মহাভারত (রাজশেখর বসু)/শল্যপর্ব/হ্রদপ্রবেশপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥ হ্রদপ্রবেশপর্বাধ্যায়॥

৬। দুর্যোধনের হ্রদপ্রবেশ

 হতাবশিষ্ট কৌরবসৈন্য দুর্যোধনের বাক্যে উৎসাহিত হয়ে পুনর্বার যুদ্ধে রত হ’ল, কিন্তু পাণ্ডবসৈন্যের আক্রমণে তারা একবারে নিঃশেষ হয়ে গেল। দুর্যোধনের একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা ধ্বংস হ’ল। পাণ্ডবসেনার দু হাজার রথ, সাত শ হস্তী, পাঁচ হাজার অশ্ব ও দশ হাজার পদাতি অবশিষ্ট রইল। দুর্যোধন যখন দেখলেন যে তাঁর সহায় কেউ নেই তখন তিনি তাঁর নিহত অশ্ব পরিত্যাগ ক’রে, একাকী গদাহস্তে দ্রুতবেগে পূর্বমুখে প্রস্থান করলেন।

 সঞ্জয়কে দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন সহাস্যে সাত্যকিকে বললেন, একে বন্দী ক’রে কি হবে, এর জীবনে কোনও প্রয়োজন নেই। সাত্যকি তখন খরধার খড়্‌গ তুলে সঞ্জয়কে বধ করতে উদ্যত হলেন। সেই সময়ে মহাপ্রাজ্ঞ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস উপস্থিত হয়ে বললেন, সঞ্জয়কে মুক্তি দাও, একে বধ করা কখনও উচিত নয়। সাত্যকি কৃতাঞ্জলি হয়ে ব্যাসদেবের আদেশ মেনে নিয়ে বললেন, সঞ্জয়, যাও, তোমার মঙ্গল হ’ক। বর্মহীন ও নিরস্ত্র সঞ্জয় মুক্তি পেয়ে সায়াহ্ণকালে রুধিরাক্তদেহে হস্তিনাপুরের দিকে প্রস্থান করলেন।

 রণস্থল থেকে এক ক্রোশ দূরে গিয়ে সঞ্জয় দেখলেন, দুর্যোধন ক্ষতবিক্ষতদেহে গদাহস্তে একাকী রয়েছেন। দুজনে অশ্রুপূর্ণনয়নে কাতরভাবে কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলেন, তার পর সঞ্জয় তাঁর বন্ধন ও মুক্তির বিষয় জানালেন। ক্ষণকাল পরে দুর্যোধন প্রকৃতিস্থ হয়ে তাঁর ভ্রাতৃগণ ও সৈন্যদের বিষয় জিজ্ঞাসা করলেন। সঞ্জয় বললেন, আপনার সকল ভ্রাতাই নিহত হয়েছেন, সৈন্যও নষ্ট হয়েছে, কেবল তিন জন রথী (কৃপ, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা) অবশিষ্ট আছেন; প্রস্থানকালে ব্যাসদেব আমাকে এই কথা বলেছেন। দুর্যোধন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সঞ্জয়কে স্পর্শ ক’রে বললেন, এই সংগ্রামে আমার পক্ষে তুমি ভিন্ন দ্বিতীয় কেউ জীবিত নেই, কিন্তু পাণ্ডবরা সহায়সম্পন্নই রয়েছে। সঞ্জয়, তুমি প্রজ্ঞাচক্ষু রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বলবে, আপনার পুত্র দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদে আশ্রয় নিয়েছে। আমার সুহৃৎ ভ্রাতা ও পুত্রেরা গত হয়েছে, রাজ্য পাণ্ডবরা নিয়েছে, এ অবস্থায় কে বেঁচে থাকে? তুমি আরও বলবে, আমি মহাযুদ্ধ থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষতবিক্ষতদেহে এই হ্রদে সুপ্তের ন্যায় নিশ্চেষ্ট হয়ে জীবিত রয়েছি।

 এই কথা ব’লে রাজা দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদের মধ্যে প্রবেশ করলেন এবং মায়া দ্বারা তার জল স্তম্ভিত ক’রে রইলেন। এই সময়ে কৃপাচার্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা রথারোহণে সেখানে উপস্থিত হলেন। সঞ্জয় সকল সংবাদ জানালে অশ্বত্থামা বললেন, হা ধিক, রাজা দুর্যোধন জানেন না যে আমরা জীবিত আছি এবং তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেও সমর্থ আছি। সেই তিন মহারথ বহুক্ষণ বিলাপ করলেন, তার পর পাণ্ডবদের দেখতে পেয়ে বেগে শিবিরে চ’লে গেলেন।


 সূর্যাস্ত হ’লে কৌরবশিবিরের সকলেই দুর্যোধনভ্রাতাদের বিনাশের সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত ভীত হ’ল। দুর্যোধনের অমাত্যগণ এবং বেত্রধারী নারীরক্ষকগণ রাজভার্যাদের নিয়ে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন। শয্যা আস্তরণ প্রভৃতিও পাঠানো হ’ল। অন্যান্য সকলে অশ্বতরীযুক্ত রথে চ’ড়ে নিজ নিজ পত্নী সহ প্রস্থান করলেন। পূর্বে রাজপুরীতে যেসকল নারীকে সূর্যও দেখতে পেতেন না, তাঁদের এখন সকলেই দেখতে লাগল।

 বৈশ্যাগর্ভজাত ধৃতরাষ্ট্রপুত্র যুযুৎসু যিনি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, তিনিও যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে রাজভার্যাদের সঙ্গে প্রস্থান করলেন। হস্তিনাপুরে এসে যুযুৎসু বিদুরকে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। বিদুর বললেন, বৎস, কৌরবকুলের এই ক্ষয়কালে তুমি এখানে এনে উপযুক্ত কার্যই করেছ। হতভাগ্য অন্ধরাজের তুমিই এখন একমাত্র অবলম্বন। আজ বিশ্রাম ক’রে কাল তুমি যধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে যেয়ো।

৭। যুধিষ্ঠিরের তর্জন

 পাণ্ডবগণ অনেক অন্বেষণ ক’রেও দুর্যোধনকে কোথাও দেখতে পেলেন না। তাঁদের বাহনসকল পরিশ্রান্ত হ’লে তাঁরা সৈন্য সহ শিবিরে চ’লে গেলেন। তখন কৃপ অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা ধীরে ধীরে হ্রদের কাছে গিয়ে বললেন, রাজা, ওঠ, আমাদের সহিত মিলিত হয়ে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধ কর। জয়ী হয়ে পৃথিবী ভোগ কর অথবা হত হয়ে স্বর্গলাভ কর। দুর্যোধন বললেন, ভাগ্যক্রমে আপনাদের জীবিত দেখছি। আপনারা পরিশ্রান্ত হয়েছেন, আমিও ক্ষতবিক্ষত হয়েছি; এখন যুদ্ধে করতে ইচ্ছা করি না, বিশ্রাম ক’রে ক্লান্তিহীন হয়ে শত্রুজয় করব। বীরগণ, আপনাদের মহৎ অন্তঃকরণ এবং আমার প্রতি পরম অনুরাগ আশ্চর্য নয়। আজ রাত্রে বিশ্রাম ক’রে কাল আমি নিশ্চয় আপনাদের সহিত মিলিত হয়ে যুদ্ধ করব। অশ্বত্থামা বললেন, রাজা, ওঠ, আমি শপথ করছি আজই সোমক ও পাঞ্চালগণকে বধ করব।

 এই সময়ে কয়েকজন ব্যাধ মাংসভারবহনে শ্রান্ত হয়ে জলপানের জন্য হ্রদের নিকটে উপস্থিত হ’ল। এরা প্রত্যহ ভীমসেনকে মাংস এনে দিত। ব্যাধরা অন্তরাল থেকে দুর্যোধন অশ্বত্থামা প্রভৃতির সমস্ত কথা শুনলে। পূর্বে যুধিষ্ঠির এদের কাছে দুর্যোধন সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছিলেন। দুর্যোধন হ্রদের মধ্যে লুকিয়ে আছেন জানতে পেরে তারা পাণ্ডবশিবিরে গেল। দ্বাররক্ষীরা তাদের বাধা দিলে, কিন্তু ভীমের আদেশে তারা শিবিরে প্রবেশ ক’রে তাঁকে সব কথা বলল। ভীম তাদের প্রচুর অর্থ দিলেন এবং যুধিষ্ঠির প্রভৃতিকে দুর্যোধনের সংবাদ জানালেন। তখন পাণ্ডবগণ রথারোহণে সদলে সাগরতুল্য বিশাল দ্বৈপায়ন হ্রদের নিকট উপস্থিত হলেন। শঙ্খনাদ, রথের ঘর্ঘর ও সৈন্যদের কোলাহল শুনে কৃপাচার্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা দুর্যোধনকে বললেন, রাজা, পাণ্ডবরা আসছে, অনুমতি দাও আমরা এখন চ’লে যাই। তাঁরা বিদায় নিয়ে দূরে গিয়ে এক বটবৃক্ষের নীচে বসে দুর্যোধনের বিষয় ভাবতে লাগলেন।

 হ্রদের তীরে এসে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, দেখ, দুর্যোধন দৈবী মায়ায় জল স্তম্ভিত ক’রে ভিতরে রয়েছে, এখন মানুষ হ’তে তার ভয় নেই; কিন্তু এই শঠ আমার কাছ থেকে জীবিত অবস্থায় মুক্তি পাবে না। কৃষ্ণ বললেন, ভরতনন্দন, মায়ার দ্বারাই মায়াবীকে নষ্ট করতে হয়। আপনি কূট উপায়ে দুর্যোধনকে বধ করুন, এইরূপ উপায়েই দানবরাজ বলি বদ্ধ হয়েছিলেন এবং হিরণ্যকশিপু পুত্র রাবণ তারকাসুর সুন্দ-উপসন্দ প্রভৃতি নিহত হয়েছিলেন।

 যুধিষ্ঠির সহাস্যে জলস্থ দুর্যোধনকে বললেন, সুযোধন, ওঠ, আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। তোমার দর্প আর মান কোথায় গেল? যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা সজ্জনের ধর্ম নয়, স্বর্গপ্রদও নয়। তুমি পুত্র ভ্রাতা ও পিতৃগণকে নিপাতিত দেখেও যুদ্ধ শেষ না ক’রে নিজে বাঁচতে চাও কেন? বৎস, তুমি আত্মীয় বয়স্য ও বান্ধবগণকে বিনষ্ট করিয়ে হ্রদের মধ্যে লুকিয়ে আছ কেন? দুর্বদ্ধি, তুমি বীর নও তথাপি মিথ্যা বীরত্বের অভিমান কর। ওঠ, ভয় ত্যাগ ক’রে যুদ্ধ কর; আমাদের পরাজিত ক’রে পৃথিবী শাসন কর, অথবা নিহত হয়ে ভূমিতে শয়ন কর।

 দুর্যোধন জলের মধ্যে থেকে উত্তর দিলেন, মহারাজ, প্রাণিগণ ভয়ে অভিভূত হয় তা বিচিত্র নয়, কিন্তু আমি প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসি নি। আমার রথ নেই, তূণ নেই, আমার পার্শ্বরক্ষী সারথি নিহত হয়েছে, আমি সহায়হীন একাকী, অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামের জন্য জলমধ্যে আশ্রয় নিয়েছি। কুন্তীপুত্র, আপনারা আশ্বস্ত হ’ন, আমি উঠে আপনাদের সকলের সঙ্গেই যুদ্ধ করব।

 যুধিষ্ঠির বললেন, সুযোধন, আমরা আশ্বস্তই আছি। বহুক্ষণ তোমার অন্বেষণ করেছি, এখন জল থেকে উঠে যুদ্ধ কর। দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, যাঁদের জন্য কুরুরাজ্য আমার কাম্য, আমার সেই ভ্রাতারা সকলেই পরলোকে গেছেন; আমাদের ধনরত্নের ক্ষয় হয়েছে, ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠগণ নিহত হয়েছেন, আমি বিধবা নারীর তুল্য এই পৃথিবী ভোগ করতে ইচ্ছা করি না। তথাপি আমি পাণ্ডব ও পাঞ্চালদের উৎসাহ ভঙ্গ ক’রে আপনাকে জয় করবার আশা করি। কিন্তু পিতামহ ভীষ্মের পতন ও দ্রোণ-কর্ণের নিধনের পর আর যুদ্ধের প্রয়োজন দেখি না। আমার পক্ষের সকলেই বিনষ্ট হয়েছে, আমার আর রাজ্যের স্পৃহা নেই, আমি দুই খণ্ড মৃগচর্ম পরে বনে যাব। মহারাজ, আপনি এই রিক্ত পৃথিবী যথাসুখে ভোগ করুন।

 দুর্যোধনের করুণ বাক্য শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, বৎস, মাংসাশী পক্ষীর রবের ন্যায় তোমার এই আর্ত—প্রলাপ আমার ভাল লাগছে না। তুমি সমস্ত পৃথিবী দান করলেও আমি নিতে চাই না, তোমাকে যুদ্ধে পরাজিত ক’রেই আমি এই বসুধা ভোগ করতে ইচ্ছা করি। তুমি এখন রাজ্যের অধীশ্বর নও, তবে দান করতে চাচ্ছ কেন? যখন আমরা ধর্মানুসারে শান্তিকামনায় রাজ্য চেয়েছিলাম তখন দাও নি কেন? মহাবল কৃষ্ণ যখন সন্ধির প্রার্থনা করেছিলেন তখন তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিলে, এখন তোমার চিত্তবিভ্রম হ’ল কেন? সূচীর অগ্রে যেটকু ভূমি ধরে তাও তুমি দিতে চাও নি, এখন সমস্ত পৃথিবী ছেড়ে দিচ্ছ কেন? পাপী, তোমার জীবন এখন আমার হাতে। তুমি আমাদের বহু অনিষ্ট করেছ তুমি জীবনধারণের যোগ্য নও; এখন উঠে যুদ্ধ কর।