মহাভারত (রাজশেখর বসু)/শল্যপর্ব/গদাযুদ্ধপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥গদাযুদ্ধপর্বাধ্যায়॥

৮। গদাযুদ্ধের উপক্রম

 দুর্যোধন পূর্বে কখনও ভর্ৎসনা শোনেন নি, সকলের কাছেই তিনি রাজসম্মান পেতেন। ছত্রের ছায়া এবং সূর্যের অল্প কিরণেও যাঁর কষ্ট হ’ত, সমস্ত লোক যাঁর প্রসাদের উপর নির্ভর করত, এখন অসহায় সংকটাপন্ন অবস্থায় তাঁকে যুধিষ্ঠিরের কটুবাক্য শুনতে হ’ল। দুর্যোধন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হাত নেড়ে বললেন, রাজা, আপনাদের সুহৃৎ রথ বাহন সবই আছে; আমি একাকী, শোকার্ত, রথবাহনহীন। আপনারা সশস্ত্র, রথারোহী এবং বহু; যদি আপনারা সকলে আমাকে বেষ্টন করেন তবে নিরস্ত্র পাদচারী একাকী আমি কি ক’রে যুদ্ধ করব? আপনারা একে একে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করুন। রাত্রিশেষে সূর্য যেমন সমস্ত নক্ষত্র বিনষ্ট করেন, আমিও সেইরূপ নিরস্ত্র ও রথহীন হয়েও নিজের তেজে রথ ও অশ্ব সমেত আপনাদের সকলকেই বিনষ্ট করব।

 যুধিষ্ঠির বললেন, মহাবাহু সুযোধন, ভাগ্যক্রমে তুমি ক্ষত্রধর্ম বুঝেছ এবং তোমার যুদ্ধে মতি হয়েছে। তুমি বীর এবং যুদ্ধ করতেও জান। মনোমত অস্ত্র নিয়ে তুমি আমাদের এক এক জনের সঙ্গেই যুদ্ধ কর, আমরা আর সকলে দর্শক হয়ে থাকব। আমি তোমার ইষ্টের জন্য আরও বলছি, তুমি আমাদের মধ্যে কেবল একজনকে বধ করলেই কুরুরাজ্য লাভ করবে; আর যদি নিহত হও তবে স্বর্গে যাবে। দুর্যোধন বললেন, একজন বীরই আমাকে দিন; আমি এই গদা নিলাম, আমার প্রতিদ্বন্দ্বীও গদা নিয়ে পাদচারী হয়ে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করুন।

 উত্তম অশ্ব যেমন কশাঘাত সইতে পারে না দুর্যোধন সেইরূপ যুধিষ্ঠিরের বাক্যে বার বার আহত হয়ে অসহিষ্ণু হলেন। তিনি জল আলোড়িত করে নাগরাজের ন্যায় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে কাঞ্চনবলয়মণ্ডিত বৃহৎ লৌহগদা নিয়ে হ্রদ থেকে উঠলেন। বজ্রধর ইন্দ্রের ন্যায় এবং শূলপাণি মহাদেবের ন্যায় দুর্যোধনকে দেখে পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ হৃষ্ট হয়ে করতালি দিতে লাগলেন। উপহাস মনে করে দুর্যোধন সক্রোধে ওষ্ঠদংশন ক’রে বললেন, পাণ্ডবগণ, তোমরা শীঘ্রই এই উপহাসের প্রতিফল পাবে, পাঞ্চালদের সঙ্গে সদ্য যমালয়ে যাবে।

 তার পর রক্তাক্তদেহ দুর্যোধন মেঘমন্দ্রস্বরে বললেন, যুধিষ্ঠির, আমি অবশ্যই আপনাদের সকলের সঙ্গে যুদ্ধ করব, কিন্তু আপনি জানেন যে একজনের সঙ্গে এককালে বহুলোকের যুদ্ধ উচিত নয়। যুধিষ্ঠির বললেন, সুযোধন, যখন অনেক মহারথ মিলে অভিমন্যুকে বধ করেছিলে তখন তোমার এই বুদ্ধি হয় নি কেন? লোকে বিপদে পড়লেই ধর্মের সন্ধান করে, কিন্তু সম্পদের সময় তারা পরলোকের দ্বার রুদ্ধ দেখে। বীর, তুমি বর্ম ধারণ কর, কেশ বন্ধন কর, যুদ্ধের যে উপকরণ তোমার নেই তাও নাও। আমি পুনর্বার বলছি, পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে যাঁর সঙ্গে তোমার ইচ্ছা তাঁরই সঙ্গে যুদ্ধ কর; তাঁকে বধ ক’রে কুরুরাজ্যের অধিপতি হও, অথবা নিহত হয়ে স্বর্গে যাও। তোমার জীবনরক্ষা ভিন্ন আর কি প্রিয়কার্য করব বল।

 দুর্যোধন স্বর্ণময় বর্ম ও বিচিত্র শিরস্ত্রাণ ধারণ ক’রে গদাহস্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, দুর্যোধন যদি আপনার সঙ্গে অথবা অর্জুন নকুল বা সহদেবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চান তবে কি হবে? আপনি কেন এই দুঃসাহসের কথা বললেন — ‘আমাদের মধ্যে একজনকে বধ ক’রেই কুরুরাজ্যের অধিপতি হও’? ভীমসেনকে বধ করবার ইচ্ছায় দুর্যোধন তের বৎসর একটা লৌহমূর্তির উপর গদাপ্রহার অভ্যাস করেছেন। ভীমসেন ভিন্ন দুর্যোধনের প্রতিযোদ্ধা দেখছি না, কিন্তু ভীমও গদাযুদ্ধশিক্ষায় অধিক পরিশ্রম করেন নি। আপনি শকুনির সঙ্গে দ্যূতক্রীড়া ক’রে যেমন বিষম কার্য করেছিলেন, আজও সেইরূপ করছেন। ভীম অধিকতর বলবান ও সহিষ্ণু, কিন্তু দুর্যোধন অধিকতর কৃতী; বলবান অপেক্ষা কৃতীই শ্রেষ্ঠ। মহারাজ, আপনি শত্রুকে সুবিধা দিয়েছেন, আমাদের বিপদে ফেলেছেন। গদাহস্ত দুর্যোধনকে জয় করতে পারেন এমন মানুষ বা দেবতা আমি দেখি না। আপনারা কেউ ন্যায়যুদ্ধে দুর্যোধনকে জয় করতে পারবেন না। পাণ্ডু ও কুন্তীর পুত্রগণ নিশ্চয়ই রাজ্যভোগের জন্য সৃষ্ট হন নি, দীর্ঘকাল বনবাস ও ভিক্ষার জন্যই সৃষ্ট হয়েছেন।

 ভীম বললেন, মধুসূদন, তুমি বিষণ্ণ হয়ো না, আজ আমি দুর্যোধনকে বধ করব তাতে সন্দেহ নেই। আমার গদা দুর্যোধনের গদার চেয়ে দেড় গুণ ভারী, অতএব তুমি দুঃখ করো না। দুর্যোধনের কথা দূরে থাক, আমি দেবগণ এবং ত্রিলোকের সকলের সঙ্গেই যুদ্ধ করতে পারি। বাসুদেব হৃষ্ট হয়ে বললেন, মহাবাহু, আপনাকে আশ্রয় ক’রেই ধর্মরাজ শত্রুহীন হয়ে রাজলক্ষী লাভ করবেন তাতে সন্দেহ নেই। বিষ্ণু যেমন দানবসংহার ক’রে শচীপতি ইন্দ্রকে স্বর্গরাজ্য দিয়েছিলেন, আপনিও সেইরূপ দুর্যোধনকে বধ করে ধর্মরাজকে সসাগরা পৃথিবী দিন।

 ভীম গদাহস্তে দণ্ডায়মান হয়ে দুর্যোধনকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। মত্ত হস্তী যেমন মত্ত হস্তীর অভিমুখে যায়, দুর্যোধন সেইরূপ ভীমের কাছে গেলেন। ভীম তাঁকে বললেন, রাজা ধৃতরাষ্ট্র আর তুমি যেসব দুষ্কৃত করেছ তা এখন স্মরণ কর। দুরাত্মা, তুমি সভামধ্যে রজস্বলা দ্রৌপদীকে কষ্ট দিয়েছিলে, শকুনির বুদ্ধিতে যুধিষ্ঠিরকে দ্যূতক্রীড়ায় জয় করেছিলে, নিরপরাধ পাণ্ডবদের প্রতি বহু দুর্ব্যবহার করেছিলে, তার মহৎ ফল এখন দেখ। তোমার জন্যই আমাদের পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় প’ড়ে আছেন, দ্রোণ কর্ণ শল্য শকুনি, তোমার বীর ভ্রাতা ও পুত্রেরা, এবং তোমার পক্ষের রাজারা সসৈন্যে নিহত হয়েছেন। কুলঘ্ন পুরুষাধম একমাত্র তুমিই এখন অবশিষ্ট আছ, আজ তোমাকে গদাঘাতে বধ করব তাতে সন্দেহ নেই।

 দুর্যোধন বললেন, বৃকোদর, আত্মশ্লাঘা ক’রে কি হবে, আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর, তোমার যুদ্ধপ্রীতি আজ দূর করব। পাপী, কোন্ শত্রু আজ ন্যায়যুদ্ধে আমাকে জয় করতে পারবে? ইন্দ্রও পারবেন না। কুন্তীপুত্র, শরৎকালীন মেঘের ন্যায় বৃথা গর্জন ক’রো না, তোমার যত বল আছে তা আজ যুদ্ধে দেখাও।

 এই সময়ে হলায়ুধ বলরাম সেখানে উপস্থিত হলেন; তিনি সংবাদ পেয়েছিলেন যে দুর্যোধন ও ভীম যুদ্ধে উদ্যত হয়েছেন। কৃষ্ণ ও পাণ্ডবগণ তাঁকে যথাবিধি অর্চনা ক’রে বললেন, আপনি আপনার দুই শিষ্যের যুদ্ধকৌশল দেখুন। বলরাম বললেন, কৃষ্ণ, আমি পুষ্যা নক্ষত্রে দ্বারকা ত্যাগ করেছি, তার পর বিয়াল্লিশ দিন গত হয়েছে, এখন শ্রবণা নক্ষত্রে এখানে এসেছি। এই বলে নীলবসন শুভ্রকান্তি বলরাম সকলকে যথাযোগ্য সম্মাননা আলিঙ্গন ও কুশলপ্রশ্ন ক'রে যুদ্ধ দেখবার জন্য উপবিষ্ট হলেন।

৯। বলরামের তীর্থভ্রমণ—চন্দ্রের যক্ষ্মা—একত দ্বিত ত্রিত

 জনমেজয় বৈশম্পায়নকে বললেন, বলরাম পূর্বে কৃষ্ণকে বলেছিলেন যে তিনি ধৃতরাষ্ট্রপুত্র বা পাণ্ডুপুত্র কাকেও সাহায্য করবেন না, ইচ্ছানুসারে দেশভ্রমণ করবেন; তবে আবার তিনি কুরুক্ষেত্রে কেন এলেন? বৈশম্পায়ন বললেন, কৃতবর্মা যখন যাদবসৈন্য নিয়ে দুর্যোধনের পক্ষে গেলেন এবং কৃষ্ণ ও সাত্যকি পাণ্ডবপক্ষে গেলেন, তখন বলরাম ক্রুদ্ধ হয়ে তীর্থযাত্রায় নির্গত হলেন। তিনি বহু সুবর্ণ রজত বস্ত্র অশ্ব হস্তী রথ গর্দভ উষ্ট্র প্রভৃতি সঙ্গে নিলেন, ঋত্বিক ও ব্রাহ্মণগণও তাঁর সঙ্গে যাত্রা করলেন। বলরাম সমুদ্র থেকে সরস্বতী নদীর স্রোতের বিপরীত দিকে যেতে লাগলেন এবং দেশে দেশে শ্রান্ত ও ক্লান্ত, শিশু ও বৃদ্ধ বহু লোককে এবং ব্রাহ্মণগণকে খাদ্য পানীয় ধনরত্ন ধেনু যানবাহন প্রভৃতি দান করলেন।

 বলরাম প্রথমে পবিত্র প্রভাসতীর্থে গেলেন। পুরাকালে প্রজাপতি দক্ষ চন্দ্রকে তাঁর সাতাশ কন্যা (নক্ষত্র) দান করেছিলেন। এই কন্যারা সকলেই অতুলনীয় রূপবতী ছিলেন, কিন্তু চন্দ্র সর্বদা রোহিণীর সঙ্গেই বাস করতেন। দক্ষের অন্য কন্যারা রুষ্ট হয়ে দক্ষের কাছে অভিযোগ করলেন। দক্ষ বহু বার চন্দ্রকে বললেন, তুমি সকল ভার্যার সহিত সমান ব্যবহার করবে; কিন্তু চন্দ্র তা শুনলেন না। তখন দক্ষের অভিশাপে চন্দ্র যক্ষা রোগে আক্রান্ত হলেন। চন্দ্রের ক্ষয় দেখে দেবতারা দক্ষকে বললেন, ভগবান, প্রসন্ন হ’ন, আপনার শাপে চন্দ্র ক্ষীণ হচ্ছেন, তার ফলে লতা ওষধি বীজ এবং প্রজাগণও ক্ষীণ হচ্ছে, আমরাও ক্ষীণ হচ্ছি। দক্ষ বললেন, আমার বাক্যের প্রত্যাহার হবে না। চন্দ্র সকল ভার্যার সঙ্গে সমান ব্যবহার করুন, সরস্বতী নদীর প্রধান তীর্থ প্রভাসে অবগাহন করুন, তার পর পুনর্বার বৃদ্ধিলাভ করবেন; কিন্তু মাসার্ধকাল তাঁর নিত্য ক্ষয় হবে এবং মাসার্ধকাল নিত্য বৃদ্ধি হবে। চন্দ্র পশ্চিম সমুদ্রে সরস্বতীর সংগমস্থলে গিয়ে বিষ্ণুর আরাধনা করুন তা হ’লে কান্তি ফিরে পানে। চন্দ্র প্রভাসতীর্থে গেলেন এবং অমাবস্যায় অবগাহন ক’রে ক্রমশ তাঁর শীতল কিরণ ফিরে পেলেন। তদবধি তিনি প্রতি অমাবস্যায় প্রভাসতীর্থে স্নান করে বর্ধিত হন। চন্দ্র সেখানে প্রভা লাভ করেছিলেন এজন্যই ‘প্রভাস’ নাম।


 তার পর বলরাম ক্রমশ উদপানতীর্থে গেলেন। সত্যযুগে সেখানে গৌতমের তিন পুত্র একত দ্বিত ও ত্রিত বাস করতেন। তাঁরা স্থির করলেন যে তাঁদের যজমানদের কাছ থেকে বহু পশ, সংগ্রহ করবেন এবং মহাফলপ্রদ যজ্ঞ ক’রে আনন্দে সোমরস পান করবেন। তিন ভ্রাতা বহু পশু লাভ করে ফিরলেন, ত্রিত আগে আগে এবং একত ও দ্বিত পশুর দল নিয়ে পিছনে চললেন। দুষ্টবুদ্ধি একত ও দ্বিত পরামর্শ করলেন, ত্রিত যজ্ঞনিপুণ ও বেদজ্ঞ, সে বহু পশু লাভ করতে পারবে; আমরা দুজনে এইসকল পশু নিয়ে চ’লে যাই, ত্রিত একাকী যেখানে ইচ্ছা হয় যাক। রাত্রিকালে চলতে চলতে ত্রিত এক বৃক (নেকড়ে) দেখতে পেলেন এবং ভীত হয়ে পালাতে গিয়ে সরস্রতীতীরবর্তী এক অগাধ কূপে প’ড়ে গেলেন। তিনি আর্তনাদ করতে লাগলেন, একত ও দ্বিত শুনতে পেয়েও এলেন না, বৃকের ভয়ে এবং লোভের বশে পশু নিয়ে চ’লে গেলেন। ত্রিত দেখলেন, কূপের মধ্যে একটি লতা ঝুলছে। তিনি সেই লতাকে সোম, কূপের জলকে ঘৃত এবং কাঁকরকে শর্করা কল্পনা ক’রে যজ্ঞ করলেন। তাঁর উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বৃহস্পতি দেবগণকে সঙ্গে নিয়ে কূপের নিকটে এলেন। দেবতারা বললেন, আমরা যজ্ঞের ভাগ নিতে এসেছি। ত্রিত যথাবিধি মন্ত্র পাঠ করে যজ্ঞভাগ দিলেন। দেবগণ প্রীত হয়ে বর দিতে চাইলেন। ত্রিত বললেন, আপনারা আমাকে উদ্ধার করুন এবং এই বর দিন — যে এই কূপের জল স্পর্শ করবে সে সোমপায়ীদের গতি লাভ করবে। তখন কূপ থেকে ঊর্মিমতী সরস্বতী নদী উত্থিত হলেন, ত্রিত উৎক্ষিপ্ত হয়ে তীরে উঠে দেবগণের পূজা করলেন। তার পর তিনি তাঁর দুই লোভী ভ্রাতাকে শাপ দিলেন — তোমরা বৃকের ন্যায় দংষ্ট্রাযক্ত ভীষণ পশু হবে, তোমাদের সন্তানগণ ভল্লুক ও বানর হবে।

১০। অসিতদেবল ও জৈগীষব্য—সারস্বত

 বলরাম সপ্তসারস্বত কপালমোচন প্রভৃতি সরস্বতীতীরস্থ বহু তীর্থ দর্শন করে আদিত্যতীর্থে উপস্থিত হলেন। পুরাকালে তপস্বী অসিতদেবল গার্হস্থ্য ধর্ম আশ্রয় ক’রে সেখানে বাস করতেন। তিনি সর্ববিষয়ে সমদর্শী ছিলেন, নিত্য দেবতা ব্রাহ্মণ ও অতিথির পূজা করতেন এবং সর্বদা ব্রহ্মচর্যে ও ধর্মকার্যে রত থাকতেন। একদা ভিক্ষু জৈগীষব্য মুনি দেবলের আশ্রমে এলেন এবং যোগনিরত হয়ে সেখানেই বাস করতে লাগলেন। তিনি কেবল ভোজনকালে দেবলের নিকট উপস্থিত হতেন। দীর্ঘকাল পরে একদিন দেবল জৈগীষব্যকে দেখতে পেলেন না। দেবল ভাবলেন, আমি বহু বৎসর এই অলস ভিক্ষুর সেবা করেছি, কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে কোনও আলাপ করেন নি। আকাশচারী দেবল একটি কলস নিয়ে মহাসমুদ্রে গেলেন এবং দেখলেন, জৈগীষব্য পূর্বেই সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। দেবল বিস্মিত হলেন এবং স্নানাদির পর জলপূর্ণ কলস নিয়ে আশ্রমে ফিরে এসে দেখলেন, জৈগীষব্য নীরবে কাষ্ঠের ন্যায় ব’সে আছেন। মন্ত্রজ্ঞ দেবল ভিক্ষু জৈগীষব্যের শক্তি পরীক্ষার জন্য আকাশে উঠলেন এবং দেখলেন, অন্তরীক্ষচারী সিদ্ধগণ জৈগীষব্যের পূজা করছেন। তার পর তিনি দেখলেন, জৈগীষব্য স্বর্গলোক পিতৃলোক যমলোক চন্দ্রলোক প্রভৃতি স্থানে এবং বহুবিধ যজ্ঞকারীদের লোকে গেলেন এবং অবশেষে অন্তর্হিত হলেন। দেবল জিজ্ঞাসা করলে সিদ্ধ যাজ্ঞিকগণ বললেন, জৈগীষব্য শাশ্বত ব্রহ্মলোকে গেছেন, সেখানে তোমার যাবার শক্তি নেই। দেবল তাঁর আশ্রমে ফিরে এলেন এবং সেখানে জৈগীষব্যকে দেখলেন। দেবল বিনয়ে অবনত হয়ে সেই মহামুনিকে বললেন, ভগবান, আমি মোক্ষধর্ম শিখতে ইচ্ছা করি। জৈগীষব্য যোগের বিধি এবং শাস্ত্রানুযায়ী কার্যাকার্য সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন। দেবল সন্ন্যাসগ্রহণের সংকল্প করলেন, তখন আশ্রমের সমস্ত প্রাণী, পিতৃগণ, এবং ফলমূল লতা প্রভৃতি সরোদনে বলতে লাগল, ক্ষুদ্র দুর্মতি দেবল সর্বভূতকে অভয় দিয়েছিল তা ভুলে গেছে, সে নিশ্চয় আমাদের ছেদন করবে। মুনিসত্তম দেবল ভাবতে লাগলেন, মোক্ষধর্ম আর গার্হস্থ্যধর্মের মধ্যে কোনটি শ্রেয়স্কর; অবশেষে তিনি মোক্ষধর্মই গ্রহণ ক’রে সিদ্ধিলাভ করলেন।

 বৃহস্পতিকে পুরোবর্তী ক’রে দেবগণ ও তপস্বিগণ উপস্থিত হলেন এবং জৈগীষব্য ও দেবলের তপস্যার প্রশংসা করলেন। কিন্তু নারদ বললেন, জৈগীষব্যের তপস্যা বৃথা, কারণ তিনি তাঁর শক্তি দেখিয়ে দেবলকে বিস্মিত করেছেন। দেবতারা বললেন, দেবর্ষি, এমন কথা বলবেন না, মহাত্মা জৈগীষব্যের তুল্য প্রভাব তপস্যা ও যোগসিদ্ধি আর কারও নেই।


 তার পর বলরাম সোমতীর্থ দেখে সারস্বত মুনির তীর্থে গেলেন। পুরাকালে সরস্বতীতীরে তপস্যারত দধীচি মুনি অলম্বুষা অপ্সরাকে দেখে বিচলিত হন, তার ফলে সরস্বতী নদীর গর্ভে তাঁর একটি পুত্র উৎপন্ন হয়। প্রসবের পর সরস্বতী দধীচিকে সেই পুত্র দান করলেন। দধীচি তুষ্ট হয়ে সরস্বতীকে বর দিলেন, তোমার জলে তর্পণ করলে দেবগণ পিতৃগণ গন্ধর্বগণ ও অপ্সরোগণ তৃপ্ত হবেন এবং সমস্ত পুণ্যনদীর মধ্যে তুমি পুণ্যতমা হবে। দধীচি তাঁর পুত্রের নাম রাখলেন সারস্বত। এই সময়ে দেবদানবের বিরোধ চলছিল। দধীচি দেবগণের হিতার্থে প্রাণত্যাগ ক’রে তাঁর অস্থি দান করলেন, তাতে বজ্র চক্র গদা প্রভৃতি দিব্যাস্থ নির্মিত হ’ল এবং ইন্দ্র বজ্রাঘাতে দানবগণকে জয় করলেন।

 কিছুকাল পরে স্বাদশবর্ষব্যাপী ভয়ংকর অনাবৃষ্টি হ’ল, মহর্ষিগণ ক্ষুধার্ত হয়ে প্রাণরক্ষার জন্য নানাদিকে ধাবিত হলেন। সারস্বত মুনিও যাবার ইচ্ছা করলেন, কিন্তু সরস্বতী তাঁকে বললেন, পুত্র, যেয়ো না, তোমার আহারের জন্য আমি উত্তম মৎস্য দেব। সারস্বত তাঁর আশ্রমেই রইলেন এবং মৎস্যভোজনে প্রাণধারণ ক’রে দেবতা ও পিতৃগণের তর্পণ এবং বেদচর্চা করতে লাগলেন। অনাবৃষ্টি অতীত হ’লে মহর্ষিগণ দেখলেন তাঁরা বেদবিদ্যা ভুলে গেছেন। তাঁরা সারস্বত মুনির কাছে গিয়ে বললেন, আমাদের বেদ পড়াও। সারস্বত বললেন, আপনারা যথাবিধি আমার শিষ্য হ’ন। মহর্ষিরা বললেন, পুত্র, তুমি তো বালক। সারস্বত বললেন, যাঁরা অবিধিপূর্বক অধ্যয়ন ও অধ্যাপন করেন তাঁরা উভয়েই পতিত এবং পরস্পরের শত্রু হন। বয়স পক্ককেশ বিত্ত বা বন্ধুবাহুল্য থাকলেই লোকে বড় হয় না, যিনি বেদজ্ঞ তিনিই গুরু হবার যোগ্য। তখন ষাট হাজার মুনি সারস্বতের শিষ্যত্ব স্বীকার করলেন।

১১। বৃদ্ধকন্যা সুভ্রূ—কুরুক্ষেত্র ও সমন্তপঞ্চক

 তার পর বলরাম বৃদ্ধকন্যাশ্রম তীর্থে এলেন। কুণিগর্গ নামে এক মহাতপা ঋষি ছিলেন, তিনি সুভ্রূ নামে এক মানসী কন্যা উৎপন্ন করেছিলেন। কুণিগর্গ দেহত্যাগ করলে অনিন্দিতা সন্দরী সুভ্রূ আশ্রম নির্মাণ ক’রে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। বহুকাল পরে তিনি নিজেকে কৃতার্থ মনে করলেন, কিন্তু বার্ধক্য ও তপস্যার জন্য তিনি এমন কৃশ হয়ে গিয়েছিলেন যে এক পাও চলতে পারতেন না। তখন তিনি পরলোকগমনের ইচ্ছা করলেন। নারদ তাঁর কাছে এসে বললেন, অবিবাহিতা কন্যার স্বর্গলাভ কি ক’রে হবে? তুমি কঠোর তপস্যা করেছ কিন্তু স্বর্গলোকের অধিকার পাও নি। সুভ্রূ ঋষিগণের কাছে গিয়ে বললেন, যিনি আমার পাণিগ্রহণ করবেন তাঁকে আমার তপস্যার অর্ধভাগ দান করব। গালবের পুত্র প্রাক্‌শৃঙ্গবান বললেন, সুন্দরী, তুমি যদি আমার সঙ্গে এক রাত্রি বাস কর তবে তোমার পাণিগ্রহণ করব। সুভ্রূ সম্মত হ’লে গালবপুত্র যথাবিধি হোম ক’রে তাঁকে বিবাহ করলেন। সুভ্রূ দিব্যাভরণভূষিতা দিব্যমাল্যধারিণী বরবর্ণিনী তরুণী হয়ে পতির সহিত রাত্রিবাস করলেন। প্রভাতকালে তিনি বললেন, ব্রাহ্মণ, তুমি যে নিয়ম (শর্ত) করেছিলে তা আামি পালন করেছি; তোমার মঙ্গল হ’ক, এখন আমি যাব। গালবপুত্র সম্মতি দিলে সুভ্রূ আবার বললেন, এই তীর্থে যে দেবগণের তর্পণ ক’রে একরাত্রি বাস করবে সে আটান্ন বৎসর ব্রহ্মচর্য পালনের ফল লাভ করবে। এই বলে সাধ্বী সুভ্রূ দেহত্যাগ ক’রে স্বর্গে চলে গেলেন। গালবপুত্র তাঁর ভার্যার তপস্যার অর্ধভাগ পেয়েছিলেন; শোকে কাতর হয়ে তিনিও রূপবতী সুভ্রূর অনুসরণ করলেন।

 তার পর বলরাম সমন্তপঞ্চকে এলেন। ঋষিরা তাঁকে কুরুক্ষেত্রের এই ইতিহাস বললেন।—পুরাকালে রাজর্ষি কুরু সেই স্থান সর্বদা কর্ষণ করেন দেখে ইন্দ্র তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, রাজা, একি করছ? কুরু বললেন, এই ক্ষেত্রে যে মরবে সে পাপশূন্য পুণ্যময় লোকে যাবে। ইন্দ্র উপহাস ক’রে চ’লে গেলেন এবং তার পর বহুবার এসে পূর্বের ন্যায় প্রশ্ন ও উপহাস করতে লাগলেন। দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন, রাজর্ষি কুরুকে বর দিয়ে নিবৃত্ত করুন; মানুষ যদি কুরুক্ষেত্রে মরলেই স্বর্গে যেতে পারে তবে আমরা আর যজ্ঞভাগ পাব না। ইন্দ্র কুরুর কাছে এসে বললেন, রাজা, আর পরিশ্রম ক’রো না, আমার কথা শোন। যে লোক এখানে উপবাস ক’রে প্রাণত্যাগ করবে অথবা যুদ্ধে নিহত হবে সে স্বর্গে যাবে। কুরু বললেন, তাই হ’ক।

 ঋষিরা বলরামকে আরও বললেন, ব্রহ্মাদি সুরশ্রেষ্ঠগণ এবং পুণ্যবান রাজর্ষিগণের মতে কুরুক্ষেত্র অপেক্ষা পুণ্যস্থান পৃথিবীতে নেই। দেবরাজ ইন্দ্র এই গাথা গান করেছিলেন — কুরুক্ষেত্রে যে ধূলি ওড়ে তার স্পর্শেও পাপীরা পরমগতি পায়। তারন্তুক অরন্তুক রামহ্রদ ও মচক্রকের মধ্যস্থানকেই কুরুক্ষেত্রের সমন্তপঞ্চক ও প্রজাপতির উত্তরবেদী বলা হয়।


 তার পর বলরাম হিমালয়ের নিকটস্থ তীর্থসকল দেখে মিত্রাবরুণের পুণ্য আশ্রমে এলেন এবং সেখানে ঋষি ও সিদ্ধগণের নিকট বিবিধ পবিত্র উপাখ্যান শুনলেন। সেই সময়ে জটামণ্ডলে আবৃত স্বর্ণকৌপীনধারী নৃত্যগীতকুশল কলহপ্রিয় দেবর্ষি নারদ কচ্ছপী বীণা নিয়ে উপস্থিত হলেন। বলরাম নারদের মুখে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের বৃত্তান্ত এবং দুর্যোধন ও ভীমের আসন্ন যুদ্ধের সংবাদ শুনলেন। তখন তিনি তাঁর অনুচরবর্গকে বিদায় দিয়ে বার বার পবিত্র সরস্বতী নদীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন এবং দুই শিষ্যের যুদ্ধ দেখবার জন্য সত্বর রথারোহণে দ্বৈপায়ন হ্রদের নিকট উপস্থিত হলেন।

১২। দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ

(অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধান্ত)

 বলরাম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, নৃপশ্রেষ্ঠ, আমি ঋষিদের কাছে শুনেছি যে কুরুক্ষেত্র অতি পুণ্যময় স্বর্গপ্রদ স্থান, সেখানে যাঁরা যুদ্ধে নিহত হন তাঁরা ইন্দ্রের সহিত স্বর্গে বাস করেন। অতএব এখান থেকে সমন্তপঞ্চকে[১] চলুন, সেই স্থান প্রজাপতির উত্তরবেদী ব’লে প্রসিদ্ধ। তখন যুধিষ্ঠিরাদি ও দুর্যোধন পদব্রজে গিয়ে সরস্বতীর দক্ষিণ তীরে একটি পবিত্র উন্মুক্ত স্থানে উপস্থিত হলেন।

 অনন্তর দুর্যোধন ও ভীম পরস্পরকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন এবং দুই বৃষের ন্যায় গর্জন ক’রে উন্মত্তবৎ আস্ফালন করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ বাগ্‌যুদ্ধের পর তুমুল গদাযুদ্ধ আরম্ভ হ’ল। দুই বীর পরস্পরের ছিদ্রানুসন্ধান ক’রে প্রহার করতে লাগলেন। বিচিত্র গতিতে মণ্ডলাকারে ভ্রমণ করে, এগিয়ে গিযে, পিছনে হ’টে, একবার নীচু হয়ে, একবার লাফিয়ে উঠে তাঁরা নানাপ্রকার যুদ্ধকৌশল দেখালেন। দুর্যোধন তাঁর গদা ঘরিয়ে ভীমের মাথায় আঘাত করলেন; ভীম অবিচলিত থেকে প্রত্যাঘাত করলেন, কিন্তু দুর্যোধন ক্ষিপ্রগতিতে স’রে গিয়ে ভীমের প্রহার ব্যর্থ ক’রে দিলেন। তার পর ভীম বক্ষে আহত হ’য়ে মূর্ছিতপ্রায় হলেন এবং কিছুক্ষণ পরে প্রকৃতিস্থ হ’য়ে দুর্যোধনের পার্শ্বে প্রহার করলেন। দুর্যোধন বিহ্বল হ’য়ে হাঁটু গেড়ে ব’সে পড়লেন এবং আবার উঠে গদাঘাতে ভীমকে ভূপাতিত করলেন। ভীমের বর্ম বিদীর্ণ হ’ল; মুহূর্তকাল পরে তিনি দাঁড়িয়ে উঠে তাঁর রক্তাক্ত মুখ মুছলেন। তখন নকুল সহদেব ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকি দুর্যোধনের দিকে ধাবিত হলেন। ভীম তাঁদের নিবৃত্ত ক’রে পুনর্বার দুর্যোধনকে আক্রমণ করলেন।

 যুদ্ধ ক্রমশ দারুণ হচ্ছে দেখে অর্জুন বললেন, জনার্দন, এই দুই বীরের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? কৃষ্ণ বললেন, এঁরা দুজনেই সমান শিক্ষা পেয়েছেন, কিন্তু ভীমসেন অধিক বলশালী এবং দুর্যোধন দক্ষতায় ও যত্নে শ্রেষ্ঠ। ভীম ন্যায়যুদ্ধে জয়লাভ করবেন না, অন্যায়যুদ্ধেই দুর্যোধনকে বধ করতে পারবেন। দ্যূতসভায় ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে যুদ্ধে গদাঘাতে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করবেন; এখন সেই প্রতিজ্ঞা পালন করুন, মায়াবী দুর্যোধনকে মায়া (কপটতা) দ্বারাই বিনষ্ট করুন। ভীম যদি কেবল নিজের বলের উপর নির্ভর ক’রে ন্যায়যুদ্ধ করেন তবে যুধিষ্ঠির বিপদে পড়বেন। ধর্মরাজের দোষে আবার আমরা সংকটে পড়েছি, বিজয়লাভ আসন্ন হয়েও সংশয়ের বিষয় হয়েছে। যুধিষ্ঠির নির্বোধের ন্যায় এই পণ করেছেন যে দুর্যোধন একজনকে বধ করতে পারলেই জয়ী হবেন। শুত্রুাচার্যের রচিত একটি পুরাতন শ্লোক আছে — পরাজিত হতাবশিষ্ট যোদ্ধা যদি ফিরে আসে তবে তাকে ভয় করতে হবে, কারণ সে মরণ পণ ক’রে যুদ্ধ করবে।

 অর্জুন তখন ভীমকে দেখিয়ে নিজের বাম ঊরুতে চপেটাঘাত করলেন। এই সময়ে ভীম ও দুর্যোধন দুজনেই পরিশ্রান্ত হয়েছিলেন। সহসা দুর্যোধনকে নিকটে পেয়ে ভীম মহাবেগে তাঁর গদা নিক্ষেপ করলেন, দুর্যোধন সত্বর সরে গিয়ে ভীমকে প্রহার করলেন। ভীম রুধিরাক্তদেহে কিছুক্ষণ মূর্ছিতের ন্যায় রইলেন, তার পর আবার দুর্যোধনের প্রতি ধাবিত হলেন। ভীমের প্রহার ব্যর্থ করবার ইচ্ছায় দুর্যোধন লাফিয়ে উঠলেন, সেই অবসরে ভীম সিংহের ন্যায় গর্জন ক’রে গদাঘাতে দুর্যোধনের দুই ঊরু ভগ্ন করলেন।

 দুর্যোধন সশব্দে ভূতলে নিপতিত হলেন। তখন ধূলিবৃষ্টি রক্তবৃষ্টি ও উল্কাপাত হ’ল, যক্ষ রাক্ষস ও পিশাচগণ অন্তরীক্ষে কোলাহল ক’রে উঠল, ঘোরদর্শন কবন্ধসকল নৃত্য করতে লাগল। ভূপতিত শত্রুকে ভর্ৎসনা করে ভীম বললেন, আমাদের শঠতা দ্যূতক্রীড়া বা বঞ্চনা নেই, আমরা আগুন লাগাই না, নিজের বাহুবলেই শত্রুবধ করি। তার পর ভীম তাঁর বাঁ পা দিয়ে দুর্যোধনের মাথা মাড়িয়ে তাঁকে শঠ ব’লে তিরস্কার করলেন।

 ক্ষুদ্রচেতা ভীমের আচরণে সোমকবীরগণ অসন্তুষ্ট হলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম, তুমি সৎ বা অসৎ উপায়ে শত্রুতার প্রতিশোধ নিয়েছ, প্রতিজ্ঞাও পূর্ণ করেছ, এখন ক্ষান্ত হও। রাজ। দুর্যোধন এখন হতপ্রায়, ইনি একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা ও কৌরবগণের অধিপতি, তোমার জ্ঞাতি, তুমি চরণ দিয়ে এঁকে স্পর্শ ক’রো না। এঁর জন্য শোক করাই উচিত, উপহাস উচিত নয়। এঁর অমাত্য ভ্রাতা ও পুত্রগণ নিহত হয়েছেন, পিণ্ডলোপ হয়েছে; ইনি তোমার ভ্রাতা, এঁকে পদাঘাত ক’রে তুমি অন্যায় করেছ। তার পর যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের কাছে গিয়ে সাশ্রুকণ্ঠে বললেন, বৎস, দুঃখ ক’রো না, তুমি পূর্বকৃত কর্মের এই নিদারূণ ফল ভোগ করছ। তোমারই অপরাধে আমরা তোমার ভ্রাতা ও জ্ঞাতিদের বধ করেছি। তুমি নিজের জন্য শোক ক’রো না, তুমি শ্লাঘ্য মৃত্যু লাভ করেছ; আমাদের অবস্থাই এখন শোচনীয় হয়েছে, কারণ প্রিয় বন্ধুদের হারিয়ে দীনভাবে জীবনযাপন করতে হবে। শোকাকুলা বিধবা বধূদের আমি কি ক’রে দেখব? রাজা, তুমি নিশ্চয় স্বর্গে বাস করবে, কিন্তু আমরা নারকী আখ্যা পেয়ে দারুণ দুঃখ ভোগ করব।

১৩। বলরামের ক্রোধ — যুধিষ্ঠিরাদির ক্ষোভ

 বলরাম ক্রোধে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে আর্তর্কণ্ঠে বললেন, ধিক ধিক ভীম! ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ে বৃকোদর নাভির নিম্নে গদাপ্রহার করেছে! এমন যুদ্ধ আমি দেখি নি, মূঢ় ভীম নিজের ইচ্ছাতেই এই শাস্ত্রবিরুদ্ধ যুদ্ধ করেছে। এই ব’লে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বলরাম তাঁর লাঙ্গল উদ্যত ক’রে ভীমের প্রতি ধাবিত হলেন। তখন কৃষ্ণ বিনয়ে অবনত হয়ে তাঁর স্থূল সগোল বাহু দিয়ে বলরামকে জড়িয়ে ধরলেন। দিবাবসানে চন্দ্র ও সূর্য যেমন আকাশে শোভা পান, কৃষ্ণ ও শুভ্র দুই যাদবশ্রেষ্ঠ সেইরূপ শোভা পেলেন। কৃষ্ণ বললেন, নিজের উন্নতি, মিত্রের উন্নতি, মিত্রের মিত্রের উন্নতি; এবং শত্রুর অবনতি, তার মিত্রের অবনতি, তার মিত্রের মিত্রের অবনতি — এই ছয় প্রকারই নিজের উন্নতি। পাণ্ডবরা আমাদের স্বাভাবিক মিত্র, আমাদের পিতৃষ্বসার পুত্র, শত্রুরা এদের উপর অত্যন্ত পীড়ন করেছে। আপনি জানেন, প্রতিজ্ঞারক্ষাই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। ভীম দ্যূতসভায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে যুদ্ধে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করবেন, মহর্ষি মৈত্রেয় ও দুর্যোধনকে এইরূপ অভিশাপ দিয়েছিলেন, কলিযুগও আরম্ভ হয়েছে। অতএব আমি ভীমসেনের দোষ দেখি না। পুরুষশ্রেষ্ঠ, পাণ্ডবদের বৃদ্ধিতেই আমাদের বৃদ্ধি, অতএব আপনি ক্রুদ্ধ হবেন না।

 কৃষ্ণের মুখে ধর্মের ছলনা শুনে বলরাম অপ্রসন্নমনে বললেন, গোবিন্দ, ভীম ধর্মের পীড়ন ক’রে সকলকেই ব্যাকুল করেছে। ন্যায়যোদ্ধা রাজা দুর্যোধনকে অন্যায়ভাবে বধ ক’রে ভীম কূটযোদ্ধা ব’লে খ্যাত হবে। সরলভাবে যুদ্ধ করার জন্য দুর্যোধন শাশ্বত স্বর্গ লাভ করবেন। ইনি রণযজ্ঞে নিজেকে আহতি দিয়ে যজ্ঞান্তস্নানের যশ লাভ করেছেন। এই কথা ব’লে বলরাম তাঁর রথে উঠে দ্বারকার অভিমুখে যাত্রা করলেন।

 বলরাম চ’লে গেলে পাণ্ডব পাঞ্চাল ও যাদবগণ নিরানন্দ হয়ে রইলেন। যুধিষ্ঠির বিষণ্ণ হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, বৃকোদর দুর্যোধনের মাথায় পা দিয়েছেন তাতে আমি প্রীত হই নি, কুলক্ষয়েও আমি হৃষ্ট হই নি। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আমাদের উপর বহু অত্যাচার করেছে, সেই দারুণ দুঃখ ভীমের হৃদয়ে রয়েছে, এই চিন্তা ক’রে আমি ভীমের আচরণ উপেক্ষা করলাম। ভীমের কার্য ধর্ম সংগত বা ধর্মবিরুদ্ধ যাই হ’ক, তিনি অমার্জিতবুদ্ধি লোভী কামনার দাস দুর্যোধনকে বধ করে অভীষ্টলাভ করুন।

 ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে বাসদেব সদুঃখে বললেন, তাই হ’ক। তিনি ভীমকে প্রীত করবার ইচ্ছায় তাঁর সকল কার্যের অনুমোদন করলেন। অসন্তুষ্ট অর্জুন ভীমকে ভাল মন্দ কিছুই বললেন না। ভীম হৃষ্টচিত্তে উৎফুল্লনেত্রে কৃতাঞ্জলি হয়ে যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন ক’রে বললেন, মহারাজ, আজ পৃথিবী মঙ্গলময় ও নিষ্কণ্টক হ’ল, আপনি রাজ্যশাসন ও স্বধর্ম পালন করুন। যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা কৃষ্ণের মতে চ’লেই পৃথিবী জয় করেছি। দুর্ধর্য ভীম, ভাগ্যক্রমে তুমি মাতার নিকট এবং নিজের ক্রোধের নিকট ঋণমুক্ত হয়েছ, শত্রুনিপাত ক’রে জয়ী হয়েছ।

১৪। দুর্যোধনের ভর্ৎসনা

 দুর্যোধনের পতনে পাণ্ডব পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয় যোদ্ধারা হৃষ্ট হয়ে সিংহনাদ ক’রে উত্তরীয় নাড়তে লাগলেন। তাঁদের অনেকে ভীমকে বললেন, বীর, ভাগ্যবশে আপনি মত্ত হস্তীর ন্যায় পদ দ্বারা দুর্যোধনের মস্তক মর্দন করেছেন, সিংহ যেমন মহিষের রক্ত পান করে সেইরূপ আপনি দুঃশাসনের রক্ত পান করেছেন। এই দেখুন, দুর্যোধন পতিত হ’লে আমাদের যে রোমহর্ষ হয়েছিল তা এখনও যায় নি।

 এইপ্রকার অশোভন উক্তি শুনে কৃষ্ণ বললেন, বিনষ্ট শত্রুকে উগ্রবাক্যে আঘাত করা উচিত নয়। এই নির্লজ্জ লোভী পাপী দুর্যোধন যখন সুহৃদ্‌গণের উপদেশ লঙ্ঘন করেছিল তখনই এর মৃত্যু হয়েছে। এই নরাধম এখন অক্ষম হয়ে কাষ্ঠের ন্যায় প’ড়ে আছে, একে বাক্য দ্বারা পীড়িত ক’রে কি হবে?

 দুর্যোধন দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলেন এবং প্রাণান্তকর যন্ত্রণা অগ্রাহ্য ক’রে ভ্রুকুটি ক’রে কৃষ্ণকে বললেন, কংসদাসের পুত্র, অন্যায় যুদ্ধে আমাকে নিপাতিত ক’রে তোমার লজ্জা হচ্ছে না? তুমিই ভীমকে ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা মনে করিয়ে দিয়েছিলে, তুমি অর্জুনকে যা বলেছিলে তা কি আমি জানি না? তোমারই কূটনীতিতে আমাদের বহু সহস্র যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। তুমিই শিখণ্ডীকে সম্মুখে রাখিয়ে অর্জুনের বাণে ভীষ্মকে নিপাতিত করেছ, অশ্বত্থামার মরণের মিথ্যা সংবাদ দিয়ে দ্রোণাচার্যকে বধ করিয়েছ, কর্ণ যখন ভূমি থেকে রথচক্র তুলছিলেন তখন তুমিই অর্জুনকে দিয়ে তাঁকে হত্যা করেছ। আমাদের সঙ্গে ন্যায়যুদ্ধ করলে তোমরা কখনও জয়ী হ’তে না।

 কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, গান্ধারীর পুত্র, তুমি পাপের পথে গিয়েই আত্মীয়বান্ধব সহ হত হয়েছ। ভীষ্ম পাণ্ডবদের অনিষ্টকামনায় যুদ্ধ করছিলেন সেজন্যই শিখণ্ডী কর্তৃক নিহত হয়েছেন। দ্রোণ স্বধর্ম ত্যাগ ক’রে তোমার প্রীতির জন্য যুদ্ধ করছিলেন, তাই ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে বধ করেছেন। বহু ছিদ্র পেয়েও অর্জুন কর্ণকে মারেন নি, বীরোচিত উপায়েই তাঁকে মেরেছেন। অর্জুন নিন্দিত কার্য করেন না, তাঁর দয়াতেই তুমি এবং ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ অশ্বত্থামা প্রভৃতি বিরাটনগরে নিহত হও নি। তুমি আমাদের যেসব অকার্যের কথা বলেছ তা তোমার অপরাধের জন্যই আমরা করেছি। লোভের বশে এবং অতিরিক্ত শক্তিলাভের বাসনায় তুমি যেসব দুষ্কর্ম করেছ এখন তারই ফল ভোগ কর।

 দুর্যোধন বললেন, আমি যথাবিধি অধ্যয়ন দান ও সসাগরা পৃথিবী শাসন করেছি, শত্রুদের মস্তকে অধিষ্ঠান করেছি, ক্ষত্রিয়ের অভীষ্ট মরণ লাভ করেছি, দেবগণের যোগ্য এবং নপগণের দুর্লভ রাজ্য ভোগ করেছি, শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্য লাভ করেছি; আমার তুল্য আর কে আছে? কৃষ্ণ, সুহৃৎ ও ভ্রাতাদের সঙ্গে আমি স্বর্গে যাব। তোমাদের সংকল্প পূর্ণ হ’ল না, তোমরা শোকসন্তপ্ত হয়ে জীবনধারণ কর।

 দুর্যোধনের উপর আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হ’ল, অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ গীতবাদ্য করতে লাগল, সিদ্ধগণ সাধু সাধু বললেন। দুর্যোধনের এইপ্রকার সম্মান দেখে কৃষ্ণ ও পাণ্ডব প্রভৃতি লজ্জিত হলেন। বিষণ্ণ পাণ্ডবগণকে কৃষ্ণ বললেন, দুর্যোধন ও ভীষ্মাদি বীরগণকে আপনারা ন্যায়যুদ্ধে বধ করতে পারতেন না। আপনাদের হিতসাধনের জন্যই আমি কূট উপায়ে এঁদের নিধন ঘটিয়েছি। শত্রু বহু বা প্রবল হ’লে বিবিধ কূট উপায়ে তাদের বধ করতে হয়, দেবতারা এবং অনেক সৎপুরুষ এইরূপ করেছেন। আমরা কৃতকার্য হয়েছি, এখন সায়াহ্ণকালে বিশ্রাম করতে ইচ্ছা করি, আপনারাও সকলে বিশ্রাম করুন। তখন পাঞ্চালগণ হৃষ্ট হয়ে শঙ্খধ্বনি করলেন, কৃষ্ণও পাঞ্চজন্য বাজালেন।

১৫। ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-সকাশে কৃষ্ণ

 সকলে নিজ নিজ আবাসে প্রস্থান করলে পাণ্ডবগণ দুর্যোধনের শিবিরে গেলেন। স্ত্রীলোক, নপুংসক ও বৃদ্ধ অমাত্যগণ সেখানে ছিলেন। দুর্যোধনের পরিচরগণ কৃতাঞ্জলি হয়ে তাঁদের সম্মুখে এল। পাণ্ডবগণ রথ থেকে নামলে কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন তাঁর গাণ্ডীব ও দুই অক্ষয় তূণ নামিয়ে নিলেন, তার পর কৃষ্ণ নামলেন। তখনই রথের ধ্বজাস্থিত দিব্যবানর অন্তর্হিত হ’ল, রথ ও অস্ত্রসকলও ভস্ম হয়ে গেল। বিস্মিত অর্জুনকে কৃষ্ণ বললেন, বহুবিধ অস্ত্রের প্রভাবে তোমার রথে পূর্বেই অগ্নিসংযোগ হয়েছিল, আমি উপরে থাকায় এত কাল দগ্ধ হয় নি। এখন তুমি কৃতকার্য হয়েছ, আমি নেমেছি, সেজন্য রথ ভস্ম হয়ে গেল।

 পাণ্ডবপক্ষের যোদ্ধারা দুর্যোধনের শিবিরে অসংখ্য ধনরত্ন ও দাসদাসী পেয়ে কোলাহল করতে লাগলেন। কৃষ্ণের উপদেশে পঞ্চপাণ্ডব ও সাত্যকি শিবিরের বহির্দেশে নদীতীরে রাত্রিযাপনের আয়োজন করলেন। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, জনার্দন, ধৃতরাষ্ট্রমহিষী তপস্বিনী গান্ধারী পুত্রপৌত্রগণের নিধন শুনে নিশ্চয় আমাদের ভস্মসাৎ করবেন। তোমার অনুগ্রহেই আমাদের রাজ্য নিষ্কণ্টক হয়েছে, তুমি আমাদের জন্য বার বার অস্ত্রাঘাত ও কঠোর বাকাযন্ত্রণা সয়েছ, এখন পত্রশোকার্তা গান্ধারীর ক্রোধ শান্ত ক’রে আমাদের রক্ষা কর।

 দারুকের রথে চ’ড়ে কৃষ্ণ তখনই হস্তিনাপুরে গেলেন। সেখানে ব্যাসদেবকে দেখে তাঁর চরণবন্দনা ক’রে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে অভিবাদন করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের হাত ধ’রে কৃষ্ণ সরোদনে বললেন, মহারাজ, কুলক্ষয় ও যুদ্ধ নিবারণের জন্য পাণ্ডবরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কৃতকার্য হন নি। তাঁরা বহু কষ্ট ভোগ করেছেন। যুদ্ধের পূর্বে আমি আপনার কাছে এসে পাণ্ডবদের জন্য পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলাম, কিন্তু লোভের বশে তাতেও আপনি সম্মত হন নি। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ বিদুর প্রভৃতি সন্ধির জন্য বার বার আপনাকে অনুরোধ করেছিলেন, তাতেও ফল হয় নি। আপনি পাণ্ডবদের দোষী মনে করবেন না, এই কুলক্ষয় আপনার দোষেই ঘটেছে। এখন আপনার কুলরক্ষা পিণ্ডদান এবং পুত্রের করণীয় যা কিছু আছে তার ভার পাণ্ডবদের উপরেই পড়েছে। অতএব আপনি এবং গান্ধারী ক্রোধ ও শোক ত্যাগ ক’রে তাঁদের প্রতিপালন করুন। আপনার প্রতি যুধিষ্ঠিরের যে প্রীতি ও ভক্তি আছে তা আপনি জানেন। এখন তিনি শোকানলে দিবারাত্র দগ্ধ হচ্ছেন। আপনি পুত্রশোকে কাতর হয়ে আছেন সেজন্য তিনি লজ্জায় আপনার কাছে আসতে পারছেন না।

 তার পর বাসুদেব গান্ধারীকে বললেন, সুবলনন্দিনী, আপনার তুল্য নারী পৃথিবীতে দেখা যায় না। দুই পক্ষের হিতের জন্য আপনি যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা আপনার পুত্রেরা পালন করেন নি। আপনি দুর্যোধনকে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, মূঢ়, যেখানে ধর্ম সেখানেই জয়। কল্যাণী, আপনার সেই বাক্য এখন সকল হয়েছে, অতএব শোক করবেন না, পাণ্ডবদের বিনাশকামনাও করবেন না। আপনি তপস্যার প্রভাবে ক্রোধদীপ্ত নয়ন দ্বারা চরাচর সহ সমস্ত পৃথিবী দগ্ধ করতে পারেন।

 গান্ধারী বললেন, কেশব, তুমি যা বললে তা সত্য। দুঃখে আমার মন অস্থির হয়েছিল, তোমার কথায় শান্ত হ’ল। এখন তুমি আর পাণ্ডবরাই এই পুত্রহীন বৃদ্ধ অন্ধ রাজার অবলম্বন। এই ব’লে গান্ধারী বস্ত্রে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে সান্ত্বনা দিতে দিতে কৃষ্ণের জ্ঞান হ’ল যে অশ্বত্থামা এক দুষ্ট সংকল্প করেছেন। তিনি তখনই গাত্রোত্থান করলেন এবং ব্যাসদেবকে প্রণাম ক’রে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, আর শোক করবেন না। আমার এখন স্মরণ হ’ল যে অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের বিনাশের সংকল্প করেছেন, সেকারণে আমি এখন যাচ্ছি। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী বললেন, কৃষ্ণ, তুমি শীঘ্র গিয়ে পাণ্ডবদের রক্ষার ব্যবস্থা কর; আবার যেন তোমার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়।

১৬। অশ্বত্থামার অভিষেক

 কৃপাচার্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা দূতমুখে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের সংবাদ শুনে রথে চ’ড়ে সত্বর তাঁর কাছে এলেন। অশ্বত্থামা শোকার্ত হয়ে বললেন, হা মহারাজ, সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়ে এই নির্জন বনে একাকী প’ড়ে আছ কেন? দুর্যোধন সাশ্রুনয়নে বললেন, বীরগণ, কালধর্মে সমস্তই বিনষ্ট হয়। আমি কখনও যুদ্ধে বিমুখ হই নি, পাপী পাণ্ডবগণ কপট উপায়ে আমাকে নিপাতিত করেছে। ভাগ্যক্রমে আপনারা তিন জন জীবিত আছেন, আপনারা আমার জন্য দুঃখ করবেন না। যদি বেদবাক্য সত্য হয় তবে আমি নিশ্চয় স্বর্গলোকে যাব। আপনারা জয়লাভের জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন, কিন্তু দৈবকে অতিক্রম করা অসাধ্য।

 অশ্বত্থামা বললেন, মহারাজ, পাণ্ডবরা নিষ্ঠুর উপায়ে আমার পিতাকে বধ করেছে, কিন্তু তাঁর জন্য আমার তত শোক হয় নি যত তোমার জন্য হচ্ছে। আমি শপথ করছি, কৃষ্ণের সমক্ষেই আজ সমস্ত পাঞ্চালদের যমালয়ে পাঠাব, তুমি আমাকে অনুমতি দাও।

 দুর্যোধন প্রীত হয়ে কৃপকে বললেন, আচার্য, শীঘ্র জলপূর্ণ কলস আনুন। কৃপাচার্য কলস আনলে দুর্যোধন বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, দ্রোণপুত্রকে সেনাপতির পদে অভিষিক্ত করুন। অভিষেক সম্পন্ন হ’লে অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে আলিঙ্গন করলেন এবং সিংহনাদে সবদিক ধ্বনিত ক’রে কৃপ ও কৃতবর্মার সঙ্গে প্রস্থান করলেন। দুর্যোধন রক্তাক্তদেহে সেখানে শুয়ে সেই ঘোর রজনী যাপন করতে লাগলেন।[২]

  1. দ্বৈপায়ন হ্রদ কুরুক্ষেত্রের অন্তর্গত নয়; সমন্তপঞ্চক কুরুক্ষেত্রেরই অংশ।
  2. দুর্যোধনকে রক্ষার ব্যবস্থা কেউ করলেন না।