মহাভারত (রাজশেখর বসু)/দ্রোণপর্ব/জয়দ্রথবধপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥জয়দ্রথবধপর্বাধ্যায়॥

১২। জয়দ্রথের অভিমুখে কৃষ্ণার্জুন

(চতুর্দশ দিনের যুদ্ধ)

 প্রভাতকালে দ্রোণ জয়দ্রথকে বললেন, তুমি আমার পশ্চাতে ছ ক্রোশ দূরে সসৈন্যে থাকবে, ভূরিশ্রবা কর্ণ অশ্বত্থামা শল্য বৃষসেন ও কৃপ তোমাকে রক্ষা করবেন। দ্রোণ চক্রশকট ব্যূহ রচনা করলেন। এই ব্যূহের পশ্চাতে পদ্ম নামক এক গর্ভব্যূহ এবং তার মধ্যে এক সূচীব্যূহ নির্মিত হ’ল। কৃতবর্মা সূচীব্যূহের সম্মুখে এবং বিশাল সৈন্যে পরিবেষ্টিত জয়দ্রথ এক পার্শ্বে রইলেন। দ্রোণাচার্য চক্রশকট ব্যূহের মুখে রইলেন।

 পাণ্ডবসৈন্য ব্যূহবদ্ধ হ’লে অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, দুর্যোধন-ভ্রাতা দুর্মর্ষণ যেখানে রয়েছে সেখানে রথ নিয়ে চল, আমি এই গজসৈন্য ভেদ ক’রে শত্রুবাহিনীতে প্রবেশ করব। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে দুর্মর্ষণ পরাজিত হচ্ছেন দেখে দুঃশাসন সসৈন্যে অর্জুনকে বেষ্টন করলেন, কিন্তু তাঁর শরবর্ষণে নিপীড়িত ও ত্রস্ত হয়ে শকটব্যূহের মধ্যে দ্রোণের নিকট আশ্রয় নিলেন। অর্জুন দুঃশাসনের সৈন্য ধ্বংস ক’রে দ্রোণের কাছে এলেন এবং কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, ভগবান, আমাকে আশীর্বাদ করুন, আপনার অনুগ্রহে আমি এই দুর্ভেদ্য বাহিনীতে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করি। আপনি আমার পিতৃতুল্য, ধর্মরাজ ও কৃষ্ণের ন্যায় মাননীয়, অশ্বত্থামার তুল্যই আমি আপনার রক্ষণীয়। আপনি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন। ঈষৎ হাস্য ক’রে দ্রোণ বললেন, অর্জুন, আমাকে জয় না ক’রে জয়দ্রথকে জয় করতে পারবে না।

 দ্রোণের সঙ্গে অর্জুনের তুমুল যুদ্ধ হল। কিছু কাল পরে কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, বৃথা কালক্ষেপ ক’রো না, এখন দ্রোণকে ছাড়। অর্জুন চ’লে যাচ্ছেন দেখে দ্রোণ সহাস্যে বললেন, পাণ্ডুপুত্র, কোথায় যাচ্ছ? শত্রুজয় না ক’রে তুমি তো যুদ্ধে বিরত হও না। অর্জুন বললেন, আপনি আমার গুরু, শত্রু নন; আপনাকে পরাজিত করতে পারে এমন পুরুষও কেউ নেই।

 অর্জুন জয়দ্রথের দিকে সত্বর চললেন, পাঞ্চালবীর যুধামন্যু ও উত্তমৌজা তাঁর রক্ষক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। কৃতবর্মা ও কাম্বোজদেশীয় শ্রুতায়ু অর্জুনকে বাধা দিতে লাগলেন। বরুণপত্র রাজা শ্রুতায়ুধ কৃষ্ণকে গদাঘাত করলেন, কিন্তু সেই গদা ফিরে এসে শ্রুতায়ুধকেই বধ করলে। অর্জুনের শরাঘাতে কাম্বোজরাজপুত্র সুদক্ষিণ, শ্রুতায়ু ও অচ্যুতায়ু নিহত হলেন। তার পর বহু সহস্র যবন পারদ শক দরদ পুণ্ড্র প্রভৃতি সৈন্য অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এল। এইসকল মুণ্ডিতমস্তক, অর্ধমুণ্ডিতমস্তক, শ্মশ্রুধারী, অপবিত্র, কুটিলানন ম্লেচ্ছ সৈন্য অর্জুনের বাণে নিপীড়িত হয়ে পালিয়ে গেল।

 কৌরবসৈন্য ভগ্ন হচ্ছে দেখে দুর্যোধন দ্রোণকে বললেন, আচার্য, অর্জুন আপনার সৈন্য ভেদ করায় জয়দ্রথের রক্ষকগণ সংশয়াপন্ন হয়েছেন, তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে জীবিত অবস্থায় অর্জুন আপনাকে অতিক্রম করতে পারবেন না। আমি জানি আপনি পাণ্ডবদের হিতেই রত আছেন। আমি আপনাকে উত্তম বৃত্তি দিয়ে থাকি, যথাশক্তি তুষ্ট রাখি, কিন্তু আপনি তা মনে রাখেন না। আমাদের আশ্রয়ে থেকেই আপনি আমাদের অপ্রিয় কর্ম করছেন, আপনি যে মধুলিপ্ত ক্ষুরের তুল্য তা আমি বুঝতে পারি নি। আমি বুদ্ধিহীন, তাই জয়দ্রথ যখন চ’লে যেতে চেয়েছিলেন তখন আপনার ভরসায় তাঁকে বারণ করেছিলাম। আমি আর্ত হয়ে প্রলাপ বকছি, ক্রুদ্ধ হবেন না, জয়দ্রথকে রক্ষা করুন।

 দ্রোণ বললেন, রাজা, তুমি আমার কাছে অশ্বত্থামার সমান। আমি সত্য বলছি শোন। কৃষ্ণ সারথিশ্রেষ্ঠ, তাঁর অশ্বসকল শীঘ্রগামী, অল্প ফাঁক পেলেও তা দিয়ে অর্জুন শীঘ্র যেতে পারেন। তুমি কি দেখতে পাও না আমার বাণ অর্জুনের রথের এক ক্রোশ পিছনে পড়ে? আমার বয়স হয়েছে, শীঘ্র যেতে পারি না। আমি বলেছি যে যুধিষ্ঠিরকে ধরব, তখন তাঁকে ছেড়ে আমি অর্জুনের কাছে যেতে পারি না। অর্জুন আর তুমি একই বংশে জন্মেছ, তুমি বীর কৃতী ও দক্ষ, তুমিই শত্রুতার সৃষ্টি করেছ। ভয় পেয়ো না, তুমি নিজেই অর্জনের সঙ্গে যুদ্ধ কর।

 দুর্যোধন বললেন, আচার্য, আপনাকে যে অতিক্রম করেছে সেই অর্জুনের সঙ্গে আমি কি ক’রে যুদ্ধ করব? দ্রোণ বললেন, তোমার দেহে আমি এই কাঞ্চনময় কবচ বেঁধে দিচ্ছি, কৃষ্ণ অর্জুন বা অন্য কোনও যোদ্ধা এই কবচ ভেদ করতে পারবেন না। বৃত্রবধের পূর্বে মহাদেব এই কবচ ইন্দ্রকে দিয়েছিলেন। ইন্দ্রের কাছ থেকে যথাক্রমে অঙ্গিরা, তৎপুত্র বৃহস্পতি, অগ্নিবেশ্য ঋষি এবং পরিশেষে আমি এই কবচ পেয়েছি। কবচ ধারণ ক’রে দুর্যোধন অর্জুনের অভিমুখে গেলেন। পাণ্ডবগণ তিন ভাগে বিভক্ত কৌরবসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধে করতে লাগলেন।

 সূর্য যখন অস্তাচলের অভিমুখী হলেন কৃষ্ণার্জুন তখনও জয়দ্রথের দিকে যাচ্ছিলেন। অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ অর্জুনকে বাধা দিতে এসে নিহত হলেন। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, আমার অশ্বসকল বাণে আহত ও ক্লান্ত হয়েছে, জয়দ্রথও দূরে রয়েছে। তুমি অশ্বদের শুশ্রূষা কর, আমি শত্রুসৈন্য নিবারণ করব। এই ব’লে অর্জুন রথ থেকে নামলেন এবং অস্ত্রাঘাতে ভূমি ভেদ ক’রে জলাশয় সৃষ্টি করলেন। সহাস্যে সাধু সাধু ব’লে কৃষ্ণ অশ্বদের পরিচর্যা করে এবং জল খাইয়ে সুস্থ করলেন, তার পর পুনর্বার বেগে রথ চালালেন। অর্জুন কৌরবসৈন্য আলোড়ন করতে করতে অগ্রসর হলেন এবং কিছু দূর গিয়ে জয়দ্রথকে দেখতে পেলেন।

 দ্রোণের সৈন্য অতিক্রম করে অর্জুন জয়দ্রথের অভিমুখে যাচ্ছেন দেখে দুর্যোধন সবেগে এসে অর্জুনের রথের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ বললেন, ধনঞ্জয়, ভাগ্যক্রমে দুর্যোধন তোমার বাণের পথে এসে পড়েছেন, এখন ওঁকে বধ কর। অর্জুন ও দুর্যোধন পরস্পরের প্রতি শরাঘাত করতে লাগলেন। অর্জুনের বাণ নিষ্ফল হচ্ছে দেখে কৃষ্ণ বললেন, জলে পাথর ভাসার ন্যায় অদৃষ্টপূর্ব ব্যাপার দেখছি, তোমার বাণে দুর্যোধনের কিছুই হচ্ছে না। তোমার গাণ্ডীবের শক্তি ও বাহুবল ঠিক আছে তো? অর্জুন বললেন, আমার মনে হয় দুর্যোধনের দেহে দ্রোণ অভেদ্য কবচ বেঁধে দিয়েছেন, এর বন্ধনরীতি আমিও ইন্দ্রের কাছ থেকে শিখেছি। কিন্তু দুর্যোধন স্ত্রীলোকের ন্যায় এই কবচ বৃথা ধারণ ক’রে আছে, কবচ থাকলেও ওকে আমি পরাজিত করব। অর্জুন শরাঘাতে দুর্যোধনের ধনু ও হস্তাবরণ ছিন্ন করলেন এবং অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট করলেন। দুর্যোধনকে মহাবিপদে পতিত দেখে ভূরিশ্রবা কর্ণ কৃপ শল্য প্রভৃতি সসৈন্যে এসে অর্জুনকে বেষ্টন করলেন। পাণ্ডবগণকে ডাকবার জন্য অর্জুন বার বার তাঁর ধনুতে টংকার দিলেন, কৃষ্ণও পাঞ্চজন্য বাজালেন।

 এই সময়ে দ্রোণের নিকটস্থ কৌরবযোদ্ধাদের সঙ্গে পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধাদের ঘোর যুদ্ধে হচ্ছিল। ঘটোৎকচ অলম্বুষ রাক্ষসকে বধ করলেন। পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ দ্রোণের শরাঘাতে নিপীড়িত হ’তে লাগলেন। সহসা পাঞ্চজন্যের ধ্বনি ও কৌরবগণের সিংহনাদ শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, নিশ্চয় অর্জুন বিপদে পড়েছেন। সাত্যকি, তোমার চেয়ে সুহৃত্তম কেউ নেই, তুমি সত্বর গিয়ে অর্জুনকে রক্ষা কর, শত্রুসৈন্য তাঁকে বেষ্টন করেছে।

 সাত্যকি বললেন, মহারাজ, আপনার আদেশ পালনে আমি সর্বদা প্রস্তুত, কিন্তু অর্জুন আমার উপরে আপনার রক্ষার ভার দিয়ে গেছেন, আমি চ’লে গেলে দ্রোণ আপনাকে অনায়াসে বন্দী করবেন। যদি কৃষ্ণনন্দন প্রদ্যুম্ন এখানে থাকতেন তবে তাঁকে আপনার রক্ষার ভার দিয়ে আমি যেতে পারতাম। অর্জুনের জন্য আপনি ভয় পাবেন না, কর্ণ প্রভৃতি মহারথের বিক্রম অর্জুনের ষোল ভাগের এক ভাগও নয়। যুধিষ্ঠির বললেন, অর্জুনের কাছে তোমার যাওয়াই আমি উচিত মনে করি। ভীমসেন আমাকে রক্ষা করবেন, তা ছাড়া ঘটোৎকচ বিরাট দ্রুপদ শিখণ্ডী নকুল সহদেব এবং ধৃষ্টদ্যুম্নও এখানে আছেন।

 যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে সাত্যকি ভীমকে বললেন, রাজা যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা ক’রো, এই তোমার প্রধান কর্তব্য। পাপী জয়দ্রথ নিহত হ’লে আমি ফিরে এসে ধর্মরাজকে আলিঙ্গন করব। সাত্যকি কুরুসৈন্য বিদারণ ক’রে অগ্রসর হলেন। দ্রোণ তাঁকে নিবারণ করবার চেষ্টা ক’রে বললেন, তোমার গুরু অর্জুন কাপুরুষের ন্যায় যুদ্ধে বিরত হয়ে আমাকে প্রদক্ষিণ ক’রে চ’লে গেছেন। তুমিও যদি সত্বর চ’লে না যাও তবে আমার কাছে নিস্তার পাবে না। সাত্যকি বললেন, ভগবান, আমি ধর্মরাজের আদেশে আমার গুরু অর্জুনের কাছে যাচ্ছি, আপনার মঙ্গল হ’ক, আমি আর বিলম্ব করব না। এই ব’লে সাত্যকি দ্রোণকে প্রদক্ষিণ ক’রে বেগে অগ্রসর হলেন। তাঁকে বাধা দেবার জন্য দ্রোণ ও কৌরবপক্ষীয় অন্যান্য বীরগণ ঘোর যুদ্ধ করতে লাগলেন। সাত্যকির শরাঘাতে রাজা জলসন্ধ ও সুদর্শন নিহত হলেন। দ্রোণের সারথি নিপাতিত হ’ল, তাঁর অশ্বসকল উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে রথ নিয়ে ঘুরতে লাগল। তখন কৌরববীরগণ সাত্যকিকে ত্যাগ করে দ্রোণকে রক্ষা করলেন, দ্রোণ বিক্ষতদেহে তাঁর ব্যূহদ্বারে ফিরে গেলেন।

 দুর্যোধনের যবন সৈন্য সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধ করতে এল। তাদের লৌহ ও কাংস্য-নির্মিত বর্ম এবং দেহ ভেদ ক’রে সাত্যকির বাণসকল ভূমিতে প্রবেশ করতে লাগল। যবন কাম্বোজ কিরাত ও বর্বর সৈন্যের মৃতদেহে রণভূমি আচ্ছন্ন হ’ল। পর্বতবাসী পাষাণযোদ্ধারা সাত্যকির উপর শিলাবর্ষণ করতে এল, কিন্তু শরাঘাতে ছিন্নবাহু হয়ে ভূমিতে প’ড়ে গেল।

 সাত্যকির পরাক্রমে ভীত হয়ে অন্যান্য যোদ্ধাদের সঙ্গে দুঃশাসন দ্রোণের কাছে চ’লে এলেন। দ্রোণ বললেন, দুঃশাসন, তোমাদের রথসকল দ্রুতবেগে চ’লে আসছে কেন? জয়দ্রথ জীবিত আছেন তো? রাজপুত্র ও মহাবীর হয়ে তুমি রণস্থল ত্যাগ করলে কেন? তুমি দ্যূতসভায় দ্রৌপদীকে বলেছিলে যে পাণ্ডবগণ ষণ্ডতিল[১] তুল্য, তবে এখন পালিয়ে এলে কেন? তোমার অভিমান দর্প আর বীরগর্জন কোথায় গেল? দ্রোণের ভর্ৎসনা শুনে দুঃশাসন আবার সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলেন কিন্তু পরাজিত হয়ে প্রস্থান করলেন।

 অপরাহ্ণকালে পক্ককেশ শ্যামবর্ণ দ্রোণ আবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। তিনি পঁচাশি বৎসরের বৃদ্ধ হ’লেও ষোল বৎসরের যুবকের ন্যায় বিচরণ করতে লাগলেন। তাঁর শরাঘাতে কেকয়রাজগণের জ্যেষ্ঠ বৃহৎক্ষত্র, শিশুপালপুত্র ধৃষ্টকেতু, এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের পুত্র ক্ষত্রধর্মা নিহত হলেন।

১৩। কর্ণের হস্তে ভীমের পরাজয় — ভূরিশ্রবা-বধ

(চতুর্দশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 কৃষ্ণার্জুনকে দেখতে না পেয়ে এবং গাণ্ডীবের শব্দ শুনতে না পেয়ে যুধিষ্ঠির উদ্‌বিগ্ন হলেন। তিনি ভীমকে বললেন, তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতার কোনও চিহ্ন আমি দেখতে পাচ্ছি না, কৃষ্ণও পাঞ্চজন্য বাজাচ্ছেন। নিশ্চয় ধনঞ্জয় নিহত হয়েছেন এবং কৃষ্ণ স্বয়ং যুদ্ধ করছেন। তুমি সত্বর অর্জুন আর সাত্যকির কাছে যাও। ভীম বললেন, কৃষ্ণার্জুনের কোনও ভয় নেই, তথাপি আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য ক’রে আমি যাচ্ছি। যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবার ভার ধৃষ্টদ্যুম্নকে দিয়ে ভীম অর্জুনের অভিমুখে যাত্রা করলেন, পাঞ্চাল ও সোমক সৈন্যগণ তাঁর সঙ্গে গেল।

 ভীমের ললাটে লৌহবাণ দিয়ে আঘাত ক’রে দ্রোণ সহাস্যে বললেন, কুন্তীপুত্র, আজ আমি তোমার শত্রু, আমাকে পরাস্ত না ক’রে তুমি এই বাহিনী ভেদ করতে পারবে না। ভীম বললেন, ব্রহ্মবন্ধু (নীচ ব্রাহ্মণ), আপনার অনুমতি না পেয়েও অর্জুন এই বাহিনী ভেদ ক’রে গেছেন। আমি আপনার শত্রু ভীমসেন, অর্জুনের মত দয়ালু নই, আপনাকে সম্মানও করি না। এই ব’লে ভীম গদাঘাতে দ্রোণের অশ্ব সারথি ও রথ বিনষ্ট করলেন। দ্রোণ অন্য রথে উঠে ব্যূহদ্বারে চ’লে গেলেন। ভীমের সঙ্গে যুদ্ধে দুর্যোধনের ভ্রাতা বিন্দ অনুবিন্দ সুবর্মা ও সুদর্শন নিহত হলেন। কৌরবগণকে পরাস্ত ক’রে ভীম সত্বর অগ্রসর হলেন এবং কিছু দূরে গিয়ে অর্জুনকে দেখতে পেয়ে সিংহনাদ করলেন। কৃষ্ণার্জুনও সিংহনাদ ক’রে উত্তর দিলেন। এই গর্জন শুনে যুধিষ্ঠির আনন্দিত হলেন।

 দুর্যোধন দ্রোণের কাছে এসে বললেন, আচার্য, অর্জুন সাত্যকি ও ভীম আপনাকে অতিক্রম ক’রে জয়দ্রথের অভিমুখে গেছেন। আমাদের যোদ্ধারা বলছেন, ধনুর্বেদের পারগামী দ্রোণের এই পরাজয় বিশ্বাস করা যায় না। আমি মন্দভাগ্য, এই যুদ্ধে নিশ্চয় আমার নাশ হবে। আপনার অভিপ্রায় কি তা বলুন। দ্রোণ বললেন, পাণ্ডবপক্ষের তিন মহারথ আমাদের অতিক্রম করে গেছেন, আমাদের সেনা সম্মুখে ও পশ্চাতে আক্রান্ত হয়েছে। এখন জয়দ্রথকে রক্ষা করাই প্রধান কর্তব্য। বৎস, শকুনির বুদ্ধিতে যে দ্যূতক্রীড়া হয়েছিল তাতে জয়-পরাজয় কিছুই হয় নি, এই রণস্থলেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে। তোমরা জীবনের মমতা ত্যাগ ক’রে জয়দ্রথকে রক্ষা কর। দ্রোণের উপদেশে দুর্যোধন তাঁর অনুচরদের নিয়ে সত্বর প্রস্থান করলেন।

 কৃষ্ণার্জুনের অভিমুখে ভীমকে যেতে দেখে কর্ণ তাঁকে যুদ্ধে আহ্বান ক’রে বললেন, ভীম, তোমার শত্রুরা যা স্বপ্নেও ভাবে নি তুমি সেই কাজ করছ, পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে চ’লে যাচ্ছ। ভীম ফিরে এসে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। কর্ণ মৃদুভাবে এবং ভীম পূর্বের শত্রুতা স্মরণ ক’রে ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে করতে লাগলেন। দুর্যোধনের আদেশে তাঁর নয় ভ্রাতা দুর্জয় দুর্মুখ চিত্র উপচিত্র চিত্রাক্ষ চারুচিত্র শরাসন চিত্রায়ু ও চিত্রবর্মা কর্ণকে সাহায্য করতে এলেন, কিন্তু ভীম সকলকেই বধ করলেন। তার পর দুর্যোধনের আরও সাত ভ্রাতা শত্রুঞ্জয় শত্রুসহ চিত্র চিত্রায়ুধ দৃঢ় চিত্রসেন ও বিকর্ণ যুদ্ধ করতে এলেন এবং তাঁরাও নিহত হলেন। এইরূপে ভীম একত্রিশ জন ধার্তরাষ্ট্রকে নিপাতিত করলেন।

 কর্ণের শরাঘাতে ভীমের ধনু ছিন্ন এবং রথের অশ্বসকল নিহত হ’ল। ভীম রথ থেকে নেমে খড়্‌গ ও চর্ম নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কর্ণ ভীমের চর্ম ছেদন করলেন, ক্রুদ্ধ ভীম তাঁর খড়্‌গ নিক্ষেপ করে কর্ণের ধনু ছেদন করলেন। কর্ণ অন্য ধনু নিলেন, নিরস্ত্র ভীম হস্তীর মৃতদেহ ও ভগ্ন রথের স্তূপের মধ্যে আশ্রয় নিলেন এবং হস্তীর দেহ নিক্ষেপ ক’রে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কর্ণের শরাঘাতে ভীম মূর্ছিতপ্রায় হলেন। কুন্তীর বাক্য স্মরণ ক’রে কর্ণ ভীমকে বধ করলেন না, কেবল ধনুর অগ্রভাগ দিয়ে স্পর্শ ক’রে বার বার সহাস্যে বললেন, ওরে তূবরক[২] ঔদরিক সংগ্রামকাতর মূঢ়, তুমি অস্ত্রবিদ্যা জান না, আর যুদ্ধ ক’রো না। যেখানে বহুবিধ খাদ্যপানীয় থাকে সেখানেই তোমার স্থান, তুমি রণভূমির অযোগ্য। বৎস বৃকোদর, তুমি বনে গিয়ে মুনি হয়ে ফলমূল খাও গে, কিংবা গৃহে গিয়ে পাচক আর ভৃত্যদের তাড়না কর। আমার মত লোকের সঙ্গে যুদ্ধ করলে তোমাকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হবে। তুমি কৃষ্ণার্জুনের কাছে যাও, কিংবা গৃহে যাও। বালক, তোমার যুদ্ধের প্রয়োজন কি? ভীম বললেন, কেন মিথ্যা গর্ব করছ, আমি তোমাকে বহুবার পরাজিত করেছি। ইন্দ্রেরও জয়-পরাজয় হয়েছিল। নীচকুলজাত কর্ণ, তুমি আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ কর, আমি তোমাকে কীচকের ন্যায় বিনষ্ট করব।

 এই সময়ে অর্জুন কর্ণের প্রতি শরবর্ষণ করতে লাগলেন। ভীমকে ত্যাগ ক’রে কর্ণ দুর্যোধনাদির কাছে গেলেন, ভীমও সাত্যকির রথে উঠে অর্জুনের অভিমুখে চললেন। ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে বাধা দিতে এলেন এবং কিছু কাল ঘোর যুদ্ধের পর সাত্যকিকে ভূপাতিত ক’রে তাঁকে পদাঘাত করলেন এবং মুণ্ডচ্ছেদের উদ্দেশ্যে তাঁর কেশগুচ্ছ ধরলেন। তখন কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন তীক্ষ্ণ শরে ভূরিশ্রবার দক্ষিণ হস্ত কেটে ফেললেন। ভূরিশ্রবা বললেন, কৌন্তেয়, তুমি অতি নশংস কর্ম করলে, আমি অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে রত ছিলাম, সেই সময়ে আমার বাহু ছেদন করলে! এরূপ অস্ত্রপ্রয়োগ কে তোমাকে শিখিয়েছেন, ইন্দ্র রুদ্র দ্রোণ না কৃপ? তুমি কৃষ্ণের উপদেশে সাত্যকিকে বাঁচাবার জন্য এরূপ করেছ। বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশের লোকেরা ব্রাত্য, নিন্দাহ কর্ম করাই ওদের স্বভাব, সেই বংশে জাত কৃষ্ণের কথা তুমি শুনলে কেন? এই ব’লে মহাযশা ভূরিশ্রবা বাঁ হাতে ভূমিতে শর বিছিয়ে প্রায়োপবেশনে বসলেন এবং ব্রহ্মলোকে যাবার ইচ্ছায় যোগস্থ হয়ে মহোপনিষৎ ধ্যান করতে লাগলেন। অর্জুন তাঁকে বললেন, তুমি নিরস্ত্র সাত্যকিকে বধ করতে গিয়েছিলে, নিরস্ত্র বালক অভিমন্যুকে তোমরা হত্যা করেছ, কোন্ ধার্মিক লোক এমন কর্মের প্রশংসা করেন?

 ভূরিশ্রবা ভূমিতে মস্তক স্পর্শ করলেন এবং ছিন্ন দক্ষিণ হস্ত বাম হস্তে ধ’রে অর্জুনের দিকে নিক্ষেপ করলেন। অর্জুন তাঁকে বললেন, আমার ভ্রাতাদের উপর যেমন প্রীতি, তোমার উপরেও সেইরূপ প্রীতি আছে। তুমি উশীনরপুত্র শিবি রাজার ন্যায় পুণ্যলোকে যাও। কৃষ্ণ বললেন, ভূরিশ্রবা, তুমি দেবগণের বাঞ্ছিত আমার লোকে যাও, গরুড়ে আরোহণ ক’রে বিচরণ কর। এই সময়ে সাত্যকি চৈতন্যলাভ ক’রে ভূমি থেকে উঠলেন এবং খড়্‌গ নিয়ে ভূরিশ্রবার শিরশ্ছেদ করতে উদ্যত হলেন। সমস্ত সৈন্য নিন্দা করতে লাগল, কৃষ্ণ অর্জুন ভীম কৃপ অশ্বত্থামা কর্ণ জয়দ্রথ প্রভৃতি উচ্চস্বরে বারণ করতে লাগলেন, তথাপি সাত্যকি যোগমগ্ন ভূরিশ্রবার মস্তক ছেদন করলেন।

 সাত্যকি বললেন, ওহে অধার্মিকগণ, তোমরা আমাকে ‘মেরো না, মেরো না’ ব’লে নিষেধ করছিলে, কিন্তু সুভদ্রার বালক পুত্র যখন নিহত হয় তখন তোমাদের ধর্ম কোথায় ছিল? আমার এই প্রতিজ্ঞা আছে—যে আমাকে যুদ্ধে নিষ্পিষ্ট ক’রে পদাঘাত করবে সে মুনির ন্যায় ব্রতপরায়ণ হ’লেও তাকে আমি বধ করব। আমি ভূরিশ্রবাকে বধ ক’রে উচিত কার্য করেছি, অর্জুন এঁর বাহু কেটে আমাকে বঞ্চিত করেছেন।


 যুদ্ধের বিবরণ শুনতে শুনতে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বললেন, বহুযুদ্ধজয়ী সাত্যকিকে ভূরিশ্রবা কি করে ভূপাতিত করতে পেরেছিলেন? সঞ্জয় বললেন, যযাতির জ্যেষ্ঠপুত্র যদুর বংশে দেবমীঢ় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুত্রের নাম শূর, শুরের পুত্র মহাযশা বসুদেব। যদুর বংশে মহাবীর শিনিও জন্মেছিলেন। দেবকের কন্যা দেবকীর যখন স্বয়ংবর হয় তখন তিনি সেই কন্যাকে বসুদেবের জন্য সবলে হরণ করেন। কুরুবংশীয় সোমদত্ত তা সইলেন না, শিনির সঙ্গে বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। শিনি সোমদত্তকে ভূপাতিত ক’রে পদাঘাত করলেন এবং অসি উদ্যত ক’রে কেশ ধরলেন, কিন্তু পরিশেষে দয়া ক’রে ছেড়ে দিলেন। তার পর সোমদত্ত মহাদেবকে আরাধনায় তুষ্ট ক’রে বর চাইলেন ভগবান, এমন পুত্র দিন যে শিনির বংশধরকে ভূমিতে ফেলে পদাঘাত করবে। মহাদেবের বরে সোমদত্ত ভূরিশ্রবাকে পুত্ররূপে পেলেন। এই কারণেই ভূরিশ্রবা শিনির পৌত্র সাত্যকিকে নিগৃহীত করতে পেরেছিলেন।

১৪। জয়দ্রথবধ

(চতুর্দশ দিনের আরও যুদ্ধ)

 অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, সূর্যাস্তের আর বিলম্ব নেই, জয়দ্রথের কাছে রথ নিয়ে চল, আমি যেন প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারি। অর্জুনকে আসতে দেখে দুর্যোধন কর্ণ বৃষসেন শল্য অশ্বত্থামা কৃপ এবং স্বয়ং জয়দ্রথ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, দিনের অল্পই অবশিষ্ট আছে, জয়দ্রথকে যদি সূর্যাস্ত পর্যন্ত রক্ষা করা যায় তবে অর্জুনের প্রতিজ্ঞা মিথ্যা হবে, সে অগ্নিপ্রবেশ করবে। অর্জুন মরলে তার ভ্রাতারাও মরবে, তার পর আমরা নিষ্কণ্টক হয়ে পৃথিবী ভোগ করব। কর্ণ, তোমরা সকলে আমার সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশেষ যত্ন সহকারে যুদ্ধ কর। কর্ণ বললেন, ভীম আমার দেহ ক্ষতবিক্ষত করেছে, যদ্ধে থাকা কর্তব্য সেজন্যই আমি এখানে আছি, কিন্তু আমার অঙ্গসকল অচল হয়ে আছে; তথাপি আমি যথাশক্তি যুদ্ধ করব। মহারাজ, তোমার জন্য আমি পুরুষকার আশ্রয় ক’রে অর্জনের সঙ্গে যুদ্ধ করব, কিন্তু জয় দৈবের অধীন।

 তীক্ষ্ণ শরাঘাতে অর্জুন বিপক্ষের সৈন্য হস্তী ও অশ্ব সংহার করতে লাগলেন এবং ভীমসেন ও সাত্যকি কর্তৃক রক্ষিত হয়ে ক্রমশ জয়দ্রথের নিকটস্থ হলেন। দুর্যোধন কর্ণ কৃপ প্রভৃতি অর্জুনকে বেষ্টন করলেন কিন্তু অর্জুনের প্রচণ্ড বাণবর্ষণে তাঁরা আকুল হয়ে স’রে গেলেন। অর্জুনের শরাঘাতে জয়দ্রথের সারথির মুণ্ড এবং রথের বরাহধ্বজ ভূপাতিত হ’ল। সূর্য দ্রুতগতিতে অস্তাচলে যাচ্ছেন দেখে কৃষ্ণ বললেন, ভীত জয়দ্রথকে ছ জন মহারথ রক্ষা করছেন, এঁদের জয় না করে কিংবা ছলনা ভিন্ন তুমি জয়দ্রথকে বধ করতে পারবে না। আমি যোগবলে সূর্যকে আবৃত করব, তখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে ভেবে জয়দ্রথ আর আত্মগোপন করবেন না, সেই অবকাশে তুমি তাঁকে প্রহার ক’রো।

 যোগীশ্বর হরি যোগযুক্ত হয়ে সূর্যকে তমসাচ্ছন্ন করলেন। সূর্যাস্ত হয়েছে, এখন অর্জুন অগ্নিপ্রবেশ করবেন—এই ভেবে কৌরবযোদ্ধারা হৃষ্ট হলেন। জয়দ্রথ ঊর্ধ্বমুখ হয়ে সূর্য দেখতে পেলেন না। কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন জয়দ্রথ ভয়মুক্ত হয়ে সূর্য দেখছেন, দুরাত্মাকে বধ করবার এই সময়।

 কৃপ কর্ণ শল্য দুর্যোধন প্রভৃতিকে শরাঘাতে বিতাড়িত ক’রে অর্জুন জয়দ্রথের প্রতি ধাবিত হলেন। ধূলি ও অন্ধকারে চতুর্দিক আচ্ছন্ন হওয়ায় যোদ্ধারা কেউ কাকেও দেখতে পেলেন না, অশ্বারোহী গজারোহী ও পদাতি সৈন্য অর্জুনের বাণে বিদারিত হয়ে পালাতে লাগল। কৃষ্ণ পুনর্বার বললেন, অর্জুন, জয়দ্রথের শিরশ্ছেদ কর, সূর্য অস্তে যাচ্ছেন। যা করতে হবে শোন।—বিখ্যাত রাজা বৃদ্ধক্ষত্র জয়দ্রথের পিতা। পুত্রের জন্মকালে তিনি এই দৈববাণী শুনেছিলেন যে রণস্থলে কোনও শত্রু এর শিরশ্ছেদন করবে। পুত্রবৎসল বৃদ্ধক্ষত্র এই অভিশাপ দিলেন — যে আমার পুত্রের মস্তক ভূমিতে ফেলবে তার মস্তক শতধা বিদীর্ণ হবে। তার পর যথাকালে জয়দ্রথকে রাজপদ দিয়ে বৃদ্ধক্ষত্র বনগমন করলেন, এখন তিনি সমন্তপঞ্চকের বাইরে দুষ্কর তপস্যা করছেন। অর্জুন, তুমি অদ্ভুতশক্তিসম্পন্ন কোনও দিব্য অস্ত্র দিয়ে জয়দ্রথের মুণ্ড কেটে বৃদ্ধক্ষত্রের ক্রোড়ে ফেল। যদি ভূমিতে ফেল তবে তোমার মস্তক বিদীর্ণ হবে।

 ওষ্ঠপ্রান্ত লেহন ক’রে অর্জুন এক মন্ত্রসিদ্ধ বজ্রতুল্য বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণ শ্যেন পক্ষীর ন্যায় দ্রুতবেগে গিয়ে জয়দ্রথের মুণ্ড ছেদন ক’রে আকাশে উঠল। অর্জুনের আরও কতকগুলি বাণ সেই মুণ্ড ঊর্ধ্বে বহন ক’রে নিয়ে চলল, অর্জুন পুনর্বার ছয় মহারথের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। এই সময়ে ধৃতরাষ্ট্রের বৈবাহিক রাজা বৃদ্ধক্ষত্র সন্ধ্যাবন্দনা করছিলেন। সহসা কৃষ্ণকেশ ও কুণ্ডলে শোভিত জয়দ্রথের মস্তক তাঁর ক্রোড়ে পতিত হল। বধক্ষত্র ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন, তখন তাঁর পুত্রের মস্তক ভূমিতে পড়ল, তাঁর নিজের মস্তকও শতধা বিদীর্ণ হ’ল।

 তার পর কৃষ্ণ অন্ধকার অপসারিত করলেন। কৌরবগণ বুঝলেন বাসুদেবের মায়াবলে এমন হয়েছে। দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা অশ্রুমোচন করতে লাগলেন। কৃষ্ণ অর্জুন ভীম সাত্যকি প্রভৃতি শঙ্খধ্বনি করলেন, সেই নিনাদ শুনে যুধিষ্ঠির বুঝলেন যে জয়দ্রথ নিহত হয়েছেন।

১৫। দুর্যোধনের ক্ষোভ

 দুর্যোধন বিষণ্ণমনে দ্রোণকে বললেন, আচার্য, আমাদের কিরূপে ধ্বংস হচ্ছে দেখুন। পিতামহ ভীষ্ম, মহাবীর জলসন্ধ, কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, রাক্ষসরাজ অলম্বুষ, মহাবল ভূরিশ্রবা, সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ, এবং আমার অসংখ্য সৈন্য নিহত হয়েছে। আমি লোভী পাপী ধর্মনাশক, তাই আমার জয়াভিলাষী যোদ্ধারা যমালয়ে গেছেন। পাণ্ডব আর পাঞ্চালদের যুদ্ধে বধ ক’রে আমি শান্তিলাভ করব কিংবা নিজে নিহত হয়ে বীরলোকে যাব। আমি সহায়হীন, সকলে পাণ্ডবদের হিতকামনা যেমন করেন তেমন আমার করেন না। ভীষ্ম নিজেই নিজের মৃত্যুর উপায় ব’লে দিলেন, অর্জুন আপনার শিষ্য তাই আপনিও যুদ্ধে উপেক্ষা করছেন। আমার আর জীবনে প্রয়োজন নেই। পাণ্ডবগণের আচার্য, আপনি আমাকে মরণের অনুমতি দিন।

 দ্রোণ বললেন, তুমি আমাকে বাক্যবাণে পীড়িত করছ কেন? আমি সর্বদাই ব’লে থাকি যে সব্যসাচীকে জয় করা অসম্ভব। তোমরা জয়দ্রথকে রক্ষা করবার জন্য অর্জুনকে বেষ্টন করেছিলে; তুমি কর্ণ কৃপ শল্য ও অশ্বত্থামা জীবিত থাকতে জয়দ্রথ নিহত হলেন কেন? তিনি অর্জুনের হাতে নিস্তার পান নি, আমিও নিজের জীবন রক্ষার উপায় দেখছি না। আমি অত্যন্ত সন্তপ্ত হয়ে আছি, এর উপর তুমি তীক্ষ্ণ বাক্য বলছ কেন? যখন ভূরিশ্রবা আর সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ নিহত হয়েছেন তখন আর কে অবশিষ্ট থাকবে? দুর্যোধন, আমি সমস্ত পাণ্ডবসৈন্য ধ্বংস না ক’রে বর্ম খুলব না। তুমি অশ্বত্থামাকে ব’লো সে জীবিত থাকতে যেন সোমকগণ রক্ষা না পায়। তোমার বাক্যে পীড়িত হয়ে আমি শত্রুবাহিনীর মধ্যে প্রবেশ করছি; যদি পার তবে কৌরবসৈন্য রক্ষা ক’রো, আজ রাত্রিতেও যুদ্ধ হবে। এই ব’লে দ্রোণ পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণের প্রতি ধাবিত হলেন।

 দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, দ্রোণ যদি পথ ছেড়ে না দিতেন তবে অর্জুন কি ব্যূহ ভেদ করতে পারত? সে চিরকালই দ্রোণের প্রিয় তাই যুদ্ধ না ক’রেই দ্রোণ তাকে প্রবেশ করতে দিয়েছিলেন। প্রাণরক্ষার জন্য জয়দ্রথ গৃহে যেতে চেয়েছিলেন, দ্রোণ তাঁকে অভয় দিলেন, কিন্তু আমার নির্গুণতা দেখে অর্জুনকে ব্যূহদ্বার ছেড়ে দিলেন। আমরা অনার্য দুরাত্মা, তাই আমাদের সমক্ষেই আমার চিত্রসেন প্রভৃতি ভ্রাতারা ভীমের হাতে বিনষ্ট হয়েছেন।

 কর্ণ বললেন, তুমি আচার্যের নিন্দা করো না, এই ব্রাহ্মণ জীবনের আশা ত্যাগ ক’রে যথাশক্তি যুদ্ধ করছেন। তিনি স্থবির, শীঘ্রগমনে অক্ষম, বাহুচালনাতেও অশক্ত হয়েছেন। অস্ত্রবিশারদ হ’লেও তিনি পাণ্ডবদের জয় করতে পারবেন না। দুর্যোধন, আমরাও যথাশক্তি যুদ্ধ করছিলাম তথাপি সিন্ধুরাজ নিহত হয়েছেন, এজন্য মনে করি দৈবই প্রবল। আমরা পাণ্ডবদের সঙ্গে শঠতা করেছি, বিষ দিয়েছি, জতুগৃহে অগ্নি দিয়েছি, দ্যূতে পরাজিত করেছি, রাজনীতি অনুসারে বনবাসে পাঠিয়েছি, কিন্তু দৈবের প্রভাবে সবই নিষ্ফল হয়েছে। তুমি ও পাণ্ডবরা মরণপণ করে সর্বপ্রযত্নে যুদ্ধ কর, দৈব তার নিজ মার্গেই চলবে। সৎ বা অসৎ সকল কার্যের পরিণামে দৈবই প্রবল, মানুষ নিদ্রিত থাকলেও অনন্যকর্মা দৈব জেগে থাকে।

  1. যে তিলের অঙ্কুর হয় না, অর্থাৎ নপুংসক।
  2. দাড়িগোঁফহীন, মাকুন্দ।