পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/১১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১০
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

 (৪) “ভোগ ব্যতিরেকে প্রারব্ধ ক্ষয় হইবার নহে। বামদেবের ইহা ক্ষয় হইতে এক জন্ম লাগিয়াছিল। বস্তুতঃ শেষ প্রারব্ধ ক্ষয় হইতে কত জন্ম লাগিবে তাহার নিয়ম নই।” ব্রহ্মসূত্রে ভগবান বেদব্যাসের সিদ্ধান্তেরই ইহা প্রতিধ্বনি যে, ব্রহ্মজ্ঞানের ফলপ্রাপ্তি যে এই দেহান্তেই ঘটিবে, তাহার কোন নিয়ম নাই।

 (৫) “প্রারব্ধের বশে তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিরও কদাচিৎ অনাচারে প্রবৃত্তি হইতে পারে; কারণ প্রারব্ধ কর্মকে কাহারও এড়াইবার ক্ষমতা নাই।”

 (৬) “যাঁহার পূর্ণমাত্রায় তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়, কিন্তু বৈরাগ্য ও উপরতি প্রতিবন্ধ হয়, তাঁহার মুক্তিলাভ হয় সন্দেহ নাই; তবে দুস্প্রারব্ধবশে জীবদ্দশায় দুঃখ ভোগ হইতে নিষ্কৃতি হয় না, অর্থাৎ জীবন্মুক্তি সুখ ঘটে না।”

 বেদান্তের দ্বিতীয় শঙ্করের সিদ্ধান্তসমূহ যে আমাদের পূর্বোক্ত অভিমতসমূহের পূর্ণ সমর্থন করিতেছে, ইহা আর খুলিয়া বলার দরকার করে না। কাজেই আচরণ হইতে ব্রহ্মজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকে ধরা যাইবে না এবং কোন আচরণেই তাঁহার ব্রহ্মজ্ঞানের ইতর বিশেষ সাধিত হয় না, ইহাই সিদ্ধান্ত।

 জাগ্রত অবস্থায় ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের চরিত্রে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হইয়া থাকে, শাস্ত্র বলেন। তাহা হইল—জ্ঞান, বৈরাগ্য ও উপরতি অর্থাৎ শান্তি। প্রারব্ধের জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে বৈরাগ্য কিম্বা উপরতির তারতম্য পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞের কখনো আত্মবিস্মৃতি ঘটে না। অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান তাঁহার অব্যাহত ও স্থায়ী হইয়াই থাকে।

 কাজেই রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যদি কেহ যথার্থই বৈরাগ্য বা উপরতির কম বেশী অভাব দেখিয়া থাকেন বা দেখাইতে পারেন, তাহা হইলেও ব্রহ্মজ্ঞানের তাহাতে কোন হ্রাস বৃদ্ধি হয় না। তখনো রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ, তখনো রবীন্দ্রনাথ ঋষি।

 পঞ্চাশ পার হইলে ‘বনং প্রজেৎ’ বিধান আছে। আর বন বলিতে ভারতের তপোবনকেই বুঝাইয়া থাকে। এযুগের ভারতের তপোবনের ঋষি বলিয়া যাঁহাকে জানিয়াছি এবং মানিয়াছি, পঞ্চাশ পার হইয়া বনে গমনের পরিবর্তে তাঁহারই পায়ে প্রণাম জানাইতেছি। ‘ঋষি রবীন্দ্রনাথ’ আমার সেই পঞ্চাশোর্ধে বনং ব্রজেৎ, অর্থাৎ আমার ঋষি-প্রণাম।