পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
৯১

 কে এই পরমপুরুষ? তিনিই এই পরমপুরুষ, যাঁহার নিকট আত্মনিবেদনেই কেবল মুক্তি সম্ভব হয়। ব্রহ্ম ভিন্ন মুক্তিদাতা দ্বিতীয় কেহ নাই, আর ‘পরমপুরুষ’ শব্দটিও ব্রহ্মবাচক। কাজেই, গীতাঞ্জলিকে ‘এ আমার সত্যকার আত্মনিবেদন’ বলার অর্থ মোটেই অস্পষ্ট নহে, এক কথায়, ভগবানের নিকট রবীন্দ্রনাথের আত্মনিবেদনেরই অপর নাম গীতাঞ্জলি।

 রবীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত উপলব্ধিসমূহের বিবরণ আর যাহাই হউক, তাহা ভগবানের নিকট আত্মনিবেদন নহে তাহা দশজনের নিকট সংবাদ নিবেদন মাত্র। কাজেই উপলব্ধির বিবরণ এবং ‘আত্মনিবেদন’ তথা ‘গীতাঞ্জলি’ যে এক শ্রেণীর ব্যাপার নহে, ইহা বিনা তর্কেই আমরা মানিয়া লইতে পারি। উপলব্ধির বিবরণের শ্রোতা বা লক্ষ্য হইলাম আমরা দশজন, আর গীতাঞ্জলির শ্রোতা হইলেন মাত্র ‘সেই একজন’। ইহাই হইল সংক্ষেপে উভয়ের মধ্যেকার উল্লিখিত পার্থক্য।

 উপলব্ধির প্রসঙ্গ বাদ দিয়া এখন ‘গীতাঞ্জলি’র প্রসঙ্গে আসা যাইতেছে এবং ‘গীতাঞ্জলি’ সম্বন্ধে বক্তব্য একটু পরিষ্কার ও বিশদ করা যাইতেছে।

 গীতাঞ্জলি সম্পর্কে প্রারম্ভেই আলোচনায় এইরূপ একটি অভিমত আমরা ব্যক্ত করিয়াছি যে, গীতা যদি ভগবানের ‘মে হৃদয়ং পার্থ’ হয়, তবে গীতাঞ্জলিকেও তেমনি রবীন্দ্রনাথের ‘মে হৃদয়ং’ বলা যাইতে পারে। ‘গীতা ও গীতাঞ্জলি’—নামক একটি প্রবন্ধে পূর্বে এই বিষয়ে যে-আলোচনা করিয়াছি, এই প্রসঙ্গে তাহা হইতে কিছুটা উদ্ধৃতি অসঙ্গত হইবে না। সেখানে এক স্থানে এই কথা বলা হইয়াছে—

 “গীতা ও গীতাঞ্জলির মধ্যে নামসাদৃশ্যের ন্যায় একটি রূপ-সাদৃশ্যও বর্তমান। গীতাকে ভগবান বলিয়াছেন তাঁহার বাঙ্ময়ী রূপ, গীতাঞ্জলিকে বলা চলে ভক্তের সুরময়ী রূপে। গীতাকে বলা হইয়াছে ভগবানের হৃদয়-রস, গীতাঞ্জলিও তেমনি ভক্তের হৃদয়-রস। গীতার বক্তা ভগবান—শ্রোতা ভক্ত। আর গীতাঞ্জলির গায়ক ভক্ত—শ্রোতা ভগবান। ভগবান শুনাইয়াছেন—গীতা, ভক্ত শুনাইয়াছেন—গান। ভক্ত না থাকিলে গীতা ব্যর্থ, ভগবান না থাকিলে গীতাঞ্জলি মিথ্যা।”

 ইহার সঙ্গে এখন সামান্য আর একটু যোগ করা যাইতেছে। আঠারো অধ্যায়ের গীতা শুনাইয়া শেষে আসিয়া সমস্ত গীতার সারমর্ম শ্রীভগবান তাঁহার ‘পরমগুহ্যতম বচনং মে’ বলিয়া জানাইয়াছেন,—‘সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’— একমাত্র আমার শরণ লও। তাহারই প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথের যে- আত্মনিবেদন তাহাই গীতাঞ্জলি।