পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
৮৩

প্রকাশিত হইয়াছিল। ‘শান্তিনিকেতন’ (দুই খন্ড) নামক গ্রন্থকে বলা হয় উপনিষদের রবীন্দ্র-ভাষ্য এবং বিশেষভাবে এই গ্রন্থের ভিত্তিতেই রবীন্দ্রনাথকে বলা হয় এ যুগে উপনিষদের শ্রেষ্ঠতম ভাষ্যকার। কিন্তু নিজের ‘ধর্ম’ ব্যাখ্যায় বা পরিচয়ে রবীন্দ্রনাথ এই ‘শান্তিনিকেতন’-কেও বাতিল করিয়া এই কয়টি কথা বলিয়াছেন—

 “কিন্তু যেখানে আমি স্পষ্টত ধর্মব্যাখ্যা করেছি, সেখানে আমি নিজের অন্তরতম কথা না বলতেও পারি—সেখানে বাইরের শোনা কথা নিয়ে ব্যবহার করা অসম্ভব নয়। সাহিত্যরচনায় লেখকের প্রকৃতি নিজের অগোচরে নিজের পরিচয় দেয়—সেটা তাই অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ।”

 সাহিত্য রচনায় লেখকের প্রকৃতি নিজের অগোচরে প্রকাশিত হয়, ইহাই রবীন্দ্রনাথের নিশ্চিত অভিমত। অন্তত তাঁহার নিজের রচনায় তাঁহার আপন প্রকৃতিই অজ্ঞাতসারে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে, ইহাই রবীন্দ্রনাথ বলিতে চাহিয়াছেন।

 তাঁহার সাহিত্য সৃষ্টিতে তাঁহার ‘অন্তরতম’ কথা বা চরিত্রটি ব্যক্ত হইয়াছে, ইহাই রবীন্দ্রনাথ মনে করেন। কাজেই, নিজের সাহিত্যকেই তিনি নিজের ‘ধর্ম’ সম্বন্ধে বিশুদ্ধ সাক্ষ্য বলিয়া ‘আমার ধর্ম’ প্রবন্ধে গ্রহণ করিয়াছেন।

 সত্তর বৎসর বয়স পূর্তিতে রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসবে তাঁহার ‘প্রতিভাষণে’ তিনি যাহা বলিয়াছেন, তাহা হইতে পূর্বে কিছুটা উদ্ধৃত হইয়াছে। আলোচ্য ক্ষেত্রেও সেই উদ্ধৃতিটকুর পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন মনে হইতেছে। তিনি সেখানে নিজের রচনা সম্বন্ধে এই অভিমত প্রকাশ বা এই দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করিয়াছেন—

 “অনেকদিন থেকেই লিখে আসছি, জীবনের নানা পর্বে নানা অবস্থায়। শুরু করেচি কাঁচা বয়সে—তখনো নিজেকে বুঝিনি। তাই আমার লেখার মধ্যে বাহুল্য এবং বর্জনীয় জিনিস ভুরি ভুরি আছে তাতে সন্দেহ নেই। এ সমস্ত আবর্জনা বাদ দিয়ে বাকি যা থাকে আশা করি তার মধ্যে ঘোষণাটি স্পষ্ট যে, আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে, যে-মুক্তি পরমপুরুষের কাছে আত্মনিবেদনে, আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য মহামানবের মধ্যে, যিনি সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট॥”

 রবীন্দ্রনাথ নিজের সাহিত্য-সৃষ্টিকে স্বয়ং কি মনে করেন, সে প্রশ্নের উত্তর উদ্ধৃতিটুকুতে অতি স্পষ্ট। তিনি জগৎকে ভালোবাসেন, তিনি মুক্তিকামী যে-মুক্তি পরমপুরুষের মধ্যে আত্মনিবেদনে, যিনি সদা ‘জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট’ তিনি তাঁহারও হৃদয়ে স্থিত ইত্যাদি ঘোষণাই তাঁহার সাহিত্য-সাধনায় ও সৃষ্টিতে তিনি করিতে