মহাভারত (রাজশেখর বসু)/দ্রোণপর্ব/প্রতিজ্ঞাপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥প্রতিজ্ঞাপর্বাধ্যায়॥

৯। অর্জুনের প্রতিজ্ঞা

 সেইদিন সায়াহ্ণকালে দু পক্ষের সৈন্য যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হ’লে অর্জুন সংশপ্তকগণকে বধ ক’রে নিজ শিবিরে যাত্রা করলেন। তিনি যেতে যেতে সাশ্রুকণ্ঠে বললেন, কেশব, আমার হৃদয় ত্রস্ত হচ্ছে কেন? আমি কথা বলতে পাবছি না, শরীর অবসন্ন হচ্ছে, বহু অশভ লক্ষণ দেখছি। আমার ভ্রাতারা কুশলে আছেন তো? কৃষ্ণ বললেন, তুমি চিন্তিত হয়ো না, তাঁরা ভালই আছেন, হয়তো সামান্য কিছু অনিষ্ট হয়ে থাকবে।

 নিরানন্দ আলোকহীন শিবিরে উপস্থিত হয়ে অর্জুন দেখলেন, মাঙ্গলিক বাদ্য বাজছে না, শঙ্খধ্বনি হচ্ছে না, ভ্রাতারা যেন অচেতন হয়ে রয়েছেন। উদ্‌বিগ্ন হয়ে অর্জুন তাঁদের বললেন, আপনারা সকলে ম্লানমুখে রয়েছেন, অভিমন্যুকে দেখছি না। শুনেছি দ্রোণ চক্রব্যূহ রচনা করেছিলেন, অভিমন্যু ভিন্ন আপনাদের আর কেউ তা ভেদ করতে পারেন না। কিন্তু তাকে আমি প্রবেশ করতেই শিখিয়েছি, নির্গমের প্রণালী শেখাই নি। ব্যূহমধ্যে প্রবেশ ক’রে অভিমন্যু কি নিহত হয়েছে? সুভদ্রার প্রিয় পুত্র, দ্রৌপদী কৃষ্ণ ও আমার স্নেহভাজন অভিমন্যুকে কে বধ করেছে? যার কেশপ্রান্ত কুঞ্চিত, চক্ষু হরিণশাবকের ন্যায়, দেহ নব শাল তরুর ন্যায়; যে সর্বদা স্মিতমুখে কথা বলে, গুরুনের আজ্ঞা পালন করে, বালক হয়েও বয়স্থের ন্যায় কার্য করে; যে যুদ্ধে প্রথম প্রহার করে না, অধীরও হয় না, যে মহারথ ব’লে গণ্য, যার বিক্রম আমার চেয়ে অর্ধ গুণ অধিক, যে কৃষ্ণ প্রদ্যুম্ন ও আমার প্রিয় শিষ্য, সেই পুত্রকে যদি দেখতে না পাই তবে আমি যমসদনে যাব। হা পুত্র, আমি ভাগ্যহীন তাই তোমাকে সর্বদা দেখেও আমার তৃপ্তি হ’ত না। যম তোমাকে সবলে নিয়ে গেছেন, তুমি দেবগণের প্রিয় অতিথি হয়েছ।

 তার পর অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, অভিমন্যু শত্রুনিপীড়ন ক’রে সম্মুখ যুদ্ধে স্বর্গারোহণ করেছে তো? কর্ণ দ্রোণ প্রভৃতির বাণে কাতর হয়ে সে নিশ্চয় বার বার বিলাপ করেছে—যদি পিতা এসে আমাকে রক্ষা করতেন! সেই অবস্থায় নৃশংসগণ তাকে নিপাতিত করেছে। অথবা, যে আমার পুত্র, কৃষ্ণের ভাগিনেয়, সুভদ্রার গর্ভজাত, সে এমন বিলাপ করতে পারে না। তাকে না দেখে সুভদ্রা আর দ্রৌপদী কি বলবেন, আমিই বা তাঁদের কি বলব? আমার হৃদয় নিশ্চয় বজ্রসারময়, শোকার্তা বধূ উত্তরার রোদনেও তা বিদীর্ণ হবে না। আমি গর্বিত ধার্তরাষ্ট্রগণের সিংহনাদ শুনেছিলাম, কৃষ্ণও যুযুৎসুকে বলতে শনেছেন—অধর্মজ্ঞ মহারথগণ, অর্জুনের পরিবর্তে একটি বালককে বধ ক’রে চিৎকার করছ কেন?

 পত্রশোকার্ত অর্জুনকে ধ’রে কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, ক্ষান্ত হও, সকল ক্ষত্রিয় বীরেরই এই পথা, অভিমন্যু পুণ্যার্জিতলোকে গেছেন তাতে সংশয় নেই। সকল বীরেরই এই আকাঙ্ক্ষা—যেন সম্মুখ যুদ্ধে আমার মৃত্যু হয়। ভরতশ্রেষ্ঠ, তোমাকে শোকাবিষ্ট দেখে তোমার ভ্রাতারা, এই রাজারা, এবং সুহৃদ্‌গণ সকলেই কাতর হয়েছেন। তুমি সান্ত্বনা দিয়ে এঁদের আশ্বস্ত কর। যা জ্ঞাতব্য তা তুমি জান, অতএব শোক ক’রো না।

 গদ্‌গদকণ্ঠে অর্জুন ভ্রাতাদের বললেন, অভিমন্যুর মৃত্যু কি ক’রে হ’ল শুনতে ইচ্ছা করি। আপনারা রথারোহী হ’য়ে শরবর্ষণ করছিলেন, শত্রুরা অন্যায় যুদ্ধে কি ক’রে তাকে বধ করলে? হা, আপনাদের পৌরুষ নেই, পরাক্রমও নেই। আমারই দোষ, তাই দুর্বল ভীরু অদৃঢ়প্রতিজ্ঞ আপনাদের উপর ভার দিয়ে অন্যত্র গিয়েছিলাম। আপনাদের বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্র অলংকারমাত্র, সভায় যে বীরত্ব প্রকাশ করতেন তাও কেবল মুখের কথা, তাই আমার পুত্রকে রক্ষা করতে পারলেন না। এই ব’লে অর্জুন অশ্রুপূর্ণমুখে অসিকার্মুকহস্তে ক্রুদ্ধ কৃতান্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, মহাবাহু, তুমি সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে দ্রোণ তাঁর সৈন্য ব্যূহবদ্ধ করে আমাদের নিপীড়িত করতে লাগলেন। নিরূপায় হয়ে আমরা অভিমন্যুকে বললাম, বৎস, তুমি দ্রোণের সৈন্য ভেদ কর। যে পথে সে ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করবে সেই পথে আমরাও যাব এই ইচ্ছায় আমরা তার অনুসরণ করলাম, কিন্তু জয়দ্রথ মহাদেবের বরপ্রভাবে আমাদের সকলকেই নিবারিত করলেন। তার পর দ্রোণ কৃপ কর্ণ অশ্বত্থামা বৃহদ্‌বল ও কৃতবর্মা এই ছয় রথী অভিমন্যুকে বেষ্টন করলেন। বালক অভিমন্যু যথাশক্তি যুদ্ধ করতে লাগলেন, কিন্তু অবশেষে তাঁর রথ নষ্ট হ’ল, তখন দুঃশাসনের পুত্র তাঁকে হত্যা করলে। অভিমন্যু বহু সহস্র হস্তী অশ্ব বথ ধধ্বংস ক’রে এবং বহু বীর ও রাজা বৃহদ্‌বলকে স্বর্গে পাঠিয়ে স্বয়ং স্বর্গে গেছেন।

 অর্জুন ‘হা পুত্র’ ব’লে ভূপতিত হলেন, তার পর সংজ্ঞা লাভ ক’রে জ্বররোগীর ন্যায় কাঁপতে কাঁপতে হাতে হাত ঘ’ষে বললেন, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, জয়দ্রথ যদি ভয় পেয়ে দুর্যোধনাদিকে ত্যাগ ক’রে না পালায় তবে কালই তাকে বধ করব। সে যদি আমার বা কৃষ্ণের বা মহারাজ যুধিষ্ঠিরের শরণাপন্ন না হয় তবে কালই তাকে বধ করব। যদি কাল তাকে নিহত করতে না পারি তবে যে নরকে মাতৃহন্তা ও পিতৃহন্তা যায়, গুরুপত্নীগামী, বিশ্বাসঘাতক, ভুক্তপূর্বা স্ত্রীর নিন্দাকারী, গোহন্তা, এবং ব্রাহ্মণহন্তা যায়, সেই নরকে আমি যাব। যে লোক পা দিয়ে ব্রাহ্মণ গো বা অগ্নি স্পর্শ করে, জলে মল মূত্র শ্লেষ্মা ত্যাগ করে, নগ্ন হয়ে স্নান করে, অতিথিকে আহার দেয় না, উৎকোচ নেয়, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, স্ত্রী পুত্র ভৃত্য ও অতিথিকে ভাগ না দিয়ে মিষ্টান্ন খায়; যে ব্রাহ্মণ শীতভীত, যে ক্ষত্রিয় রণভীত, যে কৃতঘ্ন, এবং ধর্মচ্যুত অন্যান্য লোক যে নরকে যায় সেই নরকে আমি যাব। আরও প্রতিজ্ঞা করছি শুনুন—পাপী জয়দ্রথ জীবিত থাকতে যদি কাল সূর্যাস্ত হয় তবে আমি জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করব। সুরাসুর ব্রহ্মর্ষি দেবর্ষি স্থাবর জঙ্গম কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না, সে রসাতলে আকাশে দেবপুরে বা দানবপুরে যেখানেই যাক, আমি শরাঘাতে তার শিরশ্ছেদন করব।

 অর্জন বামে ও দক্ষিণে গাণ্ডীব ধনুর জ্যাকর্ষণ করলেন, সেই নির্ঘোষ তাঁর কণ্ঠধ্বনি অতিক্রম ক’রে আকাশ স্পর্শ করলে। তার পর কৃষ্ণ পাঞ্চজন্য এবং অর্জুন দেবদত্ত শঙ্খ বাজালেন, আকাশ পাতাল ও পৃথিবী কেঁপে উঠল, নানাবিধ বাদ্যধ্বনি হ’ল, পাণ্ডবগণ সিংহনাদ করলেন।

১০। জয়দ্রথের ভয় — সুভদ্রার বিলাপ

 পাণ্ডবগণের সেই মহানিনাদ শুনে এবং চরমুখে অর্জুনের প্রতিজ্ঞার সংবাদ জেনে জয়দ্রথ উদ্‌বিগ্ন হয়ে দুর্যোধনাদিকে বললেন, পাণ্ডুর পত্নীর গর্ভে কামুক ইন্দ্রের ঔরসে যে পুত্র জন্মেছিল সেই দুর্বুদ্ধি অর্জুন আমাকে যমালয়ে পাঠাতে চায়। তোমাদের মঙ্গল হ’ক, আমি প্রাণরক্ষার জন্য নিজ ভবনে চ’লে যাব। অথবা তোমরা আমাকে রক্ষা কর, অভয় দাও। পাণ্ডবদের সিংহনাদ শুনে আমার অত্যন্ত ভয় হয়েছে, মুমূর্ষুর ন্যায় শরীর অবসন্ন হয়েছে। তোমরা অনুমতি দাও, আমি আত্মগোপন করি, যাতে পাণ্ডবরা আমাকে দেখতে না পায়। দুর্যোধন বললেন, নরব্যাঘ্র, ভয় পেয়ো না, তুমি ক্ষত্রিয় বীরগণের মধ্যে থাকলে কে তোমাকে আক্রমণ করবে? আমরা সসৈন্যে তোমাকে রক্ষা করব। তুমি স্বয়ং রথিশ্রেষ্ঠ মহাবীর, তবে পাণ্ডবদের ভয় করছ কেন?

 রাত্রিকালে জয়দ্রথ দুর্যোধনের সঙ্গে দ্রোণের কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম ক’রে বললেন, আচার্য, অস্ত্রশিক্ষায় অর্জুন আর আমার প্রভেদ কি তা জানতে ইচ্ছা করি। দ্রোণ বললেন, বৎস, আমি তোমাদের সমভাবেই শিক্ষা দিয়েছি, কিন্তু যোগাভ্যাস ও কষ্টভোগ ক’রে অর্জন অধিকতর শক্তিমান হয়েছেন। তথাপি তুমি ভয় পেয়ো না, আমি তোমাকে নিশ্চয় রক্ষা করব। আমি এমন ব্যূহ রচনা করব যা অর্জুন ভেদ করতে পারবেন না। তুমি স্বধর্ম অনুসারে যুদ্ধ কর। মনে রেখো, আমরা কেউ চিরকাল বাঁচব না, কালবশে সকলেই নিজ নিজ কর্মসহ পরলোকে যাব। দ্রোণের কথা শুনে জয়দ্রথ আশ্বস্ত হলেন এবং ভয় ত্যাগ ক’রে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন।

 কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে মন্ত্রণা না ক’রেই প্রতিজ্ঞা করেছ যে কাল জয়দ্রথকে বধ করবে; এই দুঃসাহসের জন্য যেন আমরা উপহাসাস্পদ না হই। আমি কৌরবশিবিরে যে চর পাঠিয়েছিলাম তাদের কাছে শুনেছি, কর্ণ ভূরিশ্রবা অশ্বত্থামা বৃষসেন কৃপ ও শল্য এই ছ জন জয়দ্রথের সঙ্গে থাকবেন। এঁদের জয় না করলে জয়দ্রথকে পাবে না। অর্জুন বললেন, আমি মনে করি, এঁদের মিলিত শক্তি আমার অর্ধেকের তুল্য। মধুসূদন, তুমি দেখো, কাল আমি দ্রোণাদির সমক্ষেই জয়দ্রথের মুণ্ড ভূপাতিত করব। কাল সকলেই দেখবে, ক্ষীরান্নভোজী পাপাচারী জয়দ্রথ আমার বাণে বিদীর্ণ হয়ে রণভূমিতে পতিত হয়েছে। দিব্যধনু গাণ্ডীব, আমি যোদ্ধা, আর তুমি সারথি থাকলে কি না জয় করা যায়? কৃষ্ণ, কাল প্রভাতেই যাতে আমার রথ সজ্জিত থাকে তা দেখো। এখন তুমি তোমার ভগিনী সুভদ্রা এবং আমার পুত্রবধূ উত্তরাকে সান্ত্বনা দাও, উত্তরার সহচরীদের শোক দূর কর।

 কৃষ্ণ দুঃখিতমনে অর্জুনের গৃহে গিয়ে সুভদ্রাকে বললেন, বার্ষ্ণেয়ী[১], তুমি আর বধূ উত্তরা কুমার অভিমন্যুর জন্য শোক ক’রো না, কালবশে সকল প্রাণীরই এই গতি হয়। মহৎ কুলে জাত ক্ষত্রিয় বীরের এরূপ মরণই উপযুক্ত। পিতার ন্যায় পরাক্রান্ত মহারথ অভিমন্যু বীরের অভিলষিত গতি লাভ করেছেন। তপস্যা ব্রহ্মচর্য বেদাধ্যয়ন ও প্রজ্ঞা দ্বারা সাধুজন যেখানে যেতে চান তোমার পুত্র সেখানে গেছেন। তুমি বীরপ্রসবিনী বীরপত্নী বীরবান্ধবা, শোক ক’রো না, তোমার তনয় পরমা গতি পেয়েছেন। বালকহন্তা পাপী জয়দ্রথ তার কর্মের উপযুক্ত ফল পাবে, অমরাবতীতে আশ্রয় নিলেও সে অর্জুনের হাতে নিষ্কৃতি পাবে না। তুমি কালই শুনবে, জয়দ্রথের মুণ্ড ছিন্ন হয়ে সমন্তপঞ্চকের বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। রাজ্ঞী, তুমি পুত্রবধূকে আশ্বস্ত কর, কাল তুমি বিশেষ প্রিয় সংবাদ শুনবে, তোমার পতি যে প্রতিজ্ঞা করেছেন তার অন্যথা হবে না।

 পুত্রশোকার্তা সুভদ্রা বিলাপ করতে লাগলেন, হা পুত্র, তুমি এই মন্দভাগিনীর ক্রোড়ে এসে পিতৃতুল্য পরাক্রান্ত হয়েও কেন নিহত হ’লে? তুমি সুখভোগে অভ্যস্ত ছিলে, উত্তম শয্যায় শুতে, আজ কেন বাণবিদ্ধ হয়ে ভূশয়ন করেছ? বরনারীগণ যে মহাবাহুর সেবা করত, আজ শৃগালরা কেন তার কাছে রয়েছে? ভীমার্জুন বৃষ্ণি পাঞ্চাল কেকয় মৎস্য প্রভৃতি বীরগণকে ধিক, তাঁরা তোমাকে রক্ষা করতে পারলেন না! হা বীর, তুমি স্বপ্নলব্ধ ধনের ন্যায় দেখা দিয়ে বিনষ্ট হ’লে! তোমার এই শোকবিহ্বলা তরুণী ভার্যাকে কি ক’রে বাঁচিয়ে রাখব? হা পুত্র, তুমি ফলদানের সময় আমাকে ত্যাগ ক’রে অকালে চ’লে গেলে! যজ্ঞকারী দানশীল ব্রহ্মচর্য পরায়ণ গুরুশুশ্রূষাকারী ব্রাহ্মণদের যে গতি, যুদ্ধে অপরাঙ্‌মুখ শত্রুহন্তা বীরগণের যে গতি, একভার্য পুরুষের যে গতি, সদাচার ও চতুরাশ্রমীর পুণ্য রক্ষাকারী রাজা এবং সর্বভূতের প্রতি প্রীতিযুক্ত অনিষ্ঠুর লোকের যে গতি, তুমি সেই গতি লাভ কর।

 সুভদ্রা উত্তরার সঙ্গে এইরূপ বিলাপ করছিলেন এমন সময় দ্রৌপদী সেখানে এলেন এবং সকলে শোকাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে উন্মত্তের ন্যায় সংজ্ঞাহীন হয়ে প’ড়ে গেলেন। জলসেচনে তাঁদের সচেতন ক’রে কৃষ্ণ বললেন, সুভদ্রা, শোক ত্যাগ কর; পাঞ্চালী, উত্তরাকে সান্ত্বনা দাও। অভিমন্যু ক্ষত্রিয়োচিত উত্তম গতি পেয়েছেন, আমাদের বংশের সকলেই যেন এই গতি পায়। তিনি যে মহৎ কর্ম করেছেন, আমরা ও আমাদের সুহৃদ্‌গণও যেন সেইরূপ কর্ম করতে পারি।

১১। অর্জুনের স্বপ্ন

 সুভদ্রা প্রভৃতির নিকট বিদায় নিয়ে কৃষ্ণ অর্জুনের জন্য কুশ দিয়ে একটি শয্যা রচনা করলেন এবং তার চতুর্দিক মাল্য গন্ধদ্রব্য লাজ ও অস্ত্রশস্ত্রে সাজিয়ে দিলেন। পরিচারকগণ সেই শয্যার নিকটে মহাদেবের নৈশপূজার উপকরণ বেখে দিলে। কৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে অর্জুন পূজা করলেন, তার পর কৃষ্ণ নিজের শিবিরে ফিরে গেলেন।

 সেই রাত্রিতে পাণ্ডবশিবিরে কারও নিদ্রা হ’ল না, সকলেই উদ্‌বিগ্ন হয়ে অর্জুনের দূরূহ প্রতিজ্ঞার বিষয় ভাবতে লাগলেন। মধ্যরাত্রে কৃষ্ণ তাঁর সারথি দারুককে বললেন, আমি কাল এমন কার্য করব যাতে সূর্যাস্তের পূর্বেই অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করতে পারবেন। অর্জুনের চেয়ে প্রিয়তর আমার কেউ নেই, তাঁর জন্য আমি কৌরবগণকে সংহার করব। রাত্রি প্রভাত হ’লেই তুমি আমার রথ প্রস্তুত করবে এবং তাতে আমার কৌমোদকী গদা, দিব্য শক্তি, চক্র, ধনুর্বাণ, ছত্র প্রভৃতি রাখবে এবং চার অশ্ব যোজিত করবে। পাঞ্চজন্যের নির্ঘোষ শুনলেই তুমি সত্বর আমার কাছে আসবে। দারুক বললেন, পুরুষব্যাঘ্র, আপনি যাঁর সারথ্য স্বীকার করেছেন সেই অর্জুন নিশ্চয় জয়ী হবেন। আপনি যে আদেশ করলেন আমি তা পালন করব।

 অর্জুন শিবমন্ত্র জপ করতে করতে নিদ্রিত হলেন। তিনি স্বপ্ন দেখলেন, কৃষ্ণ তাঁর কাছে এসে বলছেন, তোমার বিষাদের কারণ কি তা বল। অর্জুন উত্তর দিলেন, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে কাল সূর্যাস্তের পূর্বে জয়দ্রথকে বধ করব, কিন্তু কৌরবপক্ষের মহারথগণ এবং বিশাল সেনা তাঁকে বেষ্টন ক’রে থাকবে। কি ক’রে তাঁকে আমি দেখতে পাব? এখন সূর্যাস্তও শীঘ্র হয়। কেশব, আমার প্রতিজ্ঞারক্ষা হবে না, আমি জীবিত থাকতেও পারব না।

 কৃষ্ণ বললেন, যদি পাশুপত অস্ত্র তোমার জানা থাকে তবে তুমি কাল জয়দ্রথকে বধ করতে পারবে। যদি জানা না থাকে তবে মনে মনে ভগবান বৃষভধ্বজের ধ্যান ও মন্ত্রজপ কর। অর্জুন আচমন ক’রে ভূমিতে ব’সে একাগ্রমনে ধ্যান করতে লাগলেন। ব্রাহ্মমুহূর্তে তিনি দেখলেন, কৃষ্ণ তাঁর দক্ষিণ হস্ত ধ’রে আছেন, তাঁরা আকাশমার্গে বায়ুবেগে গিয়ে হিমালয় অতিক্রম ক’রে মহামন্দর পর্বতে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে শূলপাণি জটাধারী গৌরবর্ণ মহাদেব, পার্বতী ও প্রমথগণ রয়েছেন, গীত বাদ্য নৃত্য হচ্ছে, ব্রহ্মবাদী মুনিগণ স্তব করছেন। কৃষ্ণ ও অর্জুন ভূমিতে মস্তক স্পর্শ ক’রে সনাতন ব্রহ্ম স্বরূপ মহাদেবকে প্রণাম করলেন, মহাদেব সহাস্যে স্বাগত জানালে কৃষ্ণার্জুন কৃতাঞ্জলি হয়ে স্তব করলেন। অর্জুন দেখলেন, তিনি যে পূজা করেছিলেন তার উপহার মহাদেবের নিকট এসেছে। মহাদেবের কৃপায় অর্জুন পাশুপত অস্ত্রের প্রয়োগ শিক্ষা করলেন। তার পর কৃষ্ণার্জুন মহাদেবকে বন্দনা করে শিবিরে ফিরে এলেন।

 রাত্রি প্রভাত হ’লে বৈতালিকদের স্তব ও গীতবাদ্যের ধ্বনিতে যুধিষ্ঠিরের নিদ্রাভঙ্গ হ’ল। শিক্ষিত পরিচারকগণ কষায় দ্রব্যে গাত্রমার্জন ক’রে মন্ত্রপূত চন্দনাদিযুক্ত জলে তাঁকে স্নান করিয়ে দিলে। জলশোষণের জন্য যুধিষ্ঠির একটি শিথিল উষ্ণীষ পরলেন এবং মাল্য ও কোমল বস্ত্র ধারণ ক’রে যথাবিধি হোম করলেন। তার পর মহার্ঘ অলংকারে ভূষিত হয়ে কৃষ্ণ বিরাট দ্রুপদ সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীম প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, জনার্দন, তুমি সকল আপদ থেকে আমাদের রক্ষা কর, পাণ্ডবগণ অগাধ কুরুসাগরে নিমগ্ন হচ্ছে, তুমি তাদের ত্রাণ কর। শঙ্খচক্রগদাধর দেবেশ পুরুষোত্তম, অর্জুনের প্রতিজ্ঞা সত্য কর। কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, অর্জুনের তুল্য ধনুর্ধর ত্রিলোকে নেই, সমস্ত দেবতা যদি জয়দ্রথের রক্ষক হন তথাপি অর্জুন আজ তাঁকে বধ করবেন।

 এমন সময়ে অর্জুন এসে বললেন, মহারাজ, কেশবের অনুগ্রহে আমি এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখেছি। অর্জুনের মহাদেবদর্শনের বৃত্তান্ত শুনে সকলে ভূতলে মস্তক রেখে প্রণত হয়ে সাধু সাধু বলতে লাগলেন। তার পর অর্জুন বললেন, সাত্যকি, শুভলক্ষণ দেখতে পাচ্ছি, আজ আমি নিশ্চয় জয়ী হব। আজ কৃষ্ণ আর আমি তোমাদের কাছে থাকব না, তুমি সর্বপ্রযত্নে রাজা যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা ক’রো।

  1. বৃষ্ণিবংশজাতা।