পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/১১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
১০৭

আচরণে ও ব্যবহারে কদাচ ধরা পড়েন না। কেন? উত্তরটা স্পষ্টতঃ না দিলেও একভাবে আভাসে এতক্ষণ দেওয়া হইয়াছে। এখন স্পষ্টভাবে উত্তরটা দেওয়া যাইতেছে।

 আচরণ, ব্যবহার ইত্যাদির সঙ্গে ব্রহ্মজ্ঞপুরুষের যথার্থ কোন যোগ নাই। ব্যক্তিই তাহার আচরণে ব্যক্ত হইয়া থাকে, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ ব্যক্তি নহেন। কারণ, ব্যক্তিত্বের নিঃশেষিত বিলোপ না ঘটিলে ব্রহ্মজ্ঞ হওয়া চলে না।

 ব্রহ্মজ্ঞের যে-ব্যক্তিত্ব তাহা নৈর্ব্যক্তিক ব্যক্তিত্ব। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষকে বাহির হইতে চিনিবার কোন লক্ষণ পাওয়া যায় না, অন্ততঃ তাঁহার আচরণে পাওয়া যায় না। খুব সজাগ ও সতর্ক থাকিলে একটি মাত্র লক্ষণ ধরা দিয়া থাকে, তাহা হইল এই—ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের ‘অহং’ পরিদৃষ্ট হয় না, না আচরণে না কথাবার্তায়।

 আর একটি কথা আছে, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ ধর্মাধর্ম, ন্যায়-অন্যায়, পাপপুণ্য ইত্যাদির দ্বারা অস্পৃষ্ট। তাঁহাদের নিকট ন্যায় ও অন্যায়, ভালোমন্দ, ইত্যাদি সমস্তই সমান অথবা এক। কিন্তু আচরণে তাঁহারা কখনো ক্ষেত্র-ধর্ম লঙ্ঘন করেন না দেখা যায়।

 আচার্য শঙ্কর তাঁহার শারীরকভাষ্যে একস্থানে এইরূপ অভিমতই প্রকাশ করিয়াছেন যে, ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্বান (ব্রহ্মবিদ্যাপ্রাপ্ত ব্যক্তি) এবং অবিদ্বানে কোন পার্থক্য নাই। অর্থাৎ, সর্ব বন্ধনমুক্ত হইয়াও ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তির আচরণ, ব্যবহার আর দশজন লোকেরই মত, ইহাই হইল আচার্য শংকরের সিদ্ধান্ত।

 আচরণ দেখিয়া ব্রহ্মজ্ঞ বাছাই বা সনাক্ত করা হাস্যকর বালসুলভ চিন্তা বা চেষ্টা মাত্র। আচরণ দেখিয়া যদি ব্রহ্মকে ধরা যাইত, তবে ঢেউ ধরিয়া সমুদ্রকে পারে টানিয়া আনা যাইত। অগণিত গ্রহ-উপগ্রহের প্রচন্ড ঘূর্ণি বা আবর্তনে যেমন আকাশের বুকে কোন দাগ কাটে না বা রাখে না, সংসার বা তাহার ব্যবহারও তেমনি ব্রহ্মজ্ঞ-চরিত্রে কোন দাগ কাটে না। অগণিত গ্রহ-উপগ্রহকে বুকে স্থান দিয়াও যেমন আকাশ স্থির, স্বতন্ত্র ও পৃথক, বহু ও বিচিত্র আচরণকে আশ্রয় দিয়াও ব্রহ্মজ্ঞের জীবন মুক্ত, অস্পষ্ট ও পৃথক। কারণ, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ দেহে থাকিয়াও বিদেহী। দেহের আচরণ দ্বারা বিদেহীকে কখনও কেহ ধরিতে পারে না, যদি না তাঁহারা কৃপা করিয়া ধরা দেন।

 রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সম্ভাব্য সর্বরকম অভিযোগ মানিয়া লইয়াই আমরা এতক্ষণ আলোচনা করিয়াছি এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি