মহাভারত (রাজশেখর বসু)/দ্রোণপর্ব/দ্রোণবধপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥দ্রোণবধপর্বাধ্যায়॥

১৯। দ্রুপদ-বিরাট-বধ—দুর্যোধনের বাল্যস্মৃতি

(পঞ্চদশ দিনের যুদ্ধ)

 সেই ভয়ংকর রাত্রির অর্ধভাগ অতীত হ’লে সৈন্যরা পরিশ্রান্ত ও নিদ্রাতুর হয়ে পড়ল। অনেকে অস্ত্র ত্যাগ ক’রে হস্তী ও অশ্বের পৃষ্ঠে নিদ্রিত হ’ল, অনেকে নিদ্রান্ধ হয়ে শত্রু মনে ক’রে স্বপক্ষকেই বধ করতে লাগল। তাদের এই অবস্থা দেখে অর্জুন সর্ব দিক নিনাদিত ক’রে উচ্চস্বরে বললেন, সৈন্যগণ, রণভূমি ধূলি ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়েছে, তোমাদের বাহন এবং তোমরা শ্রান্ত ও নিদ্রান্ধ হয়েছ, যদি ইচ্ছা কর তবে এই রণভূমিতে কিছু কাল নিদ্রা যাও। চন্দ্রোদয় হ’লে কুরুপাণ্ডবগণ বিশ্রামের পর আবার যুদ্ধ করবে। অর্জুনের এই কথা শুনে কৌরবসৈন্যরা চিৎকার করে বললে, কর্ণ, কর্ণ, রাজা দুর্যোধন, পাণ্ডবসেনা যুদ্ধে বিরত হয়েছে, আপনারাও বিরত হ’ন। তখন দুই পক্ষই যুদ্ধে নিবৃত্ত হয়ে অর্জুনের প্রশংসা করতে লাগল। সমস্ত সৈন্য নিদ্রামগ্ন হওয়ায় বোধ হ’ল যেন কোনও নিপুণ চিত্রকর পটের উপর তাদের চিত্রিত করেছে।

 কিছু কাল পরে মহাদেবের বৃষভের ন্যায়, মদনের শরাসনের ন্যায়, নববধূর ঈষৎ হাস্যের ন্যায় শ্বেতবর্ণ মনোহর চন্দ্র ক্রমশ উদিত হলেন। তখন অন্ধকার দূর হ’ল, সৈন্যগণ নিদ্রা থেকে উঠে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হ’ল।

 দুর্যোধন দ্রোণকে বললেন, আমাদের শত্রুরা যখন শ্রান্ত ও অবসন্ন হয়ে বিশ্রাম করছিল তখন আমরা তাদের লক্ষ্য রূপে পেয়েছিলাম। তারা ক্ষমার যোগ্য না হ’লেও আপনার প্রিয়কামনায় তাদের ক্ষমা করেছি। পাণ্ডবরা এখন বিশ্রাম ক’রে বলবান হয়েছে। আমাদের তেজ ও শক্তি ক্রমশই কমছে, কিন্তু আপনার প্রশ্রয় পেয়ে পাণ্ডবদের ক্রমশ বলবৃদ্ধি হচ্ছে। আপনি সর্বাস্ত্রবিৎ, দিব্য অস্ত্রে ত্রিভুবন সংহার করতে পারেন, কিন্তু পাণ্ডবগণকে শিষ্য জ্ঞান করে অথবা আমার দুর্ভাগ্যক্রমে আপনি তাদের ক্ষমা করে আসছেন। দ্রোণ বললেন, আমি স্থবির হয়েও যথাশক্তি যুদ্ধ করছি, অতঃপর, বিজয়লাভের জন্য হীন কার্যও করব, ভাল হ’ক মন্দ হ’ক তুমি যা চাও তাই আমি করব। আমি শপথ করছি, যুদ্ধে সমস্ত পাঞ্চাল বধ না ক’রে আমার বর্ম খুলব না।

 রাত্রির তিন মুহূর্ত অবশিষ্ট থাকতে পুনর্বার যুদ্ধ আরম্ভ হ’ল। দ্রোণ কোরবসেনা দুই ভাগে বিভক্ত করলেন এবং এক ভাগ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। ক্রমশ অরুণোদয়ে চন্দ্রের প্রভা ক্ষীণ হ’ল। বিরাট ও দ্রুপদ সসৈন্যে দ্রোণকে আক্রমণ করলেন। দ্রোণের শরাঘাতে দ্রুপদের তিন পৌত্র নিহত হলেন। চেদি কেকয় সৃঞ্জয় ও মৎস্য সৈন্যগণ পরাভূত হ’ল। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর দ্রোণ ভল্লের আঘাতে দ্রুপদ ও বিরাটকে বধ করলেন।

 ভীমসেন উগ্রবাক্যে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বললেন, কোন্ ক্ষত্রিয় দ্রুপদের বংশে জন্মগ্রহণ ক’রে এবং সর্বাস্ত্রবিশারদ হয়ে শত্রুকে দেখেও উপেক্ষা করে? কোন্ পুরুষ রাজসভায় শপথ ক’রে পিতা ও পুত্রগণের হত্যা দেখেও শত্রুকে পরিত্যাগ করে? এই ব’লে ভীম শরক্ষেপণ করতে করতে দ্রোণসৈন্যের মধ্যে প্রবেশ করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নও তাঁর অনুসরণ করলেন।

 কিছুক্ষণ পরে সূর্যোদয় হ’ল। যোদ্ধারা বর্মাবৃতদেহে সহস্রাংশু আদিত্যের উপাসনা করলেন, তার পর আবার যুদ্ধ করতে লাগলেন! সাত্যকিকে দেখে দুর্যোধন বললেন, সখা, ক্রোধ লোভ ক্ষত্রিয়াচার ও পৌরুষকে ধিক—আমরা পরস্পরের প্রতি শরসন্ধান করছি! বাল্যকালে আমরা পরস্পরের প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় ছিলাম, এখন এই রণস্থলে সে সমস্তই জীর্ণ হয়ে গেছে। সাত্যকি, আমাদের সেই বাল্যকালের খেলা কোথায় গেল, এই যুদ্ধেই বা কেন হ’ল? যে ধনের লোভে আমরা যুদ্ধ করছি তা নিয়ে আমরা কি করব? সাত্যকি সহাস্যে উত্তর দিলেন, রাজপুত্র, আমর। যেখানে একসঙ্গে খেলতাম এ সেই সভামণ্ডপ নয়, আচার্যের গৃহও নয়। ক্ষত্রিয়দের স্বভাবই এই, তারা গুরুজনকেও বধ করে। যদি আমি তোমার প্রিয় হই তবে শীঘ্র আমাকে বধ কর, যাতে আমি পুণ্যলোকে যেতে পারি, মিত্রদের এই ঘোর বিপদ দেখতে আমি আর ইচ্ছা করি না। এই ব’লে সাত্যকি দুর্যোধনের প্রতি ধাবিত হলেন এবং সিংহ ও হস্তীর ন্যায় দুজনে যুদ্ধে রত হলেন।

২০। দ্রোণের ব্রহ্মলোকে প্রয়াণ

(পঞ্চদশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 দ্রোণের শরবৃষ্টিতে পাণ্ডবসেনা নিরন্তর নিহত হচ্ছে দেখে কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, হাতে ধনুর্বাণ থাকলে দ্রোণ ইন্দ্রাদি দেবগণেরও অজেয়, কিন্তু যদি অস্ত্র ত্যাগ করেন তবে মানুষও ওঁকে বধ করতে পারে। তোমরা এখন ধর্মের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে জয়ের উপায় স্থির কর, নতুবা দ্রোণই তোমাদের সকলকে বধ করবেন। আমার মনে হয়, অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ পেলে উনি আর যুদ্ধ করবেন না, অতএব কেউ ওঁকে বলুক যে অশ্বত্থামা যুদ্ধে হত হয়েছেন।

 কৃষ্ণের এই প্রস্তাব অর্জনের রুচিকর হ’ল না, কিন্তু আর সকলেই এতে মত দিলেন, যুধিষ্ঠিরও নিতান্ত অনিচ্ছায় সম্মত হলেন। মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার অশ্বত্থামা নামে এক হস্তী ছিল। ভীম তাকে গদাঘাতে বধ করলেন এবং দ্রোণের কাছে গিয়ে লজ্জিতভাবে উচ্চস্বরে বললেন, অশ্বত্থামা হত হয়েছে। বালুকাময় তটভূমি যেমন জলে গলিত হয়, ভীমসেনের অপ্রিয় বাক্য শুনে সেইরূপ দ্রোণের অঙ্গ অবসন্ন হ’ল। কিন্তু তিনি পুত্রের বীরত্ব জানতেন, সেজন্য ভীমের কথায় অধীর হলেন না, ধৃষ্টদ্যুম্নের উপর তীক্ষ্ণ বাণ ক্ষেপণ করতে লাগলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের রথ ও সমস্ত অস্ত্র বিনষ্ট হ’ল, তখন ভীম তাঁকে নিজের রথে তুলে নিয়ে বললেন, তুমি ভিন্ন আর কেউ আচার্যকে বধ করতে পারবে না, তোমার উপরেই এই ভার আছে, শীঘ্র ওঁকে মারবার চেষ্টা কর।

 দ্রোণ ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। বিশ হাজার পাঞ্চাল রথী, পাঁচ শ মৎস্য সৈন্য, ছ হাজার সৃঞ্জয় সৈন্য, দশ হাজার হস্তী এবং দশ হাজার অশ্ব নিপাতিত হ’ল। এই সময়ে বিশ্বামিত্র জমদগ্নি ভরদ্বাজ গৌতম বশিষ্ঠ প্রভৃতি মহর্ষিগণ অগ্নিদেবকে পুরোবর্তী ক’রে সূক্ষ্মদেহে উপস্থিত হলেন। তাঁরা বললেন, দ্রোণ, তুমি অধর্মযুদ্ধ করছ, তোমার মৃত্যুকাল উপস্থিত হয়েছে। তুমি বেদবেদাঙ্গবিৎ সত্যধর্মে নিরত ব্রাহ্মণ, এরূপ ক্রূর কর্ম করা তোমার উচিত নয়। যারা ব্রহ্মাস্ত্রে অনভিজ্ঞ এমন লোককে তুমি ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে মারছ, এই পাপকর্ম আর ক’রো না, শীঘ্র অস্ত্র ত্যাগ কর।

 যুদ্ধে বিরত হয়ে দ্রোণ বিষণ্ণমনে যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করলেন, অশ্বত্থামা হত হয়েছেন কিনা। দ্রোণের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ত্রিলোকের ঐশ্বর্যের জন্যও যুধিষ্ঠির মিথ্যা বলবেন না। কৃষ্ণ উদ্‌বিগ্ন হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, দ্রোণ যদি আর অর্ধ দিন যুদ্ধ করেন তবে আপনার সমস্ত সৈন্য বিনষ্ট হবে। আমাদের রক্ষার জন্য এখন আপনি সত্য না ব’লে মিথ্যাই বলুন, জীবনরক্ষার জন্য মিথ্যা বললে পাপ হয় না। ভীম বললেন, মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার অশ্বত্থামা নামে এক হস্তী ছিল, সে আমাদের সৈন্য মথিত করছিল সেজন্য তাকে আমি বধ করেছি। তার পর আমি দ্রোণকে বললাম, ভগবান, অশ্বত্থামা হত হয়েছেন, আপনি যুদ্ধ থেকে বিরত হ’ন; কিন্তু উনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। মহারাজ, আপনি গোবিন্দের কথা শুনুন, দ্রোণকে বলুন যে অশ্বত্থামা মরেছেন। আপনি বললে দ্রোণ আর যুদ্ধ করবেন না।

 কৃষ্ণের প্ররোচনায়, ভীমের সমর্থনে, এবং দ্রোণবধের ভবিতব্যতা জেনে যুধিষ্ঠির সম্মত হলেন। তাঁর অসত্যভাষণের ভয় ছিল, জয়লাভেরও আগ্রহ ছিল। তিনি উচ্চস্বরে বললেন, ‘অশ্বত্থামা হতঃ—অশ্বত্থামা হত হয়েছেন, তার পর অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘ইতি কুঞ্জরঃ’—এই নামের হস্তী। যুধিষ্ঠিরের রথ পূর্বে ভূমি থেকে চার আঙুল উপরে থাকত, এখন মিথ্যা বলার পাপে তাঁর বাহনসকল ভূমি স্পর্শ করলে।

 মহর্ষিদের কথা শুনে দ্রোণের ধারণা জন্মেছিল যে তিনি পাণ্ডবদের নিকট অপরাধী হয়েছেন। এখন তিনি পুত্রের মৃত্যুসংবাদে শোকে অভিভূত এবং ধৃষ্টদ্যুম্নকে দেখে উদ্‌বিগ্ন হলেন, আর যুদ্ধ করতে পারলেন না। এই সময়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন — যাঁকে দ্রুপদ প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে দ্রোণবধের নিমিত্ত লাভ করেছিলেন—একটি সুদৃঢ় দীর্ঘ ধনুতে আশীবিষতুল্য শর সন্ধান করলেন। দ্রোণ সেই শর নিবারণের চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার উপযুক্ত অস্ত্র তাঁর স্মরণ হ’ল না। দ্রোণের কাছে গিয়ে ভীম ধীরে ধীরে বললেন, যে হীন ব্রাহ্মণগণ স্বকর্মে তুষ্ট না থেকে অস্ত্রশিক্ষা করেছে, তারা যদি যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হ’ত তবে ক্ষত্রিয়কুল ক্ষয় পেত না। এই সৈন্যরা নিজের বৃত্তি অনুসারে যুদ্ধ করছে, কিন্তু আপনি অব্রাহ্মণের বৃত্তি নিয়ে এক পুত্রের জন্য বহু প্রাণী বধ করছেন, আপনার লজ্জা হচ্ছে না কেন? যাঁর জন্য আপনি অস্ত্রধারণ ক’রে আছেন, যাঁর অপেক্ষায় আপনি জীবিত আছেন, সেই পুত্র আজ রণভূমিতে শুয়ে আছে। ধর্মরাজের বাক্যে আপনি সন্দেহ করতে পারেন না।

 দ্রোণ শরাসন ত্যাগ ক’রে বললেন, ‘কর্ণ, কর্ণ, কৃপ, দুর্যোধন, তোমরা যথাশক্তি যুদ্ধ কর, পাণ্ডবদের আর তোমাদের মঙ্গল হ’ক, আমি অস্ত্র ত্যাগ করলাম। এই ব’লে তিনি উচ্চস্বরে অশ্বত্থামাকে ডাকলেন, তার পর সমস্ত অস্ত্র রথের মধ্যে রেখে যোগস্থ হয়ে সর্বপ্রাণীকে অভয় দিলেন। এই অবসর পেয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন এবং খড়্‌গ নিয়ে দ্রোণের প্রতি ধাবিত হলেন। দুই পক্ষের সৈন্যরা হাহাকার করে উঠল। দ্রোণ যোগমগ্ন হয়ে মুখ কিঞ্চিৎ উন্নত ক’রে নিমীলিতনেত্রে পরমপুরুষ বিষ্ণুকে ধ্যান করতে লাগলেন এবং ব্রহ্মস্বরূপ একাক্ষর ওম্-মন্ত্র স্মরণ করতে করতে ব্রহ্মলোকে যাত্রা করলেন। মৃত্যুকালে তাঁর দেহ থেকে দিব্য জ্যোতি নির্গত হয়ে উল্কার ন্যায় নিমেষমধ্যে অন্তর্হিত হ’ল। দ্রোণের এই ব্রহ্মলোকযাত্রা কেবল পাঁচজন দেখতে পেলেন— কৃষ্ণ কৃপ যুধিষ্ঠির অর্জুন ও সঞ্জয়।

 দ্রোণ রক্তাক্তদেহে নিরস্ত্র হয়ে রথে ব’সে আছেন দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর প্রতি ধাবিত হলেন। ‘দ্রুপদপুত্র, আচার্যকে জীবিত ধ’রে আন, বধ ক’রো না’—উচ্চস্বরে এই ব’লে অর্জুন তাঁকে নিবারণ করতে গেলেন; তথাপি ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রাণহীন দ্রোণের কেশ গ্রহণ ক’রে শিরশ্ছেদ করলেন এবং খড়্‌গ ঘূর্ণিত ক’রে সিংহনাদ করতে লাগলেন। তার পর তিনি দ্রোণের মুণ্ড তুলে নিয়ে কৌরব সৈন্যগণের সম্মুখে নিক্ষেপ করলেন।

 দ্রোণের মৃত্যুর পর কৌরবসৈন্য ভগ্ন হ’ল। কুরপক্ষের রাজারা দ্রোণের দেহের জন্য রণস্থলে অন্বেষণ করলেন, কিন্তু বহু কবন্ধের মধ্যে তা দেখতে পেলেন না। ধৃষ্টদ্যুম্নকে আলিঙ্গন ক’রে ভীম বললেন, সূতপুত্র কর্ণ আর পাপী দুর্যোধন নিহত হ’লে আবার তোমাকে আলিঙ্গন করব। এই ব’লে ভীম হৃষ্টচিত্তে তাল ঠুকে পৃথিবী কম্পিত করতে লাগলেন।