মহাভারত (রাজশেখর বসু)/শান্তিপর্ব/আপদ্‌ধর্মপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥ আপদ্‌ধর্মপর্বাধ্যায়॥

১০। আপদ্‌গ্রস্ত রাজা—তিন মৎস্যের উপাখ্যান

 যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, যে রাজা অলস ও দুর্বল, যাঁর ধনাগার শূন্য, মন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে এবং অমাত্যরা বিপক্ষের বশীভূত হয়েছে, তিনি অন্য রাজা কর্তৃক আক্রান্ত হ’লে কি করবেন?

 ভীষ্ম বললেন, বিপক্ষ রাজা যদি ধার্মিক ও শুদ্ধস্বভাব হন তবে শীঘ্র সন্ধি করা উচিত। সন্ধি অসম্ভব হ’লে যুদ্ধই কর্তব্য। সৈন্য যদি অনুরক্ত ও সন্তুষ্ট থাকে তবে অল্প সৈন্যেও পৃথিবী জয় করা যায়। যদি যুদ্ধ করা নিতান্ত অসম্ভব হয় তবে রাজা দুর্গ ত্যাগ ক’রে কিছুকাল অন্য দেশে থাকবেন এবং পরে উপযুক্ত মন্ত্রণা ক’রে পুনর্বার নিজ রাজ্য অধিকার করবেন।

 শাস্ত্রে আছে, আপদ্‌গ্রস্ত রাজা স্বরাজ্য ও পররাজ্য থেকে ধনসংগ্রহ করবেন এবং বিশেষত ধনী ও দণ্ডার্হ লোকের ধনই নেবেন। গ্রামবাসীরা যদি পরস্পরের নামে অভিযোগ করে তবে রাজা কাকেও পুরস্কার দেবেন না, তিরস্কারও করবেন না। কেবল সদুপায়ে বা কেবল নিষ্ঠুর উপায়ে ধনসংগ্রহ হয় না, মধ্যবর্তী উপায়ই প্রশস্ত। লোকে ধনহীন রাজাকে অবজ্ঞা করে। বস্ত্র যেমন নারীর লজ্জা আবরণ করে ধনও সেইরূপ রাজার সকল দোষ আবরণ করে। রাজা সর্বতোভাবে নিজের উন্নতির চেষ্টা করবেন, বরং ভগ্ন হবেন কিন্তু কখনও নত হবেন না। দস্যুরা যদি মর্যাদাযুক্ত (ভদ্রভাবাপন্ন) হয় তবে তাদের উচ্ছিন্ন না ক’রে বশীভূত করাই উচিত। ক্ষত্রিয় রাজা দস্যু ও নিষ্ক্রিয় লোকের ধন হরণ করতে পারেন। যিনি অসাধু লোকের অর্থ নিয়ে সাধুদের পালন করেন তিনিই পূর্ণ ধর্মজ্ঞ।

 যুধিষ্ঠির, কার্যাকার্যনির্ধারণ সম্বন্ধে আমি একটি উত্তম উপাখ্যান বলছি শোন।—কোনও জলাশয়ে তিনটি শকুল (শোল) মৎস্য বাস করত, তাদের নাম অনাগতবিধাতা[১], প্রত্যুৎপন্নমতি[২] ও দীর্ঘসূত্র[৩]। একদিন জেলেরা মাছ ধরবার জন্য সেই জলাশয় থেকে জল বার ক’রে ফেলতে লাগল। ক্রমশ জল কমছে দেখে দীর্ঘদর্শী অনাগতবিধাতা তার দুই বন্ধুকে বললে, জলচরদের বিপদ উপস্থিত হয়েছে, পালাবার পথ বন্ধ হবার আগেই অন্য জলাশয়ে চল; যে উপযুক্ত উপায়ে অনাগত অনিষ্টের প্রতিবিধান করে সে বিপন্ন হয় না। দীর্ঘসূত্র বললে, তোমার কথা যথার্থ, কিন্তু কোনও বিষয়ে ত্বরান্বিত হওয়া উচিত নয়। প্রত্যুৎপন্নমতি বললে, কার্যকাল উপস্থিত হ’লে আমি কর্তব্যে অবহেলা করি না। তখন অনাগতবিধাতা জলস্রোতে নির্গত হয়ে অন্য এক জলাশয়ে গেল। জল বেরিয়ে গেলে জেলেরা নানা উপায়ে সমস্ত মাছ ধরতে লাগল, অন্য মাছের সঙ্গে দীর্ঘসূত্র এবং প্রত্যুৎপন্নমতিও ধরা পড়ল। জেলেরা যখন সমস্ত মাছ দড়ি দিয়ে গাঁথছিল তখন প্রত্যুৎপন্নমতি দড়ি কামড়ে রইল, জেলেরা ভাবলে তাকেও গাঁথা হয়েছে। তার পর জেলেরা দড়িতে গাঁথা সমস্ত মাছ অন্য এক বৃহৎ জলাশয়ে ডুবিয়ে ধুতে লাগল, সেই সুযোগে প্রত্যুৎপন্নমতি পালিয়ে গেল। মন্দবধি দীর্ঘসূত্র বিনষ্ট হ’ল।

 যুধিষ্ঠির, যে লোক মোহের বশে আসন্ন বিপদ বুঝতে পারে না সে দীর্ঘসূত্রের ন্যায় বিনষ্ট হয়। যে লোক নিজেকে চতুর মনে ক’রে পূর্বেই প্রস্তুত না হয় সে প্রত্যুৎপন্নমতির ন্যায় সংশয়াপন্ন থাকে। অনাগতবিধাতা ও প্রত্যুৎপন্নমতি উভয়েই সুখী হ’তে পারে, কিন্তু দীর্ঘসূত্র বিনষ্ট হয়। যাঁরা বিচার ক’রে যুক্তি অনুসারে কার্য সম্পাদন করেন তাঁরাই সম্যক ফললাভ করেন।

১১। মার্জার-মূষিক সংবাদ

 ভীষ্ম বললেন, অবস্থাভেদে অমিত্রও মিত্র হয়, মিত্রও অমিত্র হয়; দেশ কাল বিবেচনা ক’রে স্থির করতে হয় কে বিশ্বাসের যোগ্য এবং কার সঙ্গে বিরোধ করা উচিত। হিতার্থী পণ্ডিতগণের সঙ্গে চেষ্টা ক’রে সন্ধি করা উচিত, এবং প্রাণরক্ষার জন্য শত্রুর সঙ্গেও সন্ধি করা বিধেয়। যিনি স্বার্থ বিচার ক’রে উপযুক্ত কালে অমিত্রের সঙ্গে সন্ধি এবং মিত্রের সঙ্গে বিরোধ করেন তিনি মহৎ ফল লাভ করেন। এক পুরাতন উপাখ্যান বলছি শোন। —

 কোনও মহারণ্যে এক বিশাল বটবৃক্ষ ছিল। পলিত নামে এক মূষিক সেই বটবৃক্ষের মূলে শতদ্বার গর্ত নির্মাণ ক’রে তাতে বাস করত। লোমশ নামে এক মার্জার সেই বটের শাখায় থাকত এবং শাখাবাসী পক্ষীদের ভক্ষণ করত। এক চণ্ডাল পশুপক্ষী ধরবার জন্য প্রত্যহ সেই বৃক্ষের নীচে ফাঁদ পেতে রাখত। একদিন লোমশ সতর্কতা সত্ত্বেও সেই ফাঁদে পড়ল। চিরশত্রু বিড়াল আবদ্ধ হ’লে মূষিক নির্ভয়ে বিচরণ করতে লাগল। সে দেখলে, ফাঁদের মধ্যে আমিষ খাদ্য রয়েছে; তখন সে মনে মনে বিড়ালকে উপহাস ক’রে ফাঁদের উপর থেকে আমিষ খেতে লাগল। সেই সময়ে এক নকুল (বেঁজি) এবং এক পেচকও সেখানে উপস্থিত হ’ল। মূষিক ভাবলে, এখন আমার তিন শত্রু সমাগত হয়েছে, আমি নীতিশাস্ত্র অনুসারে বিড়ালের সাহায্য নেব। এই মূঢ় বিড়াল বিপদে পড়েছে, প্রাণরক্ষার জন্য সে আমার সঙ্গে সন্ধি করবে। মুষিক বললে, ওহে মার্জার, তুমি জীবিত আছ তো? ভয় নেই, তুমি রক্ষা পাবে; যদি আমাকে আক্রমণ না কর তবে আমি তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করব। আমিও সংকটাপন্ন, ওই নকুল আর পেচক লোলুপ হয়ে আমাকে দেখছে। তুমি আর আমি বহুকাল এই বটবৃক্ষের আশ্রয়ে বাস করছি, তুমি শাখায় থাক, আমি মূলদেশে থাকি। যে কাকেও বিশ্বাস করে না এবং যাকে কেউ বিশ্বাস করে না, পণ্ডিতরা তেমন লোকের প্রশংসা করেন না। অতএব তোমার আর আমার মধ্যে প্রণয় হ’ক, তুমি যদি আমাকে রক্ষা কর তবে আমিও তোমাকে রক্ষা করব।

 বৈদূর্যলোচন মার্জার মূষিককে বললে, সৌম্য, তোমার কল্যাণ হ’ক। যদি উদ্ধারের উপায় জান তবে আর বিলম্ব ক’রো না, তুমি আর আমি দুজনেই বিপদাপন্ন, অতএব আমাদের সন্ধি হ’ক। মুক্তি পেলে আমি তোমার উপকার ভুলব না। আমি মান বিসর্জন দিয়ে তোমার শরণাপন্ন হ’লাম।

 মূষিক আশ্বস্ত হয়ে বিড়ালের বক্ষস্থলে লগ্ন হ’ল, তখন নকুল ও পেচক হতাশ হয়ে চ’লে গেল। মূষিক ধীরে ধীরে বিড়ালের পাশ কাটতে লাগল। বিড়াল বললে, সখা, বিলম্ব করছ কেন? আমি যদি পূর্বে কোনও অপরাধ ক’রে থাকি তবে ক্ষমা কর, আমার উপর প্রসন্ন হও। মূষিক উত্তর দিলে, সখা, আমি সময়জ্ঞ। যদি অসময়ে তোমাকে বন্ধনমুক্ত করি তবে আমি তোমার কবলে পড়ব। তুমি নিশ্চিত হও, আমি তোমার পাশের সমস্ত তন্তু কেটে ফেলেছি, কেবল একটি অবশিষ্ট রেখেছি; চণ্ডালকে আসতে দেখলেই তা কেটে ফেলব, তখন তুমি ত্রস্ত হয়ে বৃক্ষশাখায় আশ্রয় নেবে, আমিও গর্তে প্রবেশ করব।

 রাত্রি প্রভাত হ’লে বিকটমূর্তি চণ্ডাল কুকুরের দল নিয়ে উপস্থিত হ’ল। মূষিক তখনই বিড়ালকে বন্ধনমুক্ত করলে, বিড়াল বৃক্ষশাখায় এবং মূষিক তার গর্তে গেল। চণ্ডাল হতাশ হয়ে চ’লে গেল। ভয়মুক্ত হয়ে বিড়াল মূষিককে বললে, সখা, তুমি আমার প্রাণরক্ষা করেছ, এখন বিপদ দূর হয়েছে, তবে আমার কাছে আসছ না কেন? তুমি সবান্ধবে আমার সঙ্গে এস, আমার আত্মীয়বন্ধগণ সকলেই তোমার সম্মান করবে। তুমি বদ্ধিতে শুত্রুাচার্য তুল্য; আমার অমাত্য হও এবং পিতার ন্যায় আমাকে উপদেশ দাও।

 তখন সেই পলিত নামক মূষিক বললে, হে লোমশ, মিত্রতা ও শত্রুতা স্থির থাকে না, প্রয়োজন অনুসারে লোকে মিত্র বা শত্রু হয়; স্বার্থই বলবান। যে কারণে আমাদের সৌহার্দ হয়েছিল সেই কারণ আর নেই। এখন কিজন্য আমি তোমার প্রিয় হ’তে পারি? তুমি আমার শত্রু ছিলে, স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিত্র হয়েছিলে, এখন আবার শত্রু হয়েছ। আমাকে ভক্ষণ করা ভিন্ন তোমার এখন অন্য কর্তব্য নেই। তোমার ভার্যা আর পুত্রেরাই বা আমাকে নিষ্কৃতি দেবে কেন? সখা, তুমি যাও, তোমার কল্যাণ হ’ক। যদি কৃতজ্ঞ হ’তে চাও তবে আমি যখন অসতর্ক থাকব তখন আমার অনুসরণ ক’রো না, তা হ’লেই সৌহার্দ্য রক্ষা হবে।

 উপাখ্যান শেষ ক’রে ভীষ্ম বললেন, যুধিষ্ঠির, সেই মূষিক দুর্বল হলেও একাকী বুদ্ধিবলে বহু শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল। যারা পূর্বে শত্রুতা ক’রে আবার মৈত্রীর চেষ্টা করে, পরস্পরকে প্রতারণা করাই তাদের উদ্দেশ্য। তাদের মধ্যে যে অধিক বুদ্ধিমান সে অন্যকে বঞ্চনা করে, যে নির্বোধ সে বঞ্চিত হয়।

১২। বিশ্বামিত্র-চণ্ডাল-সংবাদ

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, যখন ধর্ম লোপ পায়, লোকে পরম্পরকে বঞ্চনা করে, অনাবৃষ্টির ফলে খাদ্যাভাব হয়, জীবিকার সমস্ত উপায় দস্যুর হস্তগত হয়, সেই আপৎকালে কিরূপে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা উচিত? ভীষ্ম বললেন, আমি এক ইতিহাস বলছি শোন। —

 ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের সন্ধিকালে দ্বাদশবর্ষব্যাপী ঘোর অনাবৃষ্টি হয়েছিল। কৃষি ও গোরক্ষা অসম্ভব হ’ল, চোর এবং রাজাদের উৎপীড়নে গ্রাম নগর জনশূন্য হ’ল, গবাদি পশু নষ্ট হয়ে গেল, মানুষ ক্ষুধিত হয়ে পরস্পরের মাংস খেতে লাগল। সেই সময়ে মহর্ষি বিশ্বামিত্র স্ত্রীপুত্রকে কোনও জনপদে ফেলে রেখে ক্ষুধার্ত হয়ে নানা স্থানে পর্যটন করতে লাগলেন। একদিন তিনি চণ্ডালবসতিতে এসে দেখলেন, ভগ্ন কলস, কুক্কুরের চর্ম, শূকর ও গর্দভের অস্থি, এবং মৃত মনুষ্যের বস্ত্র চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে। কোথাও কুক্কুট ও গর্দভ ডাকছে, কোথাও চণ্ডালরা কলহ করছে। বিশ্বামিত্র খাদ্যের অন্বেষণ করলেন, কিন্তু কোথাও মাংস অন্ন বা ফলমূল পেলেন না; তখন তিনি দুর্বলতায় অবসন্ন হয়ে ভূপতিত হলেন। এমন সময়ে তিনি দেখতে পেলেন, এক চণ্ডালের গৃহে সদ্যোনিহত কুক্কুরের মাংস রয়েছে। বিশ্বামিত্র ভাবলেন, প্রাণরক্ষার জন্য চুরি করলে দোষ হবে না। রাত্রিকালে চণ্ডালরা নিদ্রিত হ’লে বিশ্বামিত্র কুটীরে প্রবেশ করলেন। সেই কুটীরস্থ চণ্ডাল জাগরিত হয়ে বললে, কে তুমি মাংস চুরি করতে এসেছ? তোমাকে আর বাঁচতে হবে না।

 বিশ্বামিত্র উদ্‌বিগ্ন হয়ে বললেন, আমি বিশ্বামিত্র, ক্ষুধায় মৃতপ্রায় হয়ে তোমার কুক্কুরের জঘনমাংস হরণ করতে এসেছি। আমার বেদজ্ঞান লুপ্ত হয়েছে, আমি খাদ্যাখাদ্য বিচারে অক্ষম, অধর্ম জেনেও আমি চৌর্যে প্রবৃত্ত হযেছি। অগ্নি যেমন সর্বভূক, আমাকেও এখন সেইরূপ জেনো।

 চণ্ডাল সসম্ভ্রমে শয্যা থেকে উঠে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললে, মহর্ষি, এমন কার্য করবেন না যাতে আপনার ধর্মহানি হয়। পণ্ডিতদের মতে কুক্কুর শৃগালেরও অধম, আবার তার জঘনের মাংস অন্য অঙ্গের মাংস অপেক্ষা অপবিত্র। আপনি ধার্মিকগণের অগ্রগণ্য, প্রাণরক্ষার জন্য অন্য উপায় অবলম্বন করুন। বিশ্বামিত্র বললেন, আমার অন্য উপায় নেই। প্রাণরক্ষার জন্য যে কোনও উপায় বিধেয়, সবল হয়ে ধর্মাচরণ করলেই চলবে। বেদরূপে অগ্নি আমার বল, তারই প্রভাবে আমি অভক্ষ্য মাংস খেয়ে ক্ষুধাশান্তি করব। চণ্ডাল বললে, এই কুক্কুরমাংসে আয়ুবৃদ্ধি হয় না, প্রাণ তৃপ্ত হয় না। পঞ্চনখ প্রাণীর মধ্যে শশকাদি পঞ্চ পশুই দ্বিজাতির ভক্ষ্য, অতএব আপনি অন্য খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করুন, অথবা ক্ষুধার বেগ দমন ক’রে ধর্মরক্ষা করুন।

 বিশ্বামিত্র বললেন, এখন আমার পক্ষে মৃগমাংস আর কুক্কুরমাংস সমান। আমার প্রাণসংশয় হয়েছে, অসৎ কার্য করলেও আমি চণ্ডাল হয়ে যাব না। চণ্ডাল বললে, ব্রাহ্মণ কুকর্ম করলে তাঁর ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হয়, এজন্য আমি আপনাকে নিবারণ করছি। নীচ চণ্ডালের গৃহ থেকে কুক্কুরমাংস হরণ করলে আপনার চরিত্র দূষিত হবে, আপনাকে অনুতাপ করতে হবে। বিশ্বামিত্র বললেন, ভেকের চিৎকার শুনে বৃষ জলপানে বিরত হয় না; তোমার উপদেশ দেবার অধিকার নেই।

 বিশ্বামিত্র চণ্ডালের কোনও আপত্তি মানলেন না, মাংস নিয়ে বনে চ’লে গেলেন। আগে দেবগণকে তৃপ্ত ক’রে তার পর সপরিবারে মাংস ভোজন করবেন এই স্থির ক’রে তিনি যথাবিধি অগ্নি আহরণ ও চরু[৪] পাক ক’রে দেবগণ ও পিতৃগণকে আহ্বান করলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র প্রচুর বারিবর্ষণ ক’রে ওষধি ও প্রজাগণকে সঞ্জীবিত করলেন। বিশ্বামিত্রের পাপ নষ্ট হ’ল, তিনি পরমগতি লাভ করলেন।


 আখ্যান শেষ ক’রে ভীষ্ম বললেন, চরুর আস্বাদ না নিয়েই বিশ্বামিত্র দেবগণ ও পিতৃগণকে তৃপ্ত করেছিলেন। বিপদাপন্ন হ’লে বিদ্বান লোকের যেকোনও উপায়ে আত্মরক্ষা করা উচিত; জীবিত থাকলে তিনি বহু পুণ্য অর্জন ও শুভলাভ করতে পারবেন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি যে অশ্রদ্ধেয় ঘোর কর্ম কর্তব্য ব’লে নির্দেশ করলেন তা শুনে আমি বিষাদগ্রস্ত ও মোহাচ্ছন্ন হয়েছি, আমার ধর্মজ্ঞান শিথিল হচ্ছে। আপনার কথিত ধর্মে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। ভীষ্ম বললেন, আমি তোমাকে বেদাদি শাস্ত্র থেকে উপদেশ দিচ্ছি না, পণ্ডিতগণ বুদ্ধিবলে আপৎকালের কর্তব্য নির্ণয় করেছেন। ধর্মের কেবল এক অংশ আশ্রয় করা উচিত নয়, রাজধর্মের বহু শাখা। উগ্র কর্ম সাধনের জন্য বিধাতা তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। শুত্রুাচার্য বলেছেন, আপৎকালে অশিষ্ট লোকের নিগ্রহ এবং শিষ্ট লোকের পালনই ধর্ম।

১৩। খড়্‌গের উৎপত্তি

 খড়্‌গযুদ্ধবিশারদ নকুল বললেন, পিতামহ, ধনুই শ্রেষ্ঠ প্রহরণ রূপে গণ্য হয়, কিন্তু আমার মতে খড়্‌গই প্রশংসার যোগ্য। খড়্‌গধারী বীর ধনুর্ধর ও গদাশক্তিধর শত্রুগণকে বাধা দিতে পারেন। আপনার মতে কোন্ অস্ত্র উৎকৃষ্ট? কে খড়্‌গ উদ্‌ভাবন করেছিলেন?

 ভীষ্ম বললেন, পুরাকালে হিরণ্যাক্ষ হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদ বিরোচন বলি প্রভৃতি দানবেন্দ্রগণ অধর্মরত হয়েছিলেন। প্রজারক্ষার নিমিত্ত ব্রহ্মা ব্রহ্মর্ষিগণের সঙ্গে হিমালয়শৃঙ্গে গিয়ে সেখানে এক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করলেন। সেই যজ্ঞে হুতাশন থেকে এক আশ্চর্য ভূত উত্থিত হ’ল, তার বর্ণ নীলোৎপলতুল্য, দন্তসকল তীক্ষ্ণ, উদর কৃশ, দেহ অতি উন্নত। এই দুর্ধর্ষ অমিততেজা ভূতের উত্থানে বসুন্ধরা বিচলিত এবং মহাসাগর বিক্ষুব্ধ হ’ল, উল্কাপাত এবং নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখা গেল। ব্রহ্মা বললেন, জগতের রক্ষা এবং দানবগণের বিনাশের নিমিত্ত আমি অসি নামক এই বীর্যবান ভূতকে চিন্তা করেছিলাম। ক্ষণকাল পরে সেই ভূত কালান্তকতুল্য ভীষণ খরধার নির্মল নিস্ত্রিংশ[৫] রূপে প্রকাশিত হ’ল। ব্রহ্মা সেই অধর্ম নিবারক তীক্ষ্ণ অস্ত্র ভগবান রুদ্রকে দিলেন। রুদ্র সেই খড়্‌গের আঘাতে সমস্ত দানব বিনষ্ট করলেন এবং জগতে ধর্ম সংস্থাপন ক’রে মঙ্গলময় শিবরূপ ধারণ করলেন। তার পর তিনি সেই রুধিরাক্ত অসি ধর্মপালক বিষ্ণুকে দিলেন। বিষ্ণুর কাছ থেকে ক্রমে ক্রমে মরীচি, মহর্ষিগণ, ইন্দ্র, লোকপালগণ, সূর্যপুত্র মনু, মনুর পুত্র ক্ষুপ, তার পর ইক্ষাকু পুরূরবা প্রভৃতি, তার পর ভরদ্বাজ, দ্রোণ, এবং পরিশেষে কৃপাচার্য সেই অস্ত্র পেয়েছিলেন। কৃপের কাছ থেকে তুমি ও তোমার ভ্রাতারা সেই পরম অসি লাভ করেছ। মাদ্রীপুত্র, সকল প্রহরণের মধ্যে খড়্‌গই প্রধান। ধনুর উদ্‌ভাবক বেণপুত্র পৃথু, যিনি ধর্মানুসারে প্রজাপালন এবং পৃথিবী দোহন ক’রে বহু শস্য উৎপাদন করেছিলেন; অতএব ধনুও আদরণীয়। যুদ্ধবিশারদ বীরগণের সর্বদা অসির পূজা করা উচিত।

১৪। কৃতঘ্ন গৌতমের উপাখ্যান

 ভীষ্মের কথা শেষ হ’লে যুধিষ্ঠির গৃহে গেলেন এবং বিদুর ও ভ্রাতাদের সঙ্গে ধর্ম অর্থ ও কাম সম্বন্ধে বহু আলাপ করলেন। পরদিন তাঁরা পুনর্বার ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হলেন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, কিপ্রকার লোক সাধু? কার সঙ্গে পরম প্রীতি হয়? বর্তমান কালে এবং ভবিষ্যতে কারা হিতকারী হয়? আমার মনে হয়, হিতবাক্য শোনে এবং হিতকার্য করে এমন সুহৃৎ দুর্লভ। ভীষ্ম বললেন, যারা লোভী ক্রূর ধর্মত্যাগী শঠ অলস কুটিল গুরু পত্নীধর্ষক বন্ধুপরিত্যাগী নির্লজ্জ নাস্তিক অসত্যভাষী দুঃশীল নৃশংস, যে মিত্রের অপকার করে, অপরের অর্থ কামনা করে, অকারণে ক্রোধ এবং হঠাৎ বিরোধ করে, যারা সুরাপায়ী প্রাণিহিংসাপরায়ণ কৃতঘ্ন এবং জনসমাজে নিন্দিত, এমন লোকের সঙ্গে মিত্রতা করা উচিত নয়। যাঁরা সৎকুলজাত জ্ঞানী রূপবান গুণবান অলোভী কৃতজ্ঞ সত্যসন্ধ জিতেন্দ্রিয় ও জনসমাজ খ্যাত, তাঁরাই রাজার মিত্র হবার যোগ্য। যাঁরা কষ্টস্বীকার ক’রেও সুহৃদের কার্য করেন, তাঁরাই বিশ্বস্ত ও ধার্মিক হন এবং সহৃদ্‌গণের প্রতি সর্বদা অনুরক্ত থাকেন। কৃতঘ্ন ও মিত্রঘাতক নরাধমগণ সকলেরই বর্জনীয়। আমি এক প্রাচীন ইতিহাস বলছি শোন। —

 গৌতম নামে এক ব্রাহ্মণ ভিক্ষার জন্য এক ভদ্রস্বভাব দস্যুর গৃহে এসেছিলেন। দস্যু তাঁকে নূতন বস্ত্র এবং একটি বিধবা যুবতী দান করলে। গৌতম দস্যুদের আশ্রয়ে বাস করতে লাগলেন এবং তাদেরই তুল্য হিংস্র ও নির্দয় হলেন। কিছুকাল পরে এক শুদ্ধস্বভাব বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ সেই দস্যু গ্রামে এলেন; ইনি গৌতমের স্বদেশবাসী ও সখা ছিলেন। গৌতমের স্কন্ধে নিহত হংসের ভার, হস্তে ধনুর্বাণ এবং তাঁর রাক্ষসের ন্যায় রুধিরাক্ত দেহ দেখে নবাগত ব্রাহ্মণ বললেন, তুমি প্রসিদ্ধ বেদজ্ঞ বিপ্রের বংশে জন্মগ্রহণ ক’রে এমন কুলাঙ্গার হয়েছ কেন? গৌতম বললেন, আমি দরিদ্র ও বেদজ্ঞানশূন্য, অভাবে প’ড়ে এমন হয়েছি। আজ তুমি এখানে থাক, কাল আমি তোমার সঙ্গে চ’লে যাব। দয়ালু ব্রাহ্মণ সম্মত হয়ে সেখানে রাত্রিযাপন করলেন, কিন্তু গৌতম বার বার অনুরোধ করলেও আহার করলেন না।

 পরদিন ব্রাহ্মণ চ’লে গেলে গৌতমও সাগরের দিকে যাত্রা করলেন। তিনি একদল বণিকের সঙ্গ নিলেন, কিন্তু বন্য হস্তীর আক্রমণে বহু বণিক বিনষ্ট হ’ল, গৌতম একাকীই অরণ্যপথে যেতে লাগলেন এবং এক সুরম্য সমতল প্রদেশে উপস্থিত হলেন। সেখানে এক বৃহৎ বটবৃক্ষ দেখে গৌতম তার পাদদেশে সুখে নিদ্রা গেলেন। সন্ধ্যাকালে সেখানে ব্রহ্মার প্রিয় সখা কশ্যপপুত্র পক্ষিশ্রেষ্ঠ নাড়ীজঙ্ঘ নামক বকরাজ ব্রহ্মলোক থেকে অবতীর্ণ হলেন। ইনি ধরাতলে রাজধর্মা নামে বিখ্যাত ছিলেন। রাজধর্মা গৌতমকে বললেন, ব্রাহ্মণ, আপনার কুশল তো? আপনি আমার আলয়ে অতিথি হয়েছেন, আজ এখানেই রাত্রিযাপন করুন।

 রাজধর্মা গঙ্গা থেকে নানাপ্রকার মৎস্য এনে অতিথিকে খেতে দিলেন। গৌতমকে ধনাভিলাষী জেনে রাজধর্মা পরদিন প্রভাতকালে বললেন, সৌম্য, আপনি এই পথ দিয়ে যান, তিন যোজন দূরে আমার সথা বিরূপাক্ষ নামক রাক্ষসরাজকে দেখতে পাবেন; তিনি আপনার সকল অভিলাষ পূর্ণ করবেন। বিরূপাক্ষ গৌতমকে সসম্মানে গ্রহণ ক’রে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। গৌতম কেবল তাঁর গোত্র জানালেন, আর কিছুই বললেন না। বিরূপাক্ষ বললেন, ব্রাহ্মণ, আপনার নিবাস কোথায়? কোন গোত্রে বিবাহ করেছেন? সত্য বলুন, ভয় করবেন না। গৌতম বললেন, আমার জন্ম মধ্যদেশে, এখন শবরালয়ে থাকি; আমি এক বিধবা শূদ্রাকে বিবাহ করেছি। রাক্ষসরাজ বিষণ্ণ হয়ে ভাবলেন, ইনি কেবল জাতিতেই ব্রাহ্মণ; যাই হ’ক, আমার সুহৃৎ মহাত্মা বকরাজ এঁকে পাঠিয়েছেন, অতএব এঁকে আমি তুষ্ট করব। আজ কার্তিকী পূর্ণিমা, সহস্র ব্রাহ্মণের সঙ্গে এঁকেও ভোজন করাব, তার পর ধনদান করব।

 ব্রাহ্মণভোজনের পর বিরূপাক্ষ সকলকেই স্বর্ণময় ভোজনপাত্র এবং প্রচুর ধনরত্ন দক্ষিণা দিলেন। সকলে সন্তুষ্ট হয়ে প্রস্থান করলেন, গৌতম তাঁর স্বর্ণের ভার কষ্টে বহন ক’রে শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পূর্বোক্ত বটবৃক্ষের নিকট ফিরে এলেন। মিত্রবৎসল বিহগশ্রেষ্ঠ রাজধর্মা পক্ষদ্বারা বীজন করে গৌতমের শ্রান্তি দূর করলেন এবং ভোজনের আয়োজন করে দিলেন। ভোজনকালে গৌতম ভাবলেন, আমি অনেক সুবর্ণ পেয়েছি, বহু দূরে আমাকে যেতে হবে, পথের জন্য খাদ্যসামগ্রী কিছুই নেই। এই বকরাজের দেহে প্রচুর মাংস আছে, একেই বধ করে নিয়ে যাব। রাজধর্মা বটবৃক্ষের নিকটে অগ্নি জ্বেলে তারই নিকটে নিজের ও গৌতমের শয়নের ব্যবস্থা করলেন। রাত্রিকালে দুরাত্মা গৌতম রাজধর্মাকে বধ করলেন এবং তাঁর পক্ক মাংস ও সুবর্ণভার নিয়ে দ্রুতবেগে প্রস্থান করলেন।

 পরদিন রাক্ষসরাজ বিরূপাক্ষ তাঁর পুত্রকে বললেন, বৎস, আজ আমি রাজধর্মাকে দেখি নি, তিনি প্রতিদিন প্রভাতকালে ব্রহ্মাকে বন্দনা করতে যান, আমাকে না দেখে গৃহে ফেরেন না। তুমি তাঁর খোঁজ নিয়ে এস। দুরাচার গৌতম তাঁর কাছে গেছে সেজন্য আমি উদ্‌বিগ্ন হয়েছি। বিরূপাক্ষের পুত্র তাঁর অনুচরদের নিয়ে বটবৃক্ষের কাছে গিয়ে রাজধর্মার অস্থি দেখতে পেলেন। তার পর তিনি দ্রুতবেগে গিয়ে গৌতমকে ধ’রে ফেললেন এবং তাঁকে মেরুব্রজ নগরে বিরূপাক্ষের কাছে নিয়ে গেলেন। রাজধর্মার মৃতদেহ দেখে সকলেই কাতর হয়ে কাঁদতে লাগলেন। বিরূপাক্ষ বললেন, এই পাপাত্মা গৌতমকে এখনই বধ কর, এর মাংস রাক্ষসরা খাক। রাক্ষসরা বিনীত হয়ে বললে, মহারাজ, একে দস্যুর হাতে দিন, এর পাপদেহ আমরা খেতে পারব না। বিরূপাক্ষের আদেশে রাক্ষসরা গৌতমকে খণ্ড খণ্ড ক’রে দস্যুদের দিলে, কিন্তু দস্যুরাও খেতে চাইল না। মিত্রদ্রোহী কৃতঘ্ন নৃশংস লোক কীটেরও অভক্ষ্য।

 বিরূপাক্ষ যথাবিধি রাজধর্মার প্রেতকার্য করলেন। সেই সময়ে দক্ষকন্যা পয়স্বিনী সুরভি ঊর্ধ্বে আবির্ভূত হলেন, তাঁর মুখ থেকে দগ্ধফেন নিঃসৃত হয়ে চিতার উপর পড়ল। বকরাজ রাজধর্মা পুনর্জীবিত হলেন। তখন ইন্দ্র এসে বললেন, পুরাকালে রাজধর্মা একবার ব্রহ্মার সভায় যান নি; ব্রহ্মা রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তারই ফলে রাজধর্মার নিধন হয়েছিল।

 রাজধর্মা ইন্দ্রকে বললেন, দেবরাজ, যদি আমার উপর দয়া থাকে তবে আমার প্রিয় সখা গৌতমকে পুনর্জীবিত করুন। গৌতম জীবন লাভ করলে রাজধর্মা তাঁকে আলিঙ্গন ক’রে ধনরত্নের সহিত বিদায় দিলেন এবং পূর্বের ন্যায় ব্রহ্মার সভায় গেলেন। গৌতম শবরালয়ে ফিরে এলেন এবং পুনর্ভু (দ্বিতীয়বার বিবাহিতা) শূদ্রা পত্নীর গর্ভে দুষ্কৃতকারী বহু পুত্রের জন্ম দিলেন। দেবগণের শাপে কৃতঘ্ন গৌতম মহানরকে গিয়েছিলেন।

 আখ্যান শেষ ক’রে ভীষ্ম বললেন, কৃতঘ্ন লোকের যশ সুখ ও আশ্রয় নেই, তারা কিছুতেই নিষ্কৃতি পায় না। মিত্র হ’তে সম্মান ও সর্বপ্রকার ভোগ্য বস্তু লাভ করা যায়, বিপদ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। বিচক্ষণ লোকে মিত্রের সমাদর করেন এবং মিত্রদ্রোহী কৃতঘ্ন নরাধমকে বর্জন করেন।

  1. যে ভবিষ্যতের জন্য ব্যবস্থা করে বা প্রস্তুত থাকে।
  2. যে পূর্বে প্রস্তুত না থেকেও কার্যকালে বুদ্ধি খাটিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা করে।
  3. যে কাজ করতে দেরি করে, অলস।
  4. হব্য। এখানে কুকুরের মাংস।
  5. যে খড়্‌গ লম্বায় ত্রিশ আঙুলের বেশী।