বলা হইয়াছে যে, ব্রহ্মজ্ঞের প্রাপ্য মুক্তিফল সম্পর্কেও এমন কোন নিয়ম নাই যে, দেহান্তেই তাহা তিনি প্রাপ্ত হইবেন।
ব্রহ্মজ্ঞ হইয়াও কেন দেহান্তে মুক্তিলাভ হইবে না, এ আলোচনা বিচার্য ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। দেখা গেল যে, ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তিও মুক্তিফল হইতে বঞ্চিত থাকেন, অবশ্য বিশেষ কারণে। বিশেষ কারণটি হইল কর্মবন্ধন।
ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষেরও যদি কর্মবন্ধন থাকে, তবে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে বদ্ধপুরুষের আচরণ যদি কেহ পরিদর্শন করিয়া থাকেনই, তবে কি তাহা আদৌ আশ্চর্যের বিষয় কিছু? ভগবান বেদব্যাসের ব্রহ্মসূত্র তথা উপনিষদ হইতেই জানা যায় যে, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষেরও কর্মক্ষয় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হয় বিদেহ মুক্তির পূর্বে। সেই কর্ম ভালোও হইতে পারে, মন্দও হইতে পারে, কিম্বা শুভাশুভ মিশ্রিতও হইতে পারে।
এই কারণেই আমরা দ্বিধাহীন কণ্ঠে এবং অকুণ্ঠ চিত্তে ঘোষণা করিয়াছি—আচরণ দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞকে জানা যায় না, আচরণে ব্রহ্মজ্ঞানের কোন হানি ঘটে না। তাই তাঁহার আচরণের তথাকথিত ভালোমন্দ সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ, রবীন্দ্রনাথ ঋষি।
ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের অবস্থা সম্বন্ধে বেদান্তের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ ‘পঞ্চদশী’তে যে বিশদ আলোচনা করা হইয়াছে, কৌতূহলী পাঠক এবং জিজ্ঞাসুগণ তাহা পাঠ করিয়া দেখিতে পারেন। প্রসিদ্ধ বেদভাষ্যকার সায়নাচার্যের ভ্রাতা মাধবাচার্য বা বিদ্যারণ্য মুনীশ্বর ‘পঞ্চদশী’র রচয়িতা। বিদ্যারণ্যমুনিকে শঙ্করাচার্যের অবতার বা দ্বিতীয় শঙ্করাচার্য বলিয়া অদ্বৈতী-বেদান্তিগণ পূজা করিয়া থাকেন। ‘পঞ্চদশী’কারও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের জীবনযাত্রা, আচরণ ইত্যাদি সম্বন্ধেই বহু প্রশ্ন উত্থাপন করিয়া তাহার উত্তর দিয়াছেন।
তাঁহার সিদ্ধান্তের সামান্য কিছু, উদ্ধৃত করা যাইতেছে, তাহাতে আমাদের অভিমতের পূর্ণ সমর্থনই পাঠক দেখিতে পাইবেন।
(১) “যেমন দাইটি ভাষায় অভিজ্ঞ ব্যক্তি যথাক্রমে দুইটি ভাষাই ব্যবহার করেন, সেইরূপে তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি বিষয়ানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ উভয়ই উপলব্ধি করিয়া থাকেন।”
(২) “যেমন গঙ্গায় অর্ধমগ্ন পুরুষের যুগপৎ শীতোষ্ণ জ্ঞান হয়, সেইরূপ বিবেকীর স্বরূপানন্দ ও সাংসারিক সুখদুঃখ যুগপৎ অনুভূত হয়।”
(৩) “যতদিন দেহ থাকে, ততদিন তত্ত্বজ্ঞের অবিদ্যা-বাসনাও থাকে, এই জন্য কখনো কখনো তত্ত্বজ্ঞও স্বপ্নে সাধারণ লোকের ন্যায় সুখ দুঃখ অনভব করেন।”