মহাভারত (রাজশেখর বসু)/শান্তিপর্ব/মোক্ষধর্মপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥ মোক্ষধর্মপর্বাধ্যায়॥

১৫। আত্মজ্ঞান—ব্রাহ্মণ-সেনজিৎ-সংবাদ

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি রাজধর্মের অন্তর্গত আপদধর্ম বিবৃত করেছেন, এখন যে ধর্ম সকলের পক্ষেই শ্রেয় তার উপদেশ দিন। ধনক্ষয় হ’লে অথবা স্ত্রীপুত্রাদির মৃত্যু হ’লে যে বুদ্ধি দ্বারা শোক দূর করা যায় তার সম্বন্ধেও বলুন।

 ভীষ্ম বললেন, ধর্মের নানা দ্বার আছে, ধর্মকার্য কখনও বিফল হয় না। লোকের যে বিষয়ে নিষ্ঠা হয় তাকেই শ্রেয় জ্ঞান করে, অন্য বিষয়ে তার প্রবৃত্তি হয় না। সংসার অসার এই জ্ঞান হ’লে বৈরাগ্যের উদয় হয়, তখন বুদ্ধিমান লোকের আত্মমোক্ষের জন্য যত্ন করা উচিত। শোকনিবারণের উপায় আত্মজ্ঞান লাভ। আমি এক প্রাচীন কথা বলছি শোন। —

 রাজা সেনজিৎ পুত্রের মৃত্যুতে অত্যন্ত কাতর হয়েছিলেন। এক ব্রাহ্মণ তাঁকে এই কথা বলে প্রবোধ দিয়েছিলেন। — রাজা, তুমি নিজেই শোচনীয়, তবে অন্যের জন্য শোক করছ কেন? আমি মনে করি, আমার আত্মাও আমার নয়, আবার সমগ্র পৃথিবীই আমার। এইরূপ বুদ্ধি থাকায় আমি হৃষ্ট হই না ব্যথিতও হই না। মহাসাগরে যেসকল কাষ্ঠ ভাসে তারা কখনও মিলিত হয় কখনও পৃথক হয়; জীবগণের মিলনবিচ্ছেদও সেইরূপ। পুত্রাদির উপর স্নেহ করা উচিত নয়, কারণ বিচ্ছেদ অনিবার্য। তোমার পুত্র অদৃশ্য স্থান থেকে এসেছিল, আবার অদৃশ্য স্থানেই চ’লে গেছে; সে তোমাকে জানত না, তুমিও তাকে জানতে না, তবে কেন শোক করছ? বিষয়বাসনা থেকেই দুঃখের উৎপত্তি হয়। সুখের অন্তে দুঃখ এবং দুঃখের অন্তে সুখ হয়, সুখদুঃখ চক্রের ন্যায় আবর্তন করে। জীবন ও শরীর একসঙ্গেই উৎপন্ন হয়, একসঙ্গেই বিনষ্ট হয়। তৈলকার যেমন তৈলযন্ত্রে তিল নিপীড়িত করে, অজ্ঞানসম্ভুত ক্লেশসকল সেইরূপ জীবগণকে সংসারচক্রে নিপীড়িত করে। মানুষ স্ত্রীপুত্রাদির জন্য পাপকর্ম করে, কিন্তু সে একাকীই ইহলোকে ও পরলোকে পাপের ফল ভোগ করে। বুদ্ধি থাকলেই ধন হয় না, ধন থাকলেই সুখ হয় না। —

যে চ মূঢ়তমা লোকে যে চ বুদ্ধেঃ পরং গতাঃ।
তে নরাঃ সুখমেধন্তে ক্লিশ্যত্যন্তরিতো জনঃ ॥
যে চ বুদ্ধিসুখং প্রাপ্তা দ্বন্দ্বাতীতা বিমৎসরাঃ।
তান্নৈবার্থা ন চানর্থা ব্যথয়ন্তি কদাচন॥
অথ যে বুদ্ধিমপ্রাপ্তা ব্যতিক্রান্তাশ্চ মূঢ়তাম্।
তেঽতিবেলং প্রহৃষ্যন্তি সন্তাপমুপযান্তি চ॥
সুখং বা যদি বা দুঃখং প্রিয়ং বা যদি বাপ্রিয়ম্।
প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতঃ॥

— জগতে যারা মূঢ়তম এবং যারা পরমবুদ্ধি লাভ করেছে তারাই সুখভোগ করে, যারা মধ্যবর্তী তারা ক্লেশ পায়। যাঁরা রাগদ্বেষাদির অতীত এবং অসূয়াশূন্য হয়ে পরমবুদ্ধিজনিত সুখ লাভ করেছেন, অর্থ ও অনর্থ (ইষ্ট ও অনিষ্ট) তাঁদের কদাচ ব্যথিত করে না। আর যাঁরা পরমবুদ্ধি লাভ করেন নি অথচ মূঢ়তা অতিক্রম করেছেন, তাঁরাই অত্যন্ত হর্ষ ও অত্যন্ত সন্তাপ ভোগ করেন। সুখ বা দুঃখ, প্রিয় বা অপ্রিয়, যাই উপস্থিত হ’ক, অপরাজিত (অনভিভূত) হয়ে হৃদয়ে মেনে নেবে।

 ব্রাহ্মণের নিকট এইপ্রকার উপদেশ পেয়ে সেনজিৎ শান্তিলাভ করলেন।

১৬। অজগরব্রত—কামনাত্যাগ

 ভীষ্ম বললেন, শম্পাক নামে এক ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নীর আচরণে এবং অন্নবস্ত্রের অভাবে কষ্ট পেয়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, মানুষ জন্মাবধি যে সুখদুঃখ ভোগ করে, সে সমস্ত যদি সে দৈবকৃত মনে করে তবে হৃষ্ট বা ব্যথিত হয় না। যাঁর কিছুই নেই তিনি সুখে শয়ন করেন, সুখে উত্থান করেন; তাঁর শত্রু হয় না। রাজ্যের তুলনায় অকিঞ্চনতারই গুণ অধিক। বিদেহরাজ জনক বলেছিলেন, আমার বিত্তের অন্ত নেই, তথাপি আমার কিছুই নেই; মিথিলারাজ্য দগ্ধ হয়ে গেলেও আমার কিছু নষ্ট হয় না।

 দানবরাজ প্রহ্লাদ এক ব্রাহ্মণকে বলেছিলেন, আপনি নির্লোভ শুদ্ধস্বভাব দয়ালু জিতেন্দ্রিয় অসূয়াহীন মেধাবী ও প্রাজ্ঞ, তথাপি বালকের ন্যায় বিচরণ করেন। আপনি লাভালাভে তুষ্ট বা দুঃখিত হন না, ধর্ম অর্থ ও কামেও আপনি উদাসীন। আপনার তত্ত্বজ্ঞান শাস্ত্র ও আচরণ কিরূপ তা আমাকে বলুন। ব্রাহ্মণ বললেন, প্রহ্লাদ, অজ্ঞাত কারণ থেকে জীবগণের উৎপত্তি ও বিনাশ হয়; মহাকায় ও সূক্ষ্ম, স্থাবর ও জঙ্গম সকল জীবেরই মৃত্যু হয়; আকাশচারী জ্যোতিষ্কগণেরও পতন হয়। সকলেই মৃত্যুর বশীভূত এই জেনে আমি সুখে নিদ্রা যাই। যদি লোকে দেয় তবে উৎকৃষ্ট খাদ্য প্রচুর পরিমাণে খাই, না পেলে অভুক্ত থাকি। কখনও অন্নের কণা, কখনও পিণ্যাক (তিলের খোল), কখনও পলান্ন খাই; কখনও পর্যঙ্কে কখনও ভূমিতে শুই; কখনও চীর কখনও মহামূল্য বস্ত্র পরি। স্বধর্ম থেকে চ্যুত না হয়ে রাগদ্বেষাদি ত্যাগ ক’রে পবিত্রভাবে আমি অজগরব্রত আচরণ করছি। অজগর সর্প যেমন দৈবক্রমে লব্ধ খাদ্যে তুষ্ট থাকে, আমিও সেইরূপ যদৃচ্ছাগত বিষয়েই তুষ্ট থাকি। আমার শয়ন ভোজনের নিয়ম নেই, আমি সুখের অনিত্যতা উপলব্ধি ক’রে পবিত্রভাবে আত্মনিষ্ঠ হয়ে এই অজগরব্রত পালন করছি।

 যুধিষ্ঠির, কশ্যপবংশীয় এক ঋষিপুত্র কোনও বৈশ্যের রথের নীচে প’ড়ে আহত হয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি প্রাণত্যাগের সংকল্প করলেন। তখন ইন্দ্র শৃগালের রূপ ধারণ ক’রে তাঁর কাছে এসে বললেন, তুমি দুর্লভ মানবজন্ম, ব্রাহ্মণত্ব ও বেদবিদ্যা লাভ করেছ। তোমার দশ-অঙ্গুলিযক্ত দুই হস্ত আছে, তার দ্বারা সকল কর্ম করতে পার। সৌভাগ্যক্রমে তুমি শৃগাল কীট মূষিক সর্প বা ভেক হও নি, মনুষ্য এবং ব্রাহ্মণ হয়েছ; এতেই তোমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আমার অবস্থা দেখ, আমার হস্ত নেই, দংশক কীটাদি তাড়াতে পারি না; আবার আমার চেয়েও নিকৃষ্ট জীব আছে। অতএব তুমি নিজের অবস্থায় তুষ্ট হও। যিনি কামনা রোধ করতে পারেন তিনি ভয় থেকে মুক্ত হন। মানুষ যে বস্তুর রসজ্ঞ নয় তাতে তার কামনা হয় না। মদ্য ও লট্বাক (চড়াই) পক্ষীর মাংস অপেক্ষা উত্তম ভক্ষ্য কিছুই নেই, কিন্তু তুমি এই দুইএর স্বাদ জান না এজন্য তোমার কামনা নেই। অতএব ভক্ষণ স্পর্শন দর্শন দমিত করাই শ্রেয়স্কর। তুমি প্রাণবিসর্জনের সংকল্প ত্যাগ ক’রে ধর্মাচরণে উদ্‌যোগী হও। এইপ্রকার উপদেশ দিয়ে ইন্দ্র নিজ রূপ ধারণ করলেন, তখন ঋষিপুত্র দেবরাজকে পূজা ক’রে স্বগৃহে চ’লে গেলেন।

১৭। সৃষ্টিতত্ত্ব—সদাচার

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, স্থাবরজঙ্গম সমেত এই জগৎ কি থেকে সৃষ্ট হ’ল, প্রলয়কালে কিসে লয় পাবে, মৃত্যুর পরে জীব কোথায় যায়, এইসব আমাকে বলুন। ভীষ্ম বললেন, ভরদ্বাজের প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি ভৃগু যা বলেছিলেন শোন।— মানস নামে এক দেব আছেন, তিনি অনাদি অজর অমর অব্যক্ত শাশ্বত অক্ষয় অব্যয়; তাঁ হ’তেই সমস্ত জীব সৃষ্ট হয় এবং তাঁতেই লীন হয়। সেই দেবই মহৎ অহংকার আকাশ সলিল প্রভৃতির মূল কারণ। মানসদেবের সৃষ্ট পদ্ম হ’তে ব্রহ্মার উৎপত্তি। ব্রহ্মা উৎপন্ন হয়েই ‘সোঽহং’ বলেছিলেন, সেজন্য তিনি অহংকার নামে খ্যাত হয়েছেন। পর্বত মেদিনী সাগর আকাশ বায়ু, অগ্নি চন্দ্র সূর্য প্রভৃতি তাঁরই অঙ্গ। অহংকারের যিনি স্রষ্টা, সেই আত্মভূত দুর্জ্ঞেয় আদিদেবই ভগবান অনন্ত-বিষ্ণু।

 আকাশের অন্ত নেই। যে স্থান থেকে চন্দ্রসূর্যও দেখা যায় না সেখানে স্বয়ংদীপ্ত দেবগণ বিরাজ করেন। পৃথিবীর অন্তে সমুদ্র, তার পর অন্ধকার, তার পর সলিল, তার পর অগ্নি। আবার রসাতলের পর সলিল, তার পর সর্পলোক, তার পর পুনর্বার আকাশ জল প্রভৃতি। এই সকলের তত্ত্ব দেবগণেরও দুর্জ্ঞেয়।

 জীবের বিনাশ নেই, দেহ নষ্ট হ’লে জীব দেহান্তরে যায়। কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে গেলে অগ্নি যেমন অদৃশ্যভাবে আকাশ আশ্রয় করে, শরীরত্যাগের পর জীবও সেইরূপ আকাশের ন্যায় অবস্থান করে। শরীরব্যাপী অন্তরাত্মাই দর্শন শ্রবণ প্রভৃতি কার্য নির্বাহ করেন এবং সুখদুঃখ অনুভব করেন।

 সত্যই ব্রহ্ম ও তপস্যা, সত্যই প্রজাগণকে সৃষ্টি ও পালন করে। ধর্ম ও অর্থ হ’তেই সুখের উৎপত্তি হয়, যার শারীরিক ও মানসিক দুঃখ নেই সেই সুখ অনভেব করে। স্বর্গে নিত্য সুখ, ইহলোকে সুখদুঃখ দুইই আছে, নরকে কেবল দুঃখ। সুখই পরমপদার্থ।

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আমি সদাচারের বিধি শুনতে ইচ্ছা করি। ভীষ্ম বললেন, সদাচারই সাধুদের লক্ষণ, অসাধুরা দুরাচার। প্রাতঃকালে শৌচের পর দেবতাদের তর্পণ ক’রে নদীতে অবগাহন করবে। সূর্যোদয় হ’লে নিদ্রা যাবে না। সায়ংকালে ও প্রাতঃকালে পূর্ব ও পশ্চিম-মুখ হয়ে সাবিত্রীমন্ত্র জপ করবে। হস্ত পদ মুখ আর্দ্র ক’রে মৌনী হয়ে ভোজন করবে। অতিথি স্বজন ও ভৃত্যদের সঙ্গে সমানভাবে ভোজন করাই প্রশংসনীয়। ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট জননীর হৃদয়ের ন্যায় অমৃততুল্য। যিনি মাংসভক্ষণ ত্যাগ করেছেন তিনি যজ্ঞে সংস্কৃত মাংসও খাবেন না। উদীয়মান সূর্য এবং নগ্না পরস্ত্রীকে দেখবে না। সূর্যের অভিমুখে মূত্রত্যাগ নিজের পুরীষ দর্শন এবং স্ত্রীলোকের সঙ্গে একত্র শয়ন ও ভোজন করবে না। জ্যেষ্ঠদের ‘তুমি’ বলবে না।

 তার পর যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে ভীষ্ম অধ্যাত্মযোগ, ধ্যানযোগ, জপানুষ্ঠান ও জ্ঞানযোগ সম্বন্ধে সবিস্তারে বললেন।

১৮। বরাহরূপী বিষ্ণু—যজ্ঞে অহিংসা—প্রাণদণ্ডের নিন্দা

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, কৃষ্ণ তির্যগ্‌যোনিতে বরাহরূপে কেন জন্মেছিলেন তা শুনতে ইচ্ছা করি। ভীষ্ম বললেন, পুরাকালে নরক প্রভৃতি বলদর্পিত অসুরগণ দেবগণের সমৃদ্ধি দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিল। তাদের উৎপীড়নে বসুমতী ভারাক্রান্ত ও কাতর হলেন। তখন ব্রহ্মা দেবগণকে আশ্বাস দিলেন যে বিষ্ণু দানবগণকে সংহার করবেন। তার পর মহাতেজা বিষ্ণু বরাহের মূর্তি ধারণ ক’রে ভূগর্ভে গিয়ে দানবদের প্রতি ধাবিত হলেন। তাঁর নিনাদে ত্রিলোক বিক্ষুব্ধ হ’ল, দানবগণ বিষ্ণুতেজে মোহিত ও গতাসু হয়ে পতিত হ’ল। মহর্ষিগণ স্তব করলে বরাহরূপী বিষ্ণু রসাতল থেকে উত্থিত হলেন। সেই মহাযোগী ভূতভাবন পদ্মনাভ বিষ্ণুর প্রভাবে সকলের ভয় ও শোক দূর হয়েছিল।

 তার পর যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম বিবিধ দার্শনিক তত্ত্ব বিবৃত ক’রে অহিংসা সম্বন্ধে এই উপদেশ দিলেন।—পুরাকালে রাজা বিচখ্যু গোমেধযজ্ঞে নিহত বৃষের দেহ দেখে এবং গোসকলের আর্তনাদ শুনে কাতর হয়ে এই আশীর্বাদ করেছিলেন — গোজাতির স্বস্তি হ’ক। যারা মূঢ় ও সংশয়গ্রস্ত নাস্তিক তারাই যজ্ঞে পশুবধের প্রশংসা করে। ধর্মাত্মা মনু সকল কর্মে অহিংসারই উপদেশ দিয়েছেন। সর্বভূতে অহিংসাই সকল ধর্মের শ্রেষ্ঠ গণ্য হয়। ধূর্তেরাই সুরা মৎস্য মাংস মধু ও কৃশরান্ন ভোজন প্রবর্তিত করেছে, বেদে এসকলের বিধান নেই। সকল যজ্ঞেই বিষ্ণুর অধিষ্ঠান জেনে ব্রাহ্মণগণ পায়স ও পুষ্প দ্বারাই অর্চনা করেন। শুদ্ধস্বভাব মহাত্মাদের মতে যা কিছু উত্তম গণ্য হয় তাই দেবতাকে নিবেদন করা যেতে পারে।


 যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও লোককে বধদণ্ড না দিয়েও রাজা কোন্ উপায়ে প্রজাশাসন করতে পারেন? ভীষ্ম বললেন, আমি এক পুরাতন ইতিহাস বলছি শোন।— দ্যুমৎসেনের আজ্ঞায় বধদণ্ডের যোগ্য কয়েকজন অপরাধীকে সত্যবানের নিকট আনা হ’লে সত্যবান বললেন, পিতা, অবস্থাবিশেষে ধর্ম অধর্মরূপে এবং অধর্ম ধর্মরূপে গণ্য হয়, কিন্তু বধ কখনই ধর্ম হ’তে পারে না। দ্যুমৎসেন বললেন, দস্যুদের বধ না করলে নানা দোষ ঘটে; দুষ্টের দমনের নিমিত্ত বধদণ্ড আবশ্যক, নতুবা ধর্মরক্ষা হয় না। অন্য উপায় যদি তোমার জানা থাকে তো বল।

 সত্যবান বললেন, ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্রকে ব্রাহণের অধীন করা কর্তব্য। কেউ যদি ব্রাহ্মণের বাক্য না শোনে তবে ব্রাহ্মণ রাজাকে জানাবেন, তখন রাজা তাকে দণ্ড দেবেন। অপরাধীর কর্ম নীতিশাস্ত্র অনুসারে বিচার না ক’রে বধদণ্ড দেওয়া অন্যায়। একজনকে বধ করলে তার পিতা মাতা পত্নী পুত্র প্রভৃতিরও প্রাণসংশয় হয়। অসাধুলোকেও পরে সচ্চরিত্র হতে পারে, অসাধুরও সাধু সন্তান হ’তে পারে, অতএব সমূলে সংহার করা অকর্তব্য। অপরাধের শাস্তি অন্য রূপেও হ’তে পারে, যথা ভয়প্রদর্শন, বন্ধন (কারাদণ্ড), বিরূপকরণ প্রভৃতি। অপরাধী যদি পুরোহিতের শরণাগত হয়ে বলে—আর এমন কর্ম করব না, তবে তাকে প্রথম বারে মার্জনা করাই উচিত। মান্যগণ্য লোকের প্রথম অপরাধ ক্ষমার্হ, বার বার অপরাধ দণ্ডনীয়।

 দ্যুমৎসেন বললেন, পূর্বে লোকেরা সুশাস্য সত্যনিষ্ঠ ও মৃদুস্বভাব ছিল, ধিক্‌কারেই তাদের যথেষ্ট দণ্ড হ’ত। তার পর বাগ্‌দণ্ড (তিরস্কার) ও অর্থদণ্ড প্রচলিত হয়, সম্প্রতি বধদণ্ড প্রবর্তিত হয়েছে। এখন অপরাধীকে বধদণ্ড দিয়েও অন্যান্য লোককে দমন করা যায় না। কথিত আছে, দস্যু কারও আত্মীয় নয়, তার সঙ্গে কোনও লোকের সম্বন্ধ নেই। যারা শ্মশান থেকে শবের বস্ত্রাদি এবং ভূতাবিষ্ট লোকের ধন হরণ করে, শপথ করিয়ে তাদের শাসন করা যায় না।

 সত্যবান বললেন, যদি অহিংস উপায়ে অসাধুকে সাধন করা অসাধ্য হয় তবে যজ্ঞ দ্বারা তাদের সংহার করুন। কিন্তু যদি ভয় দেখিয়ে শাসন করা সম্ভবপর হয় তবে ইচ্ছাপূর্বক বধ করা অকর্তব্য। রাজা সদাচারী হ’লে প্রজাও সেইরূপ হয়, শ্রেষ্ঠ লোকে যেমন আচরণ করেন ইতর লোকে তারই অনুসরণ করে। যে রাজা নিজেকে সংযত না ক’রে অন্যকে শাসন করতে যান তাঁকে লোকে উপহাস করে। নিজের বন্ধু ও আত্মীয়কেও কঠোর দণ্ড দিয়ে শাসন করা উচিত। আয়ু শক্তি ও কাল বিচার ক’রে রাজা দণ্ডবিধান করবেন। জীবগণের প্রতি অনুকম্পা ক’রে স্বায়ম্ভুব মনু বলেছেন, যিনি সত্যার্থী (ব্রহ্মলোভেচ্ছু) তিনি মহৎ কর্মের ফল কদাচ ত্যাগ করবেন না।

১৯। বিষয়তৃষ্ণা — বিষ্ণুর মাহাত্ম্য —জ্বরের উৎপত্তি

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আমরা অতি পাপী ও নিষ্ঠুর, অর্থের নিমিত্ত আত্মীয়গণকে সংহার করেছি। যাতে অর্থতৃষ্ণা নিবৃত্ত হয় তার উপায় বলুন।

 ভীষ্ম বললেন, তত্ত্বজিজ্ঞাসু মাণ্ডব্যকে বিদেহবাজ জনক এই কথা বলেছিলেন।—আমার কিছুই নেই, তথাপি সুখে জীবনযাপন করি। মিথিলা দগ্ধ হয়ে গেলেও আমার কিছু নষ্ট হয় না। সকল সমৃদ্ধিই দুঃখের কারণ। সমস্ত ঐহিক সুখ এবং স্বর্গীয় সুখে তৃষ্ণাক্ষয়জনিত সুখের ষোড়শাংশের একাংশও নয়। বৃষের দেহবৃদ্ধির সঙ্গে যেমন তার শক্তিও বৃদ্ধি পায়, সেইরূপ ধনবৃদ্ধির সঙ্গে বিষয়তৃষ্ণাও বর্ধিত হয়। সামান্য বস্তুতেও যদি মমতা হয় তবে তা নষ্ট হ’লে দুঃখ হয়; অতএর কামনা ত্যাগ করাই উচিত। জ্ঞানী লোকে সর্বভূতকে আপনার তুল্য মনে করেন এবং কৃতকৃত্য ও বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে সবই ত্যাগ করতে পারেন। মন্দবুদ্ধি লোকের পক্ষে যা ত্যাগ করা দুঃসাধ্য, দেহ জীর্ণ হ’লেও যা জীর্ণ হয় না, যা আমরণস্থায়ী রোগের তুল্য, সেই বিষয়তৃষ্ণাকে যিনি ত্যাগ করেন তিনিই সুখী হন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, লোকে আমাদের ধন্য ধন্য বলে, কিন্তু আমাদের চেয়ে দুঃখী কেউ নেই। কবে আমরা রাজ্য ত্যাগ ক’রে সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করতে পারব যাতে সকল দঃখের অবসান হবে?

 ভীষ্ম বললেন, মহারাজ, ঐশ্বর্যকে দোষজনক মনে করো না। তোমরা ধর্মজ্ঞ, ঐশ্বর্য সত্ত্বেও শমদমাদি সাধন দ্বারা যথাকালে মোক্ষলাভ করবে। উদ্‌যোগী পুরুষের অবশ্যই ব্রহ্মলাভ হয়। পুরাকালে দৈত্যরাজ বৃত্র যখন নির্জিত রাজ্যহীন ও অসহায় হয়ে শত্রুগণের মধ্যে অবস্থান করছিলেন তখন শুত্রুাচার্য তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দানব, তুমি পরাজিত হয়েছ কিন্তু দুঃখিত হও নি কেন? বৃত্র বললেন, আমি সংসার ও মোক্ষের তত্ত্ব জানি সেজন্য আমার শোক বা হর্ষ হয় না। পূর্বে আমি ত্রিলোক জয় করেছিলাম, তপস্যা দ্বারা ঐশ্বর্য লাভ করেছিলাম, কিন্তু আমার কর্মদোষে সব নষ্ট হয়েছে। এখন আমি ধৈর্য অবলম্বন ক’রে শোকহীন হয়েছি। ইন্দ্রের সহিত যুদ্ধের সময় আমি ভগবান হরিনারায়ণ সনাতন বিষ্ণুকে দেখেছিলাম, যাঁর কেশ মুঞ্জতৃণের ন্যায় পীতবর্ণ, শ্মশ্রু পিঙ্গলবর্ণ, যিনি সর্বভূতের পিতামহ। আমার সেই পুণ্যের ফল এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে, তারই প্রভাবে আপনাকে প্রশ্ন করছি — ব্রহ্ম কোথায় অবস্থান করেন? জীব কি প্রকারে ব্রহ্মত্ব লাভ করে?

 এই সময়ে মহামুনি সনৎকুমার সেখানে উপস্থিত হলেন। শুক্র তাঁকে বললেন, আপনি এই দানবরাজের নিকট বিষ্ণুর মাহাত্ম্য কীর্তন করুন। সনৎকুমার বললেন, মহাবাহু, এই জগং বিষ্ণুতেই অবস্থান করছে, তিনিই সমস্ত সৃষ্টি এবং লয় করেন। তপস্যা ও যজ্ঞ দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায় না; যিনি ইন্দ্রিয়সংযম ও চিত্তশোধন করেছেন, যাঁর বুদ্ধি নির্মল হয়েছে, তিনিই পরলোকে মোক্ষলাভ করেন। স্বর্ণকার যেমন বহুবার অগ্নিতে নিক্ষেপ ক’রে অতি যত্নে স্বর্ণ শোধন করে, জীবও সেইরূপ বহুবার জন্মগ্রহণ ক’রে কর্ম দ্বারা বিশুদ্ধি লাভ করে। যেমন অল্প পুষ্পের সংস্পর্শে তিলসর্ষপাদি নিজ গন্ধ ত্যাগ করে না, কিন্তু বার বার বহু পুষ্পের সংস্পর্শে নিজ গন্ধ থেকে মুক্ত হয়ে পুষ্পগন্ধে বাসিত হয়, সেইরূপ বহুবার জন্মগ্রহণ ক’রে মানুষ আসক্তিজনিত দোষ থেকে মুক্ত হয়। যাঁর চিত্ত শুদ্ধ হয়েছে তিনি মন দ্বারা অনুসন্ধান ক’রে চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার এবং অক্ষয় মোক্ষপদ লাভ করেন।

 সনৎকুমারের উপদেশ শোনার পর দানবরাজ বৃত্র যোগস্থ হয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে পরমগতি লাভ করলেন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, সনৎকুমার যাঁর কথা বলেছিলেন, এই জনার্দন কৃষ্ণই কি সেই ভগবান? ভীষ্ম বললেন, এই মহাত্মা কেশব সেই পরমপুরুষের অষ্টমাংশ। ইনিই জগতের স্রষ্টা এবং প্রলয়কালে সমস্ত বিনষ্ট হ’লে ইনিই পুনর্বার জগৎ সৃষ্টি করেন; এই বিচিত্র বিশ্ব এঁতেই অবস্থান করছে। ধর্মরাজ, তোমরা শুদ্ধ ও উচ্চ বংশে জন্মেছ, ব্রতপালনও করেছ। মৃত্যুর পরে তোমরা দেবলোকে যাবে, তার পর আবার মর্ত্যলোকে আসবে; পুনর্বার দেবলোকে সুখভোগ ক’রে সিদ্ধগণের পদ লাভ করবে। তোমাদের ভয় নেই, সকলে সুখে কলযাপন কর।

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, বৃত্র ধার্মিক ও বিষ্ণুভক্ত ছিলেন, তিনি ইন্দ্র কর্তৃক নিহত হলেন কি ক’রে? ভীষ্ম বললেন, যুদ্ধকালে বৃত্রের অতি বিশাল মূর্তি দেখে ভয়ে ইন্দ্রের ঊরুস্তম্ভ হয়েছিল। তিনি বৃত্র কর্তৃক নিপীড়িত হয়ে মূর্ছিত হ’লে বশিষ্ট তাঁর চৈতন্য সম্পাদন করলেন। তার পর ইন্দ্রাদি দেবগণ ও মহর্ষিগণ বৃত্রবধের জন্য মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। মহাদেব ইন্দ্রের দেহে নিজের তেজ এবং বৃত্রের দেহে জ্বররোগ সংক্রামিত ক’রে বললেন, দেবরাজ, এখন তুমি বজ্র দ্বারা তোমার শত্রুকে বধ কর। তখন ইন্দ্র বজ্রপ্রহার ক’রে বৃত্রকে পাতিত করলেন। মহাদেব যখন দক্ষযজ্ঞ নষ্ট করছিলেন তখন তাঁর ঘর্মবিন্দু থেকে একটি পুরুষ উৎপন্ন হয়েছিল, তারই নাম জ্বর। ব্রহ্মার অনুরোধে মহাদেব জ্বরকে নানাপ্রকারে বিভক্ত করেছিলেন। হস্তিমস্তকের তাপ, পর্বতের শিলাজতু, জলের শৈবাল, ভুজঙ্গের নির্মোক, গোজাতির খুররোগ, ভূমির ঊষরতা, পশার দৃষ্টিরোধ, অশ্বের গলরোগ, ময়ূরের শিখোদ্‌ভেদ, কোকিলের নেত্ররোগ, মেষের পিত্তভেদ, শুকের হিক্কা, এবং শার্দূলের শ্রম, এই সকলকে জ্বর বলা হয়।

২০। দক্ষযজ্ঞ

 মহাভারতবক্তা বৈশম্পায়নকে জনমেজয় বললেন, মহর্ষি, বৈবস্বত মন্বন্তরে প্রচেতার পুত্র প্রজাপতি দক্ষের অশ্বমেধ যজ্ঞ কিরূপে নষ্ট এবং পুনর্বার অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা আপনি বলুন।

 বৈশম্পায়ন বললেন, পুরাকালে হিমালয় পর্বতের পৃষ্ঠে পবিত্র গঙ্গাদ্বারে দক্ষ প্রজাপতি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেই যজ্ঞে দেব দানব গন্ধর্ব, আদিত্যগণ বসুগণ রুদ্রগণ প্রভৃতি, ইন্দ্রাদি দেবগণ, এবং ব্রহ্মার সহিত ঋষিগণ ও পিতৃগণ আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। জরায়ুজ অণ্ডজ বেদজ ও উদ্ভিজ্জ এই চতুর্বিধ জীবও সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। সমাগত সকলকে দেখে দধীচি মুনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, যে অনুষ্ঠানে মহেশ্বর রুদ্র পূজিত হন না তা যজ্ঞও নয় ধর্মও নয়। ঘোর বিপদ আসন্ন হয়েছে, মোহবশে তা কেউ বুঝতে পারছে না। এই ব’লে মহাযোগী দধীচি ধ্যাননেত্রে হরপার্বতী এবং তাঁদের নিকটে উপবিষ্ট নারদকে দেখলেন। দধীচি বুঝলেন, সকলে একযোগে মন্ত্রণা ক’রে মহাদেবকে নিমন্ত্রণ করেন নি। তখন তিনি যজ্ঞস্থান থেকে স’রে গিয়ে বললেন, যে লোক অপূজ্যের পূজা করে এবং পূজ্যের পূজা করে না সে নরহত্যার সমান পাপ করে। আমি সত্য বলছি, এই যজ্ঞে জগৎপতি যজ্ঞভোক্তা পশুপতি আসছেন, তোমরা সকলেই দেখতে পাবে।

 দক্ষ বললেন, এখানে শূলপাণি জটাজূটধারী একাদশ রুদ্র উপস্থিত রয়েছেন, আমি মহেশ্বর রুদ্রকে চিনি না। দধীচি বললেন, তোমরা সকলে মন্ত্রণা ক’রেই তাঁকে বর্জন করেছ। শংকর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দেবতা আমি জানি না। তোমার এই বিপুল যজ্ঞ পণ্ড হবে। দক্ষ বললেন, যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণুই যজ্ঞভাগ গ্রহণের অধিকারী; আমি এই সুবর্ণ পাত্রে রক্ষিত মন্ত্রপূত হবি তাঁকেই নিবেদন করব।

 এই সময়ে কৈলাসশিখরে দেবী ভগবতী ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, আমি কিরূপ দান ব্রত বা তপস্যা করব যার ফলে আমার পতি যজ্ঞের অর্ধ বা একতৃতীয় ভাগ পেতে পারেন? মহাদেব বললেন, দেবী, তুমি কি আমাকে জান না? তোমার মোহের জন্যই ইন্দ্রাদি দেবগণ এবং ত্রিলোক মোহাবিষ্ট হয়েছে। সকল যজ্ঞে আমারই স্তব করা হয়, আমার উদ্দেশেই সামগান হয়, ব্রহ্মবিৎ ব্রাহ্মণগণ আমারই অর্চনা করেন, অধুর্যুগণ আমাকেই যজ্ঞভাগ দেন। দেবী বললেন, অতি প্রাকৃত (অশিক্ষিত গ্রাম্য) লোকেও স্ত্রীলোকের কাছে নিজের প্রশংসা ও গর্ব করে। মহাদেব বললেন, আমি আত্মপ্রশংসা করছি না, যজ্ঞের জন্য আমি যা সৃষ্টি করছি দেখ। এই ব’লে মহাদেব তাঁর মুখ থেকে এক ঘোরদর্শন রোমহর্ষকর পুরুষ সৃষ্টি করলেন; তাঁর মুখ অতি ভয়ংকর, শরীর অগ্নিশিখায় ব্যাপ্ত, বহু হস্তে বহু আয়ুধ। বীরভদ্র নামক এই পুরুষ কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, কি আজ্ঞা করছেন? মহেশ্বর বললেন, দক্ষের যজ্ঞ ধ্বংস কর।

 বীরভদ্র তাঁর রোমকূপ থেকে রৌম্য নামক রূদ্রতুল্য অসংখ্য গণদেবতা সৃষ্টি ক’রে তাদের নিয়ে যজ্ঞস্থলে যাত্রা করলেন। মহেশ্বরীও ভীমরূপা মহাকালীর মূর্তি ধারণ করে বীরভদ্রের অনগমন করলেন। এঁরা যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হ’লে দেবগণ ত্রস্ত হলেন, পর্বত বিদীর্ণ ও বসুন্ধরা কম্পিত হ’ল, বায়ু ঘূর্ণিত এবং সমূদ্র বিক্ষুব্ধ হ’তে লাগল, সমস্ত জগৎ তিমিরাচ্ছন্ন হ’ল। বীরভদ্রের অনুচরগণ যজ্ঞের সমস্ত উপকরণ চূর্ণ উৎপাটিত ও দগ্ধ ক’রে সকলকে প্রহার করতে লাগল। তারা অন্ন মাংস পায়স প্রভৃতি খেয়ে ও নষ্ট ক’রে, দেবসৈন্যগণকে ভয় দেখিয়ে হতবুদ্ধি ক’রে, এবং সুরনারীদের ছুড়ে ফেলে দিয়ে খেলা করতে লাগল। রুদ্রকর্মা বীরভদ্র যজ্ঞস্থল দগ্ধ এবং যজ্ঞের[১] শিরশ্ছেদন ক’রে ঘোর সিংহনাদ করলেন।

 ব্রহ্মাদি দেবগণ ও প্রজাপতি দক্ষ কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, আপনি কে? বীরভদ্র উত্তর দিলেন, আমি রুদ্র নই, ইনিও দেবী ভগবতী নন; আমরা ভোজনের জন্য বা তোমাদের দেখতে এখানে আসি নি, এই যজ্ঞ নষ্ট করতেই এসেছি। ভগবতীকে ক্ষুব্ধ দেখে মহাদেব ক্রুদ্ধ হয়েছেন। আমি রুদ্রকোপে উৎপন্ন বীরভদ্র, ইনি ভগতীর কোপ হ’তে বিনিঃসৃত ভদ্রকালী। দক্ষ, তুমি দেবদেব উমাপতির শরণ নাও; অন্য দেবতার নিকট বরলাভ অপেক্ষা মহাদেবের ক্রোধে পড়াও ভাল।

 দক্ষ প্রণিপাত ক’রে মহেশ্বরের স্তব করতে লাগলেন। তখন সহস্র সূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান মহাদেব অগ্নিকুণ্ড থেকে উত্থিত হয়ে সহাস্যমুখে দক্ষকে বললেন, বল, কি চাও। দক্ষ ভয়ে আকুল হয়ে সাশ্রুনয়নে বললেন, ভগবান, এই যজ্ঞের জন্য বহু যত্নে আমি যেসকল উপকরণ সংগ্রহ করেছিলাম তা দগ্ধ ভক্ষিত ও নাশিত হয়েছে; যদি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে এই বর দিন আমার যজ্ঞ যেন নিষ্ফল না হয়। ভগবান বিরূপাক্ষ বললেন, তথাস্তু। তখন দক্ষ নতজানু হয়ে অষ্টোত্তর সহস্র নাম পাঠ ক’রে ভগবান কৃষভধ্বজের স্তব করলেন।

২১। আসক্তিত্যাগ—শুক্রের ইতিহাস

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আমার ন্যায় রাজারা কিরূপে আসক্তি থেকে মুক্ত হ’তে পারেন তা বলুন। ভীষ্ম বললেন, সগরের প্রশ্নের উত্তরে অরিষ্টনেমি যা বলেছিলেন শোন।—মোক্ষসুখই প্রকৃত সুখ, স্নেহপাশে বদ্ধ মূঢ় লোকে তা বুঝতে পারে না। যখন দেখবে যে পুত্রেরা যৌবন পেয়েছে এবং জীবিকানির্বাহে সমর্থ হয়েছে তখন তাদের বিবাহ দেবে, এবং নিজে সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যথাসুখে বিচরণ করবে। পুত্রবৎসলা বৃদ্ধা ভার্যাকেও গৃহে রেখে মোক্ষের অন্বেষণে যত্নবান হবে। পুত্র থাকুক বা না থাকুক, প্রথমে যথাবিধি ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার পর সংসার ত্যাগ ক’রে নিস্পৃহ হয়ে বিচরণ করবে। যদি মোক্ষের অভিলাষ থাকে তবে আমার অভাবে পরিবারবর্গ কি করে জীবিকানির্বাহ করবে — এমন চিন্তা করবে না। জীব স্বয়ং উৎপন্ন হয়, স্বয়ং বর্ধিত হয়, এবং স্বয়ং সুখদুঃখ ভোগ ক’রে পরিশেষে মৃত্যুর কবলে পড়ে! সকল জীবই পূর্বজন্মের কর্ম অনুসারে বিধাতা কর্তৃক বিহিত ভক্ষ্য লাভ করে। মানুষ মৃৎপিণ্ডের তুল্য এবং সর্বদা পরতন্ত্র, তার পক্ষে স্বজনপোষণের চিন্তা করা বৃথা। মরণের পর তুমি স্বজনের সুখদুঃখ কিছুই জানতে পারবে না; তোমার জীবদ্দশায় এবং তোমার মরণের পর তারা স্বকর্ম অনুসারে সুখদুঃখ ভোগ করবে, এই বুঝে তুমি নিজের হিতের চেষ্টা কর। জঠরাগ্লিই ভোক্তা এবং ভোজ্য অন্ন সোম স্বরূপ এই জ্ঞান যাঁর হয়, এবং যিনি নিজেকে এই দুই হ’তে স্বতন্ত্র মনে করেন, যিনি সুখদুঃখে লাভালাভে জয়পরাজয়ে সমবুদ্ধি, যিনি জানেন যে ইহলোকে অর্থ দুর্লভ এবং ক্লেশই সুলভ, তিনিই মুক্তিলাভ করেন।


 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, দেবর্ষি উশনা (শত্রু) কেন দেবতাদের বিপক্ষে থেকে অসুরদের প্রিয়সাধন করতেন, তাঁর শুক্র নাম কেন হ’ল, তিনি (গ্রহরূপে) আকাশের মধ্যদেশে যেতে পারেন না কেন, এইসকল বিবৃত ক’রে আপনি আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করুন। ভীষ্ম বললেন, বিষ্ণু শুক্রের মাতা[২] কে বধ করেছিলেন সেজন্য শুক্র দেবদ্বেষী হন। একদিন তিনি যোগবলে কুবেরকে বন্ধ ক’রে তাঁর সমস্ত ধন হরণ করলেন। কুবেরের অভিযোগ শুনে মহাদেব শূলহস্তে শুক্রকে মারতে এলেন, তখন শুক্র শূলের অগ্রভাগে আশ্রয় নিলেন। মহাদেব শুক্রকে ধ’রে মুখে পুরে গ্রাস ক’রে ফেললেন। তার পর তিনি মহাহ্রদের জলমধ্যে দশ কোটি বৎসর তপস্যা করলেন, তাঁর জঠরে থাকায় শুক্রেরও উৎকর্ষলাভ হ’ল। মহাদেব জল থেকে উঠলে শুক্র বহির্গত হবার জন্য বার বার প্রার্থনা করলেন, অবশেষে মহাদেব বললেন, তুমি আমার শিশ্ন দিয়ে নির্গত হও। শিশ্নপথে নির্গত হওয়ায় উশনার নাম শুক্র হ’ল এবং তিনি আকাশের মধ্যস্থলে যেতে অসমর্থ হলেন। শুক্রকে দেখে মহাদেব ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর শূল উদ্যত করলেন। তখন ভগবতী বললেন, শুক্র এখন আমার পুত্র হ’ল, তোমার উদর থেকে যে বহির্গত হয়েছে সে বিনষ্ট হ’তে পারে না। মহাদেব সহাস্যে বললেন, শুক্র যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন।

২২। সুলভা-জনক সংবাদ

 যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম সাংখ্য যোগ গৃহস্থাশ্রম তপস্যা প্রভৃতি সম্বন্ধে বহু উপদেশ দিয়ে সুলভা ও জনকের এই প্রাচীন ইতিহাস বললেন। — সত্যযুগে মিথিলায় জনক[৩] নামে এক রাজা ছিলেন, তাঁর অন্য নাম ধর্মধ্বজ। তিনি সন্ন্যাসধর্ম মোক্ষশাস্ত্র ও দণ্ডনীতিতে অভিজ্ঞ ছিলেন এবং জিতেন্দ্রিয় হয়ে রাজ্যশাসন করতেন। সুলভা নামে এক ভিক্ষুকী (সন্ন্যাসিনী) রাজর্ষি জনকের খ্যাতি শুনে তাঁকে পরীক্ষা করবার সংকল্প করলেন এবং যোগবলে মনোহর রূপ ধারণ ক’রে মিথিলার রাজসভায় উপস্থিত হলেন। তাঁর সৌন্দর্য দেখে রাজা বিস্মিত হলেন এবং পাদ্য অর্ঘ্য আসন ভোজ্য প্রভৃতি দিয়ে সংবর্ধনা করলেন। তার পর সুলভা যোগবলে নিজের সত্ত্ব বুদ্ধি ও চক্ষু জনকের সত্ত্ব বুদ্ধি ও চক্ষুতে সন্নিবিষ্ট করলেন[৪]

 সুলভার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে জনক তাঁকে নিজের মনোমধ্যে গ্রহণ ক’রে সহাস্যে বললেন, দেবী, তুমি কার কন্যা, কোথা থেকে এসেছ? তোমার সম্মানের জন্য আমি নিজের তত্ত্বজ্ঞানলাভের বিষয় বলছি শোন। বৃদ্ধ মহাত্মা পঞ্চশিখ আমার গুরু, তাঁর কাছেই আমি সাংখ্য যোগ ও রাজধর্ম এই ত্রিবিধ মোক্ষতত্ত্ব শিখেছি। আসক্তি মোহ ও সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হয়ে আমি পরমবুদ্ধি লাভ করেছি। যদি একজন আমার দক্ষিণ বাহুতে চন্দন লেপন করে এবং অপর একজন আমার বাম বাহু ছেদন করে তবে দুজনকেই আমি সমদৃষ্টিতে দেখব। নিঃস্ব হ’লেই মোক্ষলাভ হয় না, ধনী হ’লেও হয় না, জ্ঞান দ্বারাই মোক্ষলাভ হয়। সন্ন্যাসিনী, তোমাকে সুকুমারী সুন্দরী ও যুবতী দেখছি, তুমি যোগসিদ্ধ কিনা সে বিষয়ে আমার সংশয় হচ্ছে। কার সাহায্যে তুমি আমার রাজ্যে ও রাজভবনে এসেছ, কোন্ উপায়ে আমার হৃদয়ে প্রবেশ করেছ? তুমি ব্রাহ্মণী, আমি ক্ষত্রিয়; তুমি সন্ন্যাসিনী হয়ে মোক্ষের অন্বেষণ করছ, আমি গৃহস্থাশ্রমে আছি; আমাদের মিলন হ’তে পারে না। যদি তোমার পতি জীবিত থাকেন তবে আমার পক্ষে তুমি অগম্যা পরপত্নী। তুমি আমাকে পরাজিত ক’রে নিজের উন্নতি করতে চাচ্ছ। স্ত্রী-পুরুষের যদি পরস্পরের প্রতি অনুরাগ থাকে তবেই তাদের মিলন অমৃততুল্য হয়, নতুবা তা বিষতুল্য। অতএব আমাকে ত্যাগ করে তোমার সন্ন্যাসধর্ম পালন কর।

 জনকের কথায় বিচলিত না হয়ে সুলভা বললেন, মহারাজ, যেমন কাষ্ঠের সঙ্গে লাক্ষা এবং ধূলির সঙ্গে জলবিন্দু, সেইরূপ শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয় প্রাণীর সহিত সংশ্লিষ্ট থাকে। চক্ষু প্রভৃতি ইন্দ্রিয়কে কেউ পরিচয় জিজ্ঞাসা করে না, ইন্দ্রিয়গণেরও নিজের সম্বন্ধে জ্ঞান নেই। চক্ষু নিজেকে দেখে না, কর্ণ নিজেকে শোনে না, একত্র হ’লেও পরস্পরকে জানতে পারে না। তুমি যদি নিজেকে এবং অন্যকে সমান জ্ঞান কর তবে আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করছ কেন? এই বস্তু আমার, এই বস্তু আমার নয় — এই দ্বন্দ্ব থেকে তুমি যদি মুক্ত হয়ে থাক, তবে তোমার প্রশ্ন নিরর্থক। তুমি মোক্ষের অধিকারী না হয়েই নিজেকে মুক্ত মনে কর। কুপথ্যভোজীর যেমন ঔষধসেবন, সমদৃষ্টিহীন লোকের মোক্ষের অভিমান সেইরূপ বৃথা। তুমি যদি জীবন্মুক্ত হও তবে আমার সংস্পর্শে তোমার কি অপকার হবে? পদ্মপত্রে জলের ন্যায় আমি নির্লিপ্তভাবে তোমার দেহে আছি; এতে যদি তোমার স্পর্শজ্ঞান হয় তবে পঞ্চশিখের উপদেশ বৃথা হয়েছে। আমি তোমার সজাতি, রাজর্ষি প্রধানের বংশে আমি জন্মেছি, আমার নাম সুলভা। যোগ্য পতি না পাওয়ায় আমি মোক্ষধর্মের সন্ধানে সন্ন্যাসিনী হয়েছি, সেই ধর্ম জানবার জন্যই তোমার কাছে এসেছি। নগরমধ্যে শূন্য গৃহ পেলে ভিক্ষুক যেমন সেখানে রাত্রিযাপন করে, সেইরূপ আমি তোমার শরীরে এক রাত্রি বাস করব। মিথিলারাজ, তোমার কাছে আমি সম্মান ও আতিথ্য পেয়েছি; তোমার শরীরের মধ্যে এক রাত্রি শয়ন ক’রে কাল আমি প্রস্থান করব।

 সুলভার যুক্তিসম্মত ও অর্থযুক্ত বাক্য শুনে জনক রাজা উত্তর না দিয়ে নীরবে রইলেন।

২৩। ব্যাসপুত্র শুক—নারদের উপদেশ

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, ব্যাসের পুত্র ধর্মাত্মা শুক কিপ্রকারে জন্মগ্রহণ ও সিদ্ধিলাভ করেছিলেন তা বলুন। ভীষ্ম বললেন, পুরাকালে মহাদেব ও শৈলরাজসূতা ভবানী ভীমদর্শন ভূতগণে পরিবেষ্টিত হয়ে সুমেরুর শঙ্গে বিহার করতেন। ব্যাসদেব পুত্রকামনায় সেখানে তপস্যায় রত হয়ে মহাদেবের আরাধনা করতে লাগলেন। মহেশ্বর প্রসন্ন হয়ে বললেন, দ্বৈপায়ন, তুমি অগ্নি বায়ু জল ভূমি ও আকাশের ন্যায় পবিত্র পুত্র লাভ করবে, সে ব্রহ্মপরায়ণ হয়ে নিজ তেজে ত্রিলোক আবরণ ক’রে যশম্বী হবে।

 বরলাভ ক’রে ব্যাস অগ্নি উৎপাদনের জন্য দুই খণ্ড অরণি কাঠ নিয়ে মন্থন করতে লাগলেন। সেই সময়ে ঘৃতাচী অপ্সরাকে দেখে ব্যাস কামাবিষ্ট হলেন। তখন ঘৃতাচী শুক পক্ষিণীর রূপ ধারণ করলেন। ব্যাস মনঃসংযম করতে পারলেন না, তাঁর শুত্রু অরণিকাষ্ঠের উপর স্থলিত হ’ল; তথাপি তিনি মন্থন করতে লাগলেন। সেই অরণিতে শুকদেব জন্মগ্রহণ করলেন। শুক্রের মন্থনে উৎপন্ন এজন্য তাঁর নাম শুক হ’ল। তখন গঙ্গা মূর্তিমতী হয়ে সামের শিখরে এসে শিশুকে স্নান করালেন, শুকের জন্য আকাশ থেকে ব্রহ্মচারীর ধারণীয় দণ্ড ও কৃষ্ণাজিন পতিত হ’ল এবং দিব্য বাদ্যধ্বনি ও গন্ধর্ব-অপ্সরাদের নৃত্যগীত হ’তে লাগল। মহাদেব ভগবতীর সঙ্গে এসে সদ্যোজাত মুনিপুত্রের উপনয়ন সংস্কার করলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে কমণ্ডলু ও দিব্যবস্ত্র দিলেন। বহু সহস্র হংস, শতপত্র (কাঠঠোকরা), সারস, শুক, চাষ (নীলকণ্ঠ) প্রভৃতি শুভসচক পক্ষী বালককে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। জন্মমাত্র সমস্ত বেদ শুকের আয়ত্ত হ’ল। তিনি বৃহস্পতির নিকট সকল শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেন।

 শুকদেব তাঁর পিতাকে বললেন, আপনি মোক্ষধর্মের উপদেশ দিন। ব্যাস তাঁকে নিখিল যোগ ও কাপিল (সাংখ্য) শাস্ত্র শিখিয়ে বললেন, তুমি মিথিলায় জনক রাজার কাছে যাও, তিনি তোমাকে মোক্ষধর্মের উপদেশ দেবেন। শুকদেব সুমেরুশৃঙ্গ থেকে যাত্রা করে ইলাবৃতবর্ষ হরিবর্ষ ও হৈমবতবর্ষ অতিক্রম করলেন এবং চীন হূণ প্রভৃতি দেশ দেখে ভারতবর্ষে আর্যাবর্তে এলেন। তার পর মিথিলার রাজভবনে উপস্থিত হয়ে দুই কক্ষা (মহল) অতিক্রম করে তিনি অমরাবতীতুল্য তৃতীয় কক্ষায় প্রবেশ করলেন। সেখানে পঞ্চাশ জন রূপবতী বারাঙ্গনা তাঁকে পাদ অর্ঘ্য দিয়ে পূজা ক’রে সুস্বাদু অন্ন নিবেদন করলে। জিতেন্দ্রিয় শুকদেব সেইসকল নারীগণে পরিবৃত হয়ে নির্বিকারচিত্তে এক দিবারাত্র যাপন করলেন।

 পরদিন জনক রাজা মস্তকে অর্ঘ্য ধারণ ক’রে তাঁর গুরুপুত্র শুকদেবের কাছে এলেন। যথাবিধি সংবর্ধনা ও কুশলজিজ্ঞাসার পর শুকদেবের প্রশ্নের উত্তরে জনক ব্রাহ্মণের কর্ত্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন। শুক বললেন, মহারাজ, যার মনে রাগদ্বেষাদি দ্বন্দ্ব নেই এবং শাশ্বত জ্ঞানবিজ্ঞান উৎপন্ন হয়েছে, তাকেও কি ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য ও বানপ্রস্থ এই তিন আশ্রমে বাস করতে হবে? জনক বললেন, জ্ঞানবিজ্ঞান বিনা মোক্ষ হয় না এবং গুরু উপদেশ ভিন্ন জ্ঞানলাভও হয় না। যাতে লোকাচার ও কর্মকাণ্ডের উচ্ছেদ না হয় সেজন্যই ব্রহ্মচর্যাদি চতুরাশ্রম বিহিত হয়েছে। একে একে চার আশ্রমের ধর্ম পালন ক’রে ক্রমশ শুভাশভ কর্ম ত্যাগ করলে মোক্ষলাভ হয়। কিন্তু বহু জন্মের সাধনার ফলে যাঁর চিত্তশুদ্ধি হয়েছে তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রমেই মোক্ষলাভ করেন, তাঁর অপর তিন আশ্রমের প্রয়োজন হয় না।

 তার পর জনক মোক্ষবিষয়ক বহু উপদেশ দিলেন। শুকদেব আত্মজ্ঞান লাভ ক’রে কৃতার্থ হয়ে হিমালয়ের পূর্ব দিকে তাঁর পিতার নিকট উপস্থিত হলেন। ব্যাসদেব সেখানে সুমন্ত্র বৈশম্পায়ন জৈমিনি ও পৈল এই চার শিষ্যের সঙ্গে শুকদেবকেও বেদাধ্যয়ন করাতে লাগলেন। শিক্ষা সমাপ্ত হ’লে শিষ্যগণ এই বর প্রার্থনা করলেন, ভগবান, আমরা চার জন এবং গুরুপুত্র শুক—এই পাঁচ জন ভিন্ন আর কেউ যেন বেদের প্রতিষ্ঠাতা না হয়। ব্যাসদেব সম্মত হয়ে বললেন, তোমরা উপযুক্ত শিক্ষার্থীকে উপদেশ দিয়ে বেদের বহু প্রচার কর; শিষ্য ব্রতচারী ও পুণ্যাত্মা ভিন্ন অন্য কোনও লোককে, এবং চরিত্র পরীক্ষা না ক’রে বেদশিক্ষা দান করবে না। শিষ্যগণ তুষ্ট হয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন এবং ব্যাসকে প্রণাম ক’রে প্রস্থান করলেন এবং অগ্নিহোত্রাদির মন্ত্র রচনা, যজ্ঞানুষ্ঠান ও অধ্যাপনা ক’রে বিখ্যাত হলেন।

 শিষ্যগণ চ’লে গেলে ব্যাসদেব তাঁর পুত্রের সঙ্গে নীরবে ব’সে রইলেন। সেই সময়ে নারদ এসে বললেন, হে বশিষ্ঠবংশীয় মহর্ষি, বেদধ্বনি শুনছি না কেন, তুমি নীরবে ধ্যানস্থ হয়ে রয়েছ কেন? ব্যাস বললেন, শিষ্যগণের বিচ্ছেদে আমার মন নিরানন্দ হয়েছে। নারদ বললেন, বেদের দোষ বেদপাঠ না করা, ব্রাহ্মণের দোষ ব্রত না করা, পৃথিবীর দোষ বাহীক[৫] দেশ, স্ত্রীলোকের দোষ কৌতুহল। অতএব তুমি পুত্রের সঙ্গে বেদধ্বনি কর, রাক্ষসভয় দূর হ’ক।

 নারদের বাক্যে হৃষ্ট হয়ে ব্যাসদেব তাঁর পত্রের সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে বেদপাঠ করতে লাগলেন। সেই সময়ে প্রবলবেগে বায়ু বইতে লাগল; অনধ্যায়কাল বিবেচনা ক’রে ব্যাস তাঁর পুত্রকে নিবারণ করলেন। শুকদেব তাঁর পিতাকে বললেন, এই বায়ু কোথা থেকে এল? আপনি বায়ুর বিষয় বলুন। ব্যাসদেব তখন সমান উদান ব্যান অপান ও প্রাণ এই পাঁচ বায়ুর ক্রিয়া বিবৃত ক’রে তাদের অন্য পাঁচ নাম বললেন—সংবহ উদ্‌বহ বিবহ আবহ ও প্রবহ। তিনি আরও দুই বায়ুর নাম বললেন—পরিবহ ও পরাবহ। তার পর তিনি বললেন, এই সকল বায়ু দ্বারাই মেঘের সঞ্চরণ, বিদ্যুৎপ্রকাশ, সমুদ্র হ’তে জলশোষণ, মেঘের উৎপত্তি, বারিবর্ষণ, ঝঞ্ঝা প্রভৃতি সাধিত হয়।

 বায়ুবেেগ শান্ত হ’লে ব্যাসদেব তাঁর পুত্রকে আবার বেদপাঠের অনুমতি দিয়ে গঙ্গায় স্নান করতে গেলেন। শুকদেব নারদকে বললেন, দেবর্ষি, ইহলোকে যা হিতকর আপনি তার সম্বন্ধে উপদেশ দিন। নারদ বললেন, পুরাকালে ভগবান সনৎকুমার এই বাক্য বলেছিলেন।—

নাস্তি বিদ্যাসমং চক্ষুর্নাস্তি সত্যসমং তপঃ।
নাস্তি রাগসমং দুঃখং নাস্তি ত্যাগসমং সুখম্॥
নিত্যং ক্রোধাৎ তপো রক্ষেচ্ছ্রিয়ং রক্ষেচ্চ মৎসরাৎ।
বিদ্যাং মানাপমানাভ্যামাত্মানং তু প্রমাদতঃ॥
আনৃশংসাং পরো ধর্মঃ ক্ষমা চ পরমং বলম্।
আত্মজ্ঞানং পরং জ্ঞানং ন সত্যাদ্ বিদ্যতে পরম্॥
সত্যস্য বচনং শ্রেয়ঃ সত্যাদপি হিতং বদেৎ।
যদ্‌ভূতহিতমত্যন্তমেতৎ সত্যং মতো মম॥

—বিদ্যার তুল্য চক্ষু নেই, সত্যের তুল্য তপস্যা নেই, আসক্তির তুল্য দুঃখ নেই, ত্যাগের তুল্য সুখ নেই। ক্রোধ হ’তে তপস্যাকে, পরশ্রীকাতরতা হ’তে নিজের শ্রীকে, মান-অপমান হ’তে বিদ্যাকে এবং প্রমাদ হ’তে আত্মাকে সর্বদা রক্ষা করবে। অনৃশংসতাই পরম ধর্ম, ক্ষমাই পরম বল, আত্মজ্ঞানই পরম জ্ঞান; সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কিছুই নেই। সত্যবাক্য শ্রেয়, কিন্তু সত্য অপেক্ষাও হিতবাক্য বলবে; যা প্রাণিগণের অত্যন্ত হিতকর তাই আমার মতে সত্য।—

ন হিংস্যাৎ সর্বভূতানি মৈত্রায়ণগতশ্চরেৎ।
নেদং জন্ম সমাসাদ্য বৈরং কুর্বীত কেনচিৎ॥
মৃতং বা যদি বা নষ্টং যোঽতীতমনুশোচতি।
দুঃখেন লভতে দুঃখং দ্বাবনর্থৌ প্রপদ্যতে॥
ভৈষজ্যমেতদ্ দঃখস্য যদেতন্নানুচিন্তয়েৎ।
চিন্ত্যমানং হি ন ব্যেতি ভূয়শ্চাপি প্রবর্ধতে॥

— কোনও প্রাণীর হিংসা করবে না, সকলের প্রতি মিত্রতুল্য আচরণ করবে; এই মানবজন্ম পেয়ে কারও সঙ্গে শত্রুতা করবে না। যদি কেউ মরে, বা কোনও বস্তু নষ্ট হয়, তবে সেই অতীত বিষয়ের জন্য যে শোক করে সে দুঃখ হ’তেই দুঃখ পেয়ে দ্বিগুণ অনর্থ ভোগ করে। চিন্তা না করাই দুঃখনিবারণের ঔষধ; চিন্তা করলে দুঃখ কমে না, আরও বেড়ে যায়।—

ব্যাধিভিমর্থ্যমানাং ত্যজতাং বিপুলং ধনম।
বেদনাং নাপকর্ষন্তি যতমানাশ্চিকিৎসকাঃ॥
তে চাতিনিপণা বৈদ্যাঃ কুশলাঃ সম্ভৃতৌষধাঃ।
ব্যাধিভিঃ পরিকৃষ্যন্তে মৃগা ব্যাধৈরিবাদির্তাঃ॥
কে বা ভুবি চিকিৎসন্তে রোগার্তান্ মৃগপক্ষিণঃ।
শ্বাপদানি দরিদ্রাংশ্চ প্রায়ো নার্তা ভবন্তি তে॥
ঘোরানপি দুরাধর্ষান, নৃপতীনুগ্রতেজসঃ।
আক্রম্যাদদতে রোগাঃ পশূন্ পশুগণা ইব॥

— ব্যাধিতে ক্লিষ্ট হয়ে যাদের বিপুল ধন ত্যাগ করতে হয়, চিকিৎসকগণ যত্ন ক’রেও তাদের মনোবেদনা দূর করতে পারেন না। অতিনিপুণ অভিজ্ঞ বৈদ্যগণ, যাঁরা ঔষধ সঞ্চয় ক’রে রাখেন, ব্যাধ কর্তৃক নিপীড়িত মৃগের ন্যায় তাঁরাও ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হন। পৃথিবীতে রোগার্ত মৃগ পক্ষী শ্বাপদ ও দরিদ্র লোককে কে চিকিৎসা করে? এরা প্রায়ই পীড়িত হয় না। পশু যেমন প্রবলতর পশু কর্তৃক আক্রান্ত হয়, অতি দুর্ধর্ষ উগ্রতেজা নৃপতিও সেইরূপ রোগের কবলে পড়েন।

 দেবর্ষি নারদ শুকদেবকে এইপ্রকার অনেক উপদেশ দিলেন। শুকদেব ভাবলেন, স্ত্রীপুত্রাদি পালনে বহু ক্লেশ, বিদ্যার্জনেও বহু শ্রম; অল্প আয়াসে কি ক’রে আমি শাশ্বত স্থান লাভ করব যেখান থেকে আর সংসারে ফিরে আসতে হবে না? শুকদেব স্থির করলেন, তিনি যোগবলে দেহ ত্যাগ ক’রে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করবেন। তিনি নারদের অনুমতি নিয়ে ব্যাসদেবের কাছে গেলেন। ব্যাস বললেন, পুত্র, তুমি কিছুক্ষণ এখানে থাক, তোমাকে দেখে আমার চক্ষু তৃপ্ত হ’ক। শুকদেব উদাসীন স্নেহশূন্য ও সংশয়মুক্ত হয়ে পিতাকে ত্যাগ ক’রে কৈলাস পর্বতের উপরে চ’লে গেলেন। সেখান থেকে তিনি যোগাবলম্বন ক’রে আকাশে উঠে সূর্যের অভিমুখে যাত্রা করলেন এবং বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বে গিয়ে ব্রহ্মত্ব লাভ করলেন।

 ব্যাসদেব স্নেহবশত পুত্রের অনুগমন করলেন এবং সরোদনে উচ্চস্বরে শুক ব’লে ডাকতে লাগলেন। সর্বব্যাপী সর্বাত্মা সর্বতোমুখ শুক স্থাবরজঙ্গম অনুনাদিত ক’রে ‘ভোঃ’ শব্দে উত্তর দিলেন। তদবধি গিরিগহ্বর প্রভৃতিতে কিছু বললে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

 শুকদেব অন্তর্হিত হ’লে ব্যাসদেব পর্বতশিখরে ব’সে তাঁর পুত্রের বিষয় চিন্তা করতে লাগলেন। সেই সময়ে মন্দাকিনীতীরে যে অপ্সরারা নগ্ন হয়ে ক্রীড়া করছিল তারা ব্যাসকে দেখে ত্রস্ত ও লজ্জিত হ’ল, কেউ জলমধ্যে লীন হয়ে রইল, কেউ গুল্মের অন্তরালে গেল, কেউ পরিধেয় বস্ত্র গ্রহণে ত্বরান্বিত হ’ল। এই দেখে পুত্রের অনাসক্তি এবং নিজের আসক্তি বুঝে ব্যাসদেব প্রীত[৬] ও লজ্জিত হলেন। অনন্তর পিনাকপাণি ভগবান শংকর আবির্ভূত হয়ে পুত্রবিরহকাতর ব্যাসদেবকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তোমার পুত্রের ও তোমার কীর্তি চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে। মহামুনি, তুমি আমার প্রসাদে সর্বদা সর্বত্র নিজ পুত্রের ছায়া দেখতে পাবে।

২৪। উঞ্ছব্রতধারীর উপাখ্যান

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি মোক্ষধর্ম বিবৃত করেছেন, এখন আশ্রমবাসীদের ধর্ম সম্বন্ধে বলুন। ভীষ্ম বললেন, সকল আশ্রমের জন্যই স্বর্গদায়ক ও মোক্ষফলপ্রদ ধর্ম বিহিত আছে। ধর্মের বহু দ্বার, ধর্মানুষ্ঠান কখনও বিফল হয় না। যাঁর যে ধর্মে নিষ্ঠা, সেই ধর্মই তিনি অবলম্বন করেন। পুরাকালে দেবর্ষি নারদ ইন্দ্রকে যে উপাখ্যান বলেছিলেন তা শোন।—

 গঙ্গার দক্ষিণ তীরে মহাপদ্ম নগরে এক ধার্মিক জিতেন্দ্রিয় ব্রাহ্মণ বাস করতেন, তাঁর অনেক পুত্র ছিল। তাঁর এই ভাবনা হ’ল—বেদোক্ত ধর্ম, শাস্ত্রোক্ত ধর্ম, এবং শিষ্টাচারসম্মত ধর্ম, এই তিনের মধ্যে কোনটি তাঁর পক্ষে শ্রেয়। একদিন তাঁর গৃহে একজন ব্রাহ্মণ অতিথি এলে তিনি যথাবিধি সৎকার ক’রে নিজের সংশয়ের বিষয় জানালেন। অতিথি বললেন, এ সম্বন্ধে আমিও কিছু স্থির করতে পারি নি। কেউ মোক্ষের প্রশংসা করেন, কেউ বা যজ্ঞ, বানপ্রস্থ, গার্হস্থ্য, রাজধর্ম, গুরু নির্দিষ্ট ধর্ম, বাক্‌সংযম, পিতামাতার সেবা, অহিংসা, সত্যকথন, সম্মুখযুদ্ধে মরণ, অথবা উঞ্ছবৃত্তিকেই শ্রেষ্ঠ মার্গ মনে করেন। আমার গুরুর নিকট শুনেছি, নৈমিষক্ষেত্রে গোমতীতীরে নাগাহ্বয় (নাগ নামক) নগর আছে, সেখানে পদ্মনাভ নামে এক মহানাগ বাস করেন। তাঁর কাছে গেলে তিনি তোমার সংশয় ভঞ্জন করবেন।

 পরদিন অতিথি চ’লে গেলে ব্রাহ্মণ নাগনগরের অভিমুখে যাত্রা করলেন এবং বহু বন তীর্থ সরোবর প্রভৃতি অতিক্রম ক’রে পদ্মনাভের পত্নীর নিকট উপস্থিত হলেন। ধর্মপরায়ণা নাগপত্নী বললেন, আমার পতি সূর্যের রথ বহন করবার জন্য গেছেন, সাত আট দিন পরে ফিরে আসবেন। ব্রাহ্মণ বললেন, আমি গোমতীতীরে যাচ্ছি, সেখানে অল্পাহারী হয়ে তাঁর প্রতীক্ষা করব। পদ্মনাভ যথাকালে তাঁর ভবনে ফিরে এলে নাগপত্নী তাঁকে জানালেন যে তাঁর দর্শনার্থী এক ব্রাহ্মণ গোমতীতীরে অনাহারে রয়েছেন, বহু অনুরোধেও তিনি আহার করেন নি, তাঁর কি প্রয়োজন তাও বলেন নি। পদ্মনাভ তখনই ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে তাঁর আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ব্রাহ্মণ বললেন, আমার নাম ধর্মারণ্য; কৃষক যেমন জলধরের প্রতীক্ষা করে সেইরূপ আমি এত দিন তোমার প্রতীক্ষা করেছি। আমার প্রয়োজনের কথা পরে বলব, এখন তুমি আমার এই প্রশ্নের উত্তর দাও—তুমি পর্যায়ক্রমে সূর্যের একচক্র রথ বহন করতে যাও, সেখানে আশ্চর্য বিষয় কি দেখেছ?

 পদ্মনাভ বললেন, ভগবান রবি বহু আশ্চর্যের আধার। দেবগণ ও সিদ্ধ মুনিগণ তাঁর সহস্র রশ্মি আশ্রয় ক’রে বাস করেন, তাঁর প্রভাবেই সমীরণ প্রবাহিত হয়, বর্ষায় বারিপাত হয়; তাঁর মণ্ডলমধ্যবর্তী তেজোময় মহান আত্মা সর্বলোক নিরীক্ষণ করেন। তিনি বর্ষিত জল পবিত্র কিরণ দ্বারা আট মাস পুনর্বার গ্রহণ করেন, তাঁর জন্যই এই বসুন্ধরা বীজ ধারণ করে, তাঁর মধ্যে অনাদি অনন্ত পুরুষোত্তম বিরাজ করেন। এইসকল অপেক্ষা আশ্চর্য আর কি আছে? তথাপি আরও আশ্চর্য যা দেখেছি তা শুনুন। একদিন মধ্যাহ্নকালে যখন ভাস্কর সর্বলোক তাপিত করছিলেন তখন তাঁর অভিমুখে দ্বিতীয় আদিত্যতুল্য দীপ্তিমান অপর এক পুরুষকে আমি যেতে দেখলাম। সূর্যদেব তাঁর দিকে দুই হস্ত প্রসারিত ক’রে সংবর্ধনা করলেন, সেই তেজোময় পুরুষও সসম্মানে নিজের দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত ক’রে সূর্যের রশ্মিমণ্ডলে প্রবিষ্ট হলেন। উভয়ের মধ্যে কে সূর্য তা আর বোঝা গেল না। আমরা সূর্যকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভগবান, দ্বিতীয়সূর্যতুল্য ইনি কে? সূর্য বললেন, ইনি অগ্নিদেব নন, অসুর বা পন্নগও নন; ইনি উঞ্ছবৃত্তি[৭]-ব্রতধারী সমাধিনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ছিলেন, অনাসক্ত এবং সর্বভূতহিতে রত হয়ে ফলমূল জীর্ণপত্র জল ও বায়ু ভক্ষণ ক’রে প্রাণধারণ করতেন। মহাদেবকে তুষ্ট ক’রে ইনি এখন সূর্যমণ্ডলে এসেছেন।

 ব্রাহ্মণ বললেন, নাগ, তোমার কথা আশ্চর্য বটে। আমি প্রীত হয়েছি, তোমার কথায় আমি পথের সন্ধান পেয়েছি, তোমার মঙ্গল হ’ক, আমি এখন প্রস্থান করব। পদ্মনাভ বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, কোন্ প্রয়োজনে আপনি এসেছিলেন তা না ব’লেই যাবেন? বৃক্ষমূলে উপবিষ্ট পথিকের ন্যায় আমাকে একবার দেখেই চ’লে যাওয়া আপনার উচিত নয়। আমি আপনার প্রতি অনুরক্ত, আপনিও নিশ্চয় আমাকে স্নেহ করেন, আমার অনুচরগণও আপনার অনুগত, তবে কেন যাবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন? ব্রাহ্মণ বললেন, মহাপ্রাজ্ঞ ভুজঙ্গম, তোমার কথা যথার্থ। তুমিও যে, আমিও সে, তোমার আমার এবং সর্বভূতের একই সত্তা। তোমার কথায় আমার সংশয় দূর হয়েছে, আমি পরমার্থলাভের উপায় স্বরূপ উঞ্ছবৃত্তিই গ্রহণ করব। তোমার মঙ্গল হ’ক, আমি কৃতার্থ হয়েছি। এই ব’লে ব্রাহ্মণ প্রস্থান করলেন এবং ভৃগবংশজাত চ্যবনের নিকট দীক্ষা নিয়ে উঞ্ছবৃত্তি অবলম্বন করলেন।

  1. সৌপ্তিকপর্ব ৭-পরিচ্ছেদে আছে, যজ্ঞ মৃগরূপে পালিয়েছিলেন।
  2. ভৃগুপত্নী। দেবগণের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য অসুরগণ এঁর আশ্রমে শরণ নিয়েছিলেন। দেবতারা সেখানে প্রবেশ করতে পারেন নি, এজন্য বিষ্ণু তাঁর চক্র দিয়ে ভৃগুপত্নীর শিরশ্ছেদ করেন।
  3. মিথিলার সকল রাজাকেই জনক বলা হ’ত।
  4. অর্থাৎ সুলভা তাঁর সূক্ষ্মশরীর দ্বারা জনকের দেহে ভর করলেন।
  5. কর্ণপর্ব ১২-পরিচ্ছেদে বাহীকদেশের নিন্দা আছে।
  6. ব্যাস জানতেন যে অপ্সরারা জিতেন্দ্রিয় নির্বিকার শুকের সমক্ষে লজ্জিত হ’ত না।
  7. ক্ষেত্রে পতিত ধান্যাদি খুঁটে নেওয়া; অর্থাৎ অত্যল্প উপকরণে জীবিকানির্বাহ।