পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৪
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

চাহিয়াছেন। অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথের অভিমতে তাঁহার সাহিত্য আর কিছুই নহে তাহা এক মুক্তিকামী পুরুষের ব্রহ্মসাধনারই পরিচয় মাত্র।

 এই জন্যই অন্যত্র তিনি বলিয়াছেন, “অতি অল্প বয়স থেকে স্বভাবতই আমার লেখার ধারা আমার জীবনের ধারার সঙ্গে সঙ্গেই অবিচ্ছিন্ন এগিয়ে চলেছে॥”

 কবি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবন এবং মানুষ রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন দুটি স্বতন্ত্র ধারা হইলেও তাহা অবিচ্ছিন্ন এবং যুক্তভাবেই প্রবাহিত, ইহাই রবীন্দ্রনাথ বলিতে চাহিয়াছেন। ইহার অর্থ, তাঁহার সাহিত্য সৃষ্টিকেই তিনি, আপনার সত্যিকার জীবনচরিত্র বলিয়া মনে করেন। সোজা ভাষায়—রবীন্দ্র-সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত চরিত্রেরই ফটো।

 নিশ্চয় একটা আপত্তি উঠিতে পারে যে, কবি বা লেখকের রচনাকে তাঁহাদের আত্মজীবনী বলিয়া কখনো গ্রহণ করা চলে না, যেমন ডাক্তারের চিকিৎসা ব্যবসা তাহার ব্যক্তিগত জীবন চরিত্র নহে। রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্য কবি-প্রতিভা এবং সৃজনশক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহার সাহিত্যসৃষ্টি সেই শক্তিরই দান বা প্রকাশ, ইহার সঙ্গে তাঁহার আধ্যাত্মিক সাধনা বা সিদ্ধির কোন যোগ থাকিতে পারে না। কেহ ডাক্তার, কেহ উকীল, কেহ শিক্ষক, কেহ ব্যবসায়ী, তেমনি রবীন্দ্রনাথও কবি এবং কাব্যসৃষ্টি তাঁহার কর্মমাত্র। অপর দশজনের কর্মকে যে চোখে আমরা দেখি, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মকেও সেই দৃষ্টিতেই দেখা কর্তব্য। তাঁহার সাহিত্যের গুণাগুণ বিচার সে ক্ষেত্রে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক।

 এ আপত্তি একেবারে অযৌক্তিক বলা চলে না এবং আপত্তিটিকে স্বীকার করিয়া লওয়া যাইতেছে।

 সংসারে সকলেই নিজ নিজ শক্তি ও ভাগ্যনির্দিষ্ট কর্মে নিযুক্ত, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সৃষ্টিও তেমনি কর্ম। জেলের মাছ ধরা, চাষার চাষ করা, মুটের বোঝাবওয়া, কেরাণীর কলম-পেষা ইত্যাদির মত রবীন্দ্রনাথের কবিতা লেখা এবং সাহিত্য রচনাও একটি কর্মমাত্র। আর সে কর্ম জগতের কর্মসংজ্ঞায় বা কর্মসভায় সব কর্মেরই সমগোত্র ও সমপংক্তি—ইহা মানিয়া লইতে আমাদেরও আপত্তি নাই। ইহা মানিয়া লইয়াই রবীন্দ্রনাথের কর্ম অর্থাৎ তাঁহার সাহিত্যকর্ম ও রচনাবলীকে বিচার করা যাইতেছে।