মহাভারত (রাজশেখর বসু)/দ্রোণপর্ব/ঘটোৎকচবধপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥ঘটোৎকচবধপর্বাধ্যায়॥

১৬। সোমদত্ত-বাহ্ণীক বধ—কৃপ-কর্ণ-অশ্বত্থামার কলহ

(চতুর্দশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 সন্ধ্যাকালে ভীরুর ত্রাসজনক এবং বীরের হর্ষবর্ধক নিদারুণ রাত্রিযুদ্ধ আরম্ভ হ’ল, পাণ্ডব পাঞ্চাল ও সঞ্জয়গণ মিলিত হয়ে দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন।

 ভূরিশ্রবার পিতা সোমদত্ত সাত্যকিকে বললেন, তুমি ক্ষত্রধর্ম ত্যাগ ক’রে দস্যুর ধর্মে রত হ’লে কেন? বৃষ্ণিবংশে দুজন মহারথ বলে খ্যাত, প্রদ্যুম্ন ও তুমি। দক্ষিণবাহুহীন প্রায়োপবেশনে উপবিষ্ট ভূরিশ্রবাকে তুমি কেন হত্যা করলে? আমি শপথ করছি, অর্জুন যদি রক্ষা না করেন তবে এই রাত্রি অতীত না হতেই তোমাকে বধ করব নতুবা ঘোর নরকে যাব। সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধে আহত হয়ে সোমদত্ত মূর্ছিত হলেন, তাঁর সারথি তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেল।

 অশ্বত্থামার সঙ্গে ঘটোৎকচের ভীষণ যুদ্ধ হ’তে লাগল। ঘটোৎকচপুত্র অঞ্জনপর্বা অশ্বত্থামা কর্তৃক নিহত হলেন। ঘটোৎকচ বললেন, দ্রোণপুত্র, তুমি আজ আমার হাতে রক্ষা পাবে না। অশ্বত্থামা বললেন, বৎস, আমি তোমার পিতার তুল্য, তোমার উপর আমার অধিক ক্রোধ নেই। ঘটোৎকচ ক্রুদ্ধ হয়ে মায়াযুদ্ধ করতে লাগলেন। তাঁর অনুচর এক অক্ষৌহিণী রাক্ষসকে অশ্বত্থামা বিনষ্ট করলেন। সোমদত্ত আবার যুদ্ধ করতে এসে ভীমের পরিঘ ও সাত্যকির বাণের আঘাতে নিহত হলেন। সোমদত্তের পিতা বাহ্ণীকরাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভীমকে আক্রমণ করলেন, গদাঘাতে ভীম তাঁকে বধ করলেন।


 দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, মিত্রবৎসল কর্ণ, পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ আমার যোদ্ধাদের বেষ্টন করেছেন, তুমি ওঁদের রক্ষা কর। কর্ণ বললেন, আমি জীবিত থাকতে তুমি বিষাদগ্রস্ত হয়ো না, সমস্ত পাণ্ডবদের আমি জয় করব। কৃপাচার্য ঈষৎ হাস্য ক’রে বললেন, ভাল ভাল! কেবল কথাতেই যদি কার্যসিদ্ধি হ’ত তবে তুমি দুর্যোধনের সেনা রক্ষা করতে পারতে। সূতপুত্র, তুমি সর্বত্রই পাণ্ডবদের হাতে পরাজিত হয়েছ, এখন বৃথা গর্জন না ক’রে যুদ্ধ কর। কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, বীরগণ বর্ষার মেঘের ন্যায় গর্জন করেন, এবং যথাকালে রোপিত বীজের ন্যায় শীঘ্র ফলও দেন। তাঁরা যদি যুদ্ধের ভার নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন তাতে আমি দোষ দেখি না। ব্রাহ্মণ, পাণ্ডব ও কৃষ্ণ প্রভৃতিকে মারবার সংকল্প ক’রে যদি আমি গর্জন করি তবে আপনার তাতে কি ক্ষতি? আপনি আমার গর্জনের ফল দেখতে পাবেন, আমি শত্রুবধ ক’রে দুর্যোধনকে নিষ্কণ্টক রাজ্য দেব। কৃপ বললেন, তুমি প্রলাপ বকছ, কৃষ্ণ ও অর্জুন যে পক্ষে আছেন সেই পক্ষে নিশ্চয় জয় হবে। কর্ণ সহাস্যে বললেন, ব্রাহ্মণ, আমার কাছে ইন্দ্রদত্ত অমোঘ শক্তি অস্ত্র আছে, তার দ্বারাই আমি অর্জুনকে বধ করব। আপনি বৃদ্ধ, যুদ্ধে অক্ষম, পাণ্ডবদের প্রতি স্নেহযুক্ত, সেজন্য মোহবশে আমাকে অবজ্ঞা করেন। দুর্মতি ব্রাহ্মণ, যদি পুনর্বার আমাকে অপ্রিয় বাক্য বলেন তবে খড়্‌গ দিয়ে আপনার জিহ্বা ছেদন করব। আপনি রণস্থলে কৌরবসেনাকে ভয় দেখিয়ে পাণ্ডবদের স্তুতি করতে চান!

 মাতুল কৃপাচার্যকে কর্ণ ভর্ৎসনা করছেন দেখে অশ্বত্থামা খড়্‌গ উদ্যত ক’রে বেগে উপস্থিত হলেন। তিনি দুর্যোধনের সমক্ষেই কর্ণকে বললেন, নরাধম, তুমি নিজের বীরত্বের দর্পে অন্য কোনও ধনুর্ধরকে গণনা কর না! অর্জুন যখন তোমাকে পরাস্ত ক’রে জয়দ্রথকে বধ করেছিলেন তখন তোমার বীরত্ব আর অস্ত্র কোথায় ছিল? আমার মাতুল অর্জুন সম্বন্ধে যথার্থ বলেছেন তাই তুমি ভর্ৎসনা করছ! দুর্মতি, আজ আমি তোমার শিরশ্ছেদ করব। এই ব’লে অশ্বত্থামা কর্ণের প্রতি ধাবিত হলেন, তখন দুর্যোধন ও কৃপ তাঁকে নিবারণ করলেন। দুর্যোধন বললেন, অশ্বত্থামা, প্রসন্ন হও, সূতপুত্রকে ক্ষমা কর। কর্ণ কৃপ দ্রোণ শল্য শকুনি আর তোমার উপর মহৎ কার্যের ভার রয়েছে। মহামনা শান্তস্বভাব কৃপাচার্য বললেন, দুর্মতি সূতপুত্র, আমরা তোমাকে ক্ষমা করলাম, কিন্তু অর্জুন তোমার দর্প চূর্ণ করবেন।

 তার পর কর্ণ ও দুর্যোধন পাণ্ডবযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘোর যুদ্ধে রত হলেন। অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে বললেন, আমি জীবিত থাকতে তোমার যুদ্ধ করা উচিত নয়; তুমি ব্যস্ত হয়ো না, আমিই অর্জুনকে নিবারণ করব। দুর্যোধন বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, দ্রোণাচার্য পুত্রের ন্যায় পাণ্ডবদের রক্ষা করেন, তুমিও তাদের উপেক্ষা ক’রে থাক। অশ্বত্থামা, প্রসন্ন হও, আমার শত্রুদের নাশ কর। অশ্বত্থামা বললেন, তোমার কথা সত্য, পাণ্ডবরা আমার ও আমার পিতার প্রিয়। আমরাও তাঁদের প্রিয়, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়। আমরা প্রাণের ভয় ত্যাগ ক’রে যথাশক্তি যুদ্ধ করি।

 দুর্যোধনকে আশ্বস্ত ক’রে অশ্বত্থামা রণস্থলে গেলেন এবং বিপক্ষ যোদ্ধৃগণকে নিপীড়িত করতে লাগলেন।

১৭। কৃষ্ণার্জুন ও ঘটোৎকচ

(চতুর্দশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 গাঢ় অন্ধকারে বিমূঢ় হয়ে সৈন্যরা পরস্পরকে বধ করছে দেখে দুর্যোধন তাঁর পদাতিদের বললেন, তোমরা অস্ত্র ত্যাগ ক’রে হাতে জলন্ত প্রদীপ নাও। পদাতিরা প্রদীপ ধরলে যুদ্ধভূমির অন্ধকার দূর হ’ল। পাণ্ডবরাও পদাতি সৈন্যের হাতে প্রদীপ দিলেন। প্রত্যেক হস্তীর পৃষ্ঠে সাত, রথে দশ, অশ্বে দুই, এবং সেনার পার্শ্বে পশ্চাতে ও ধ্বজেও প্রদীপ দেওয়া হ’ল।

 সেই নিদারুণ রাত্রিযুদ্ধে এক বার পাণ্ডবপক্ষের অন্য বার কৌরবপক্ষের জয় হ’তে লাগল। স্বয়ংবরসভায় যেমন বিবাহার্থীদের নাম ঘোষিত হয় সেইরূপ রাজারা নিজ নিজ নাম ও গোত্র শুনিয়ে বিপক্ষকে প্রহার করতে লাগলেন। অর্জুনের প্রবল শরবর্ষণে কৌরবসৈন্য ভয়ার্ত হয়ে পালাচ্ছে দেখে দুর্যোধন দ্রোণ ও কর্ণকে বললেন, অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করেছে সেজন্য ক্রুদ্ধ হয়ে আপনারাই রাত্রিকালে এই যুদ্ধ আরম্ভ করেছেন। পাণ্ডবসৈন্য আমাদের সৈন্য সংহার করছে, আর আপনারা অক্ষমের ন্যায় তা দেখছেন। হে মাননীয় বীরদ্বয়, যদি আমাকে ত্যাগ করাই আপনাদের ইচ্ছা ছিল তবে আমাকে আশ্বাস দেওয়া আপনাদের উচিত হয় নি। আপনাদের অভিপ্রায় জানলে এই সৈন্যক্ষয়কর যুদ্ধ আরম্ভ করতাম না। যদি আমাকে ত্যাগ করতে না চান তবে যুদ্ধে আপনাদের বিক্রম প্রকাশ করুন। দুর্যোধনের বাক্যরূপ কশাঘাতে দ্রোণ ও কর্ণ পদাহত সর্পের ন্যায় উত্তেজিত হয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন।

 কর্ণের শরবর্ষণে আকুল হয়ে পাণ্ডবসৈন্য পালাচ্ছে দেখে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, আমাদের যোদ্ধারা অনাথের ন্যায় বন্ধুদের ডাকছে, কর্ণের শরসন্ধান আর শরত্যাগের মধ্যে কোনও অবকাশ দেখা যাচ্ছে না, নিশ্চয় আজ ইনি আমাদের সংহার করবেন। ধনঞ্জয়, কর্ণের বধের জন্য যা করা উচিত তা কর। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, আমাদের রথীরা পালাচ্ছেন আর কর্ণ নির্ভয়ে তাঁদের শরাঘাত করছেন, এ আমি সইতে পারছি না। মধুসূদন, শীঘ্র কর্ণের কাছে রথ নিয়ে চল, হয় আমি তাঁকে মারব না হয় তিনি আমাকে মারবেন।

 কৃষ্ণ বললেন, তুমি অথবা রাক্ষস ঘটোৎকচ ভিন্ন আর কেউ কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে না। এখন তাঁর সঙ্গে তোমার যুদ্ধ করা আমি উচিত মনে করি না, কারণ তাঁর কাছে ইন্দ্রদত্ত শক্তি অস্ত্র আছে, তোমাকে মারবার জন্য কর্ণ এই ভয়ংকর অস্ত্র সর্বদা সঙ্গে রাখেন। অতএব ঘটোৎকচই তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করুক। ভীমসেনের এই পুত্রের কাছে দৈব রাক্ষস ও আসুর সর্বপ্রকার অস্ত্রই রয়েছে, সে কর্ণকে জয় করবে তাতে আমার সংশয় নেই।

 কৃষ্ণের আহ্বান শুনে দীপ্তকুণ্ডলধারী সশস্ত্র মেঘবর্ণ ঘটোৎকচ এসে অভিবাদন করলেন। কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, পুত্র ঘটোৎকচ, এখন একমাত্র তোমারই বিক্রমপ্রকাশের সময় উপস্থিত হয়েছে। তোমার আত্মীয়গণ বিপৎসাগরে নিমগ্ন হয়েছেন, তুমি তাঁদের রক্ষা কর। কর্ণ পাণ্ডবসৈন্য নিপীড়িত করছেন, ক্ষত্রিয় বীরগণকে হনন করছেন, এই নিশীথকালে পাঞ্চালরা সিংহের ভয়ে মৃগের ন্যায় পালিয়ে যাচ্ছে। তোমার নানাবিধ অস্ত্র ও রাক্ষসী মায়া আছে, আর রাক্ষসগণ রাত্রিতেই অধিক বলবান হয়।

 অর্জুন বললেন, ঘটোৎকচ, আমি মনে করি সর্বসৈন্যমধ্যে তুমি, সাত্যকি আর ভীমসেন এই তিন জনই শ্রেষ্ঠ। তুমি এই রাত্রিতে কর্ণের সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধ কর, সাত্যকি তোমার পৃষ্ঠরক্ষক হবেন।

 ঘটোৎকচ বললেন, নরশ্রেষ্ঠ, আমি একাকীই কর্ণ দ্রোণ এবং অন্য ক্ষত্রিয় বীরগণকে জয় করতে পারি। আমি এমন যুদ্ধ করব যে লোকে চিরকাল তার কথা বলবে। কোনও বীরকে আমি ছাড়ব না, ভয়ে কৃতাঞ্জলি হ’লেও নয়, রাক্ষসধর্ম অনুসারে সকলকেই বধ করব। এই ব’লে ঘটোৎকচ কর্ণের দিকে ধাবিত হলেন।

১৮। ঘটোৎকচবধ

(চতুর্দশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 ঘটোৎকচের দেহ বিশাল, চক্ষু লোহিত, শ্মশ্রু পিঙ্গল, মুখ আকর্ণবিস্তৃত, দন্ত করাল, অঙ্গ নীলবর্ণ, মস্তক বৃহৎ, তার উপরে বিকট কেশচূড়া। তাঁর দেহে কাংস্যনির্মিত উজ্জ্বল বর্ম, মস্তকে শুভ্র কিরীট, কর্ণে অরুণবর্ণ কুণ্ডল। তাঁর বৃহৎ রথ ভল্লুকচর্মে আচ্ছাদিত এবং শত অশ্বে বাহিত। সেই রথের আকাশস্পর্শী ধ্বজের উপর এক ভীষণ মাংসাশী গৃধ্র বসে আছে।

 কর্ণ ও ঘটোৎকচ শরক্ষেপণ করতে করতে পরস্পরের দিকে ধাবিত হলেন। কিছুক্ষণ পরে ঘটোৎকচ মায়াযুদ্ধ আরম্ভ করলেন। ঘোরদর্শন রাক্ষস সৈন্য আবির্ভূত হয়ে শিলা লৌহচক্র তোমর শূল শতঘ্নী পট্টিশ প্রভৃতি বর্ষণ করতে লাগল, কৌরব যোদ্ধারা ভীত হয়ে পশ্চাৎপদ হলেন, কেবল কর্ণ অবিচলিত থেকে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। শরবিদ্ধ হয়ে ঘটোৎকচের দেহ শজারুর ন্যায় কণ্টকিত হ’ল। একবার দৃশ্য হয়ে, আবার অদৃশ্য হয়ে, কখনও আকাশে উঠে, কখনও ভূমি বিদীর্ণ ক’রে ঘটোৎকচ যুদ্ধ করতে লাগলেন। সহসা তিনি নিজেকে বহু রূপে বিভক্ত করলেন, সিংহ ব্যাঘ্র তরক্ষু সর্প, তীক্ষ্ণচঞ্চু পক্ষী, রাক্ষস পিশাচ কুক্কুর বৃক প্রভৃতি আবির্ভূত হয়ে কর্ণকে ভক্ষণ করতে গেল। শরাঘাতে কর্ণ তাদের একে একে বধ করলেন।

 অলায়ুধ নামে এক রাক্ষস দুর্যোধনের কাছে এসে বললে, মহারাজ, হিড়িম্ব বক ও কির্মীর আমার বন্ধু ছিলেন, ভীম তাঁদের বধ করেছে, কন্যা হিড়িম্বাকে ধর্ষণ করেছে। আমি আজ কৃষ্ণ ও পাণ্ডবগণকে সসৈন্যে হত্যা করে ভক্ষণ করব। দুর্যোধনের অনুমতি পেয়ে অলায়ুধ ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেল। ঘটোৎকচ তার মুণ্ড কেটে দুর্যোধনের দিকে নিক্ষেপ করলেন। তাঁর মায়াসৃষ্ট রাক্ষসগণ অগণিত সৈন্য বধ করতে লাগল। কুরুবীরগণ রণে ভঙ্গ দিয়ে বললেন, কৌরবগণ, পালাও, ইন্দ্রাদি দেবতারা পাণ্ডবদের জন্য আমাদের বধ করছেন।

 চক্রযুক্ত একটি শতঘ্নী নিক্ষেপ করে ঘটোৎকচ কর্ণের চার অশ্ব বধ করলেন। কৌরবগণ সকলে কর্ণকে বললেন, তুমি শীঘ্র শক্তি অস্ত্রে এই রাক্ষসকে বধ কর, নতুবা আমরা সসৈন্যে বিনষ্ট হব। কর্ণ দেখলেন, ঘটোৎকচ সৈন্যসংহার করছেন, কৌরবগণ ত্রস্ত হয়ে আর্তনাদ করছেন। তখন তিনি ইন্দ্রপ্রদত্ত বৈজয়ন্তী শক্তি নিলেন। অর্জুনকে বধ করবার জন্য কর্ণ বহু বৎসর এই অস্ত্র সযত্নে রেখেছিলেন। এখন তিনি কৃতান্তের জিহ্বার ন্যায় লেলিহান, উল্কার ন্যায় দীপ্যমান, মৃত্যুর ভগিনীর ন্যায় ভীষণ সেই শক্তি ঘটোৎকচের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। ঘটোৎকচ ভীত হয়ে নিজের দেহ বিন্ধ্য পর্বতের ন্যায় বৃহৎ ক’রে বেগে পিছনে স’রে গেলেন। কর্ণের হস্তনিক্ষিপ্ত শক্তি ঘটোৎকচের সমস্ত মায়া ভস্ম ক’রে এবং তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ ক’রে আকাশে নক্ষত্রগণের মধ্যে চ’লে গেল। মরণকালে ঘটোৎকচ আর এক আশ্চর্য কার্য করলেন। তিনি পর্বত ও মেঘের ন্যায় বিশাল দেহ ধারণ ক’রে আকাশ থেকে পতিত হলেন; তাঁর প্রাণহীন দেহের ভারে কৌরববাহিনীর এক অংশ নিষ্পেষিত হ’ল।

 কৌরবগণ হৃষ্ট হয়ে সিংহনাদ ও বাদ্যধধ্বনি করতে লাগলেন, কর্ণ বৃত্রহন্তা ইন্দ্রের ন্যায় পূজিত হলেন।


 ঘটোৎকচের মৃত্যুতে পাণ্ডবগণ শোকে অশ্রুমোচন করতে লাগলেন, কিন্তু কৃষ্ণ হৃষ্ট হয়ে সিংহনাদ ক’রে অর্জুনকে আলিঙ্গন করলেন। তিনি অশ্বের রশ্মি সংযত ক’রে রথের উপর নৃত্য করতে লাগলেন এবং বার বার তাল ঠুকে গর্জন করলেন। অর্জুন অপ্রীত হয়ে বললেন, মধুসূদন, আমরা শোকগ্রস্ত হয়েছি, তুমি অসময়ে হর্ষ প্রকাশ করছ। তোমার এই অধীরতার কারণ কি?

 কৃষ্ণ বললেন, আজ কর্ণ ঘটোৎকচের উপর শক্তি নিক্ষেপ করেছেন, তার ফলে তিনি নিজেই যুদ্ধে নিহত হবেন। ভাগ্যক্রমে কর্ণের অক্ষয় কবচ আর কুণ্ডল দূর হয়েছে, ভাগ্যক্রমে ইন্দ্রদত্ত অমোঘ শক্তিও ঘটোৎকচকে মেরে অপসৃত হয়েছে। অর্জুন, তোমার হিতের জন্যই আমি জরাসন্ধ শিশুপাল আর একলব্যকে একে একে নিহত করিয়েছি, হিড়িম্ব কির্মীর বক অলায়ুধ এবং উগ্রকর্মা ঘটোৎকচকেও নিপাতিত করিয়েছি। অর্জুন বললেন, আমার হিতের জন্য কেন? কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, জরাসন্ধ শিশুপাল আর একলব্য না মরলে এখন ভয়ের কারণ হতেন, দুর্যোধন নিশ্চয় তাঁদের বরণ করতেন এবং তাঁরাও এই যুদ্ধে কুরু পক্ষে যেতেন। নরশ্রেষ্ঠ, তোমার সহায়তায় দেবদ্বেষীদের বিনাশ এবং জগতের হিতসাধনের জন্য আমি জন্মেছি। হিড়িম্ব বক আর কির্মীরকে ভীমসেন মেরেছেন, ঘটোৎকচ অলায়ুধকে মেরেছে, কর্ণ ঘটোৎকচের উপর শক্তি নিক্ষেপ করেছেন। কর্ণ যদি বধ না করতেন তবে আমিই ঘটোৎকচকে বধ করতাম, কিন্তু তোমাদের প্রীতির জন্য তা করি নি। এই রাক্ষস ব্রাহ্মণদ্বেষী যজ্ঞদ্বেষী ধর্মনাশক পাপাত্মা, সেজন্যই কৌশলে তাকে নিপাতিত করিয়েছি, ইন্দ্রের শক্তিও ব্যয়িত করিয়েছি। আমিই কর্ণকে বিমোহিত করেছিলাম, তাই তিনি তোমার জন্য রক্ষিত শক্তি ঘটোৎকচের উপর নিক্ষেপ করেছেন।

 ঘটোৎকচের মৃত্যুতে যুধিষ্ঠির কাতর হয়েছেন দেখে কৃষ্ণ বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, আপনি শোক করবেন না, এরূপ বিহ্বলতা আপনার যোগ্য নয়। আপনি উঠুন, যুদ্ধ করুন, গুরুভার বহন করুন। আপনি শোকাকুল হ’লে আমাদের জয়লাভ সংশয়ের বিষয় হবে। যুধিষ্ঠির হাত দিয়ে চোখ মুছে বললেন, মহাবাহু, যে লোক উপকার মনে রাখে না তার ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়। আমাদের বনবাসকালে ঘটোৎকচ বালক হ’লেও বহু সাহায্য করেছিল। অর্জুনের অনুপস্থিতিকালে সে কাম্যক বনে আমাদের কাছে ছিল, যখন আমরা গন্ধমাদন পর্বতে যাই তখন তার সাহায্যেই আমরা অনেক দুর্গম স্থান পার হ’তে পেরেছিলাম, পরিশ্রান্তা পাঞ্চালীকেও সে পৃষ্ঠে বহন করেছিল। এই যুদ্ধে সে আমার জন্য বহু দুঃসাধ্য কর্ম করেছে। সে আমার ভক্ত ও প্রিয় ছিল, তার জন্য আমি শোকার্ত হয়েছি। জনার্দন, তুমি ও আমরা জীবিত থাকতে এবং অর্জুনের সমক্ষে ঘটোৎকচ কেন কর্ণের হাতে নিহত হ’ল? অর্জুন অল্প কারণে জয়দ্রথকে বধ করেছেন, তাতে আমি বিশেষ প্রীত হই নি। যদি শত্রুবধ করাই ন্যায্য হয় তবে আগে দ্রোণ ও কর্ণকেই বধ করা উচিত, এঁরাই আমাদের দুঃখের মূল। যেখানে দ্রোণ আর কর্ণকে মারা উচিত সেখানে অর্জুন জয়দ্রথকে মেরেছেন। মহাবাহু ভীমসেন এখন দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, আমি নিজেই কর্ণকে বধ করতে যাব।

 যুধিষ্ঠির বেগে কর্ণের দিকে যাচ্ছিলেন এমন সময় ব্যাসদেব এসে তাঁকে বললেন, যুধিষ্ঠির, ভাগ্যক্রমে অর্জুন কর্ণের সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধ করেন নি তাই তিনি ইন্দ্রদত্ত শক্তির প্রহার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ঘটোৎকচ নিহত হওয়ায় অর্জুন রক্ষা পেয়েছেন। বৎস, ঘটোৎকচের জন্য শোক ক’রো না, তুমি ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধ কর। আর পাঁচ দিন পরে তুমি পৃথিবীর অধিপতি হবে। তুমি সর্বদা ধর্মের চিন্তা কর, যেখানে ধর্ম সেখানেই জয় হয়। এই ব’লে ব্যাস অন্তর্হিত হলেন।