তার পর সেই পাপিষ্ঠকে বধ করব।

 অর্জন সহাস্যে বললেন, ভীমসেন, যাদের সঙ্গে আপনার শত্রুতা তারা এখানে নেই, উলূককে নিষ্ঠুর কথা বলা আপনার উচিত নয়। উলূক, দুর্যোধন যে গর্বিত বাক্য বলেছেন, কাল সৈন্যদের সম্মুখে গাণ্ডীব দ্বারা আমি তার প্রত্যুত্তর দেব। যুধিষ্ঠির বললেন, বৎস শকুনিপুত্র উলূক, তুমি দুর্যোধনকে বলবে, যে লোক পরস্ব হরণ করে এবং নিজের শক্তিতে তা রাখতে না পেরে অপরের সাহায্য নেয়, সে নপুংসক। দুর্যোধন, তুমি পরের বলে নিজেকে প্রবল মনে ক’রে গর্জন করছ কেন? অর্জুন বললেন, উলূক, দুর্যোধনকে বলবে, তুমি মহাপ্রাজ্ঞ ভীষ্মকে যুদ্ধে নামিয়ে মনে করছ আমরা দয়াবশে তাঁকে মারব না। যাঁর ভরসায় তুমি গর্ব করছ সেই ভীষ্মকে আমি প্রথমে বধ করব। বৃদ্ধ বিরাট ও দ্রুপদ বললেন, আমরা সাধুজনের দাসত্ব কামনা করি। আমরা দাস হই বা যাই হই, কার কত পৌরুষ আছে কাল দেখা যাবে। শিখণ্ডী বললেন, বিধাতা ভীষ্মবধের নিমিত্তই আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমি তাঁকে রথ থেকে নিপাতিত করব। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, আমি দ্রোণকে সসৈন্যে সবান্ধবে বধ করব, আমি যা করব তা আর কেউ পারবে না।

 উলূক কৌরবশিবিরে ফিরে গিয়ে সব কথা জানালেন।